এইদিন ওয়েবডেস্ক,১৩ মে ২০২৩ : পশ্চিমবঙ্গের শাসনক্ষমতায় তখন সিপিএমের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার । মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে জ্যোতি বসু । তার নির্দেশে ১৯৭৯ সালের ১৩ ই মে শুরু হয় হিন্দু উদ্বাস্তু উচ্ছেদ অভিযান । বাংলাদেশে ইসলামি মৌলবাদীদের অত্যাচারের শিকার একদল হিন্দু নমঃশূদ্র শরনার্থী পরিবারকে ভারত ছাড়া করার সেই অমানবিক ‘অপারেশন’ শুরু হয় আজকের দিনে । কলকাতা থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে সুন্দরবনের লাগোয়া ১২৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট দ্বীপ মরিঝঝাঁপিতে তারা গড়ে তুলেছিল বসতি । ছিল না সরকারি সাহায্য । নিজেদের কায়িক শ্রমের ভরসায় বসবাসের উপযুক্ত করে তুলেছিল শ্বাপদসংকুল ওই দ্বীপটাকে । কিন্তু কোন এক অজ্ঞাতকারনে ওই হিন্দু পরিবারগুলিকে উৎখাত করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন বামফ্রন্টদের সর্বকালের প্রিয় কমরেড জ্যোতিবাবু ।
জলপথে গোটা দ্বীপ টাকে ছোট ছোট জলযান দিয়ে ঘিরে ফেলে নির্বিচারে গুলি চালায় মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ । সেদিন ৩০ থেকে ৩৫ টি লঞ্চ দিয়ে পুলিশ পুরো দ্বীপটিকে ঘিরে ফেলে বলে দাবি করা হয় । আগুন ধরানো হয় অসহায় পরিবারগুলির কাঁচা ঘরবাড়িগুলিতে । প্রাণ বাঁচাতে যারা কোরানখালি নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল,নির্বিচারে গুলি করে মেরে ফেলা হয় তাদের । মৃতদেহগুলি পর্যন্ত খোঁজার চেষ্টা করেনি পুলিশ । নির্মম সেই অপারেশন চলেছিল ১৩ মে থেকে ১৬ মে পর্যন্ত টানা ৪ দিন ধরে । হতভাগ্য মানুষগুলো বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল । কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অস্ত্রবলের কাছে তাদের শেষ পর্যন্ত পরাজয় স্বীকার করতে হয় । মরিচঝাঁপিকে উদ্বাস্তু শূন্য করার পর পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার সদর্পে ঘোষণা করে-‘অপারেশন সাকসেসফুল !’
পরে নৃশংস ওই নরহত্যার ঘটনাটা বেমালুম চেপে যায় পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন কম্যুনিস্ট সরকার । কিন্তু মরিচঝাঁপিতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশি উদ্বাস্তু হিন্দুদের কয়েকজন প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয় । বহু পরে তারাই জ্যোতি বসুদের নরসংহারের কথা প্রকাশ্যে আনেন । সর্বহারা মানুষদের (প্রোলেতারিয়েত) জন্য লড়াইয়ের কথা বলা কমিউনিস্ট সরকারের এই প্রকার হিংস্র আচরণে শিহরিত হয়ে ওঠে গোটা বিশ্ব । বিশ্বের নরসংহারের ইতিহাসে ঠাঁই করে নেয় মরিচঝাঁপি ।
বেঁচে ফিরে আসা নারায়ণ মন্ডল,মুকুন্দ মন্ডলরা মিডিয়াকে বলেছিলেন,’সেদিন ৩০ থেকে ৩৫ টি লঞ্চ সহকারে পুলিশ পুরো দ্বীপটিকে ঘিরে ফেলে। কুমিরমারি থেকে খাবার জল আনতে যাবো, সেই পরিস্থিতিও ছিল না। আমাদের জীবনকে দূর্বিসহ করে তোলার জন্য তারা উঠে-পরে লেগেছিল। অসহায়ভাবে খিদের জ্বালায় তাই আমরা নারকেলের পাতা ও ঘাস খেতে বাধ্য হই। অনেক শিশু শুধু ডায়রিয়াতেই মারা যায় ।’ তিনি বলেছিলেন,’ছোট শিশুদের ছুঁড়ে কুমিরের মুখে ফেলে দেওয়া হয় । পাশের কুমিরমারি গ্রাম থেকে পানীয় জল, ঔষুধ এবং খাদ্য সামগ্রী যোগানের জন্য অবরোধের ১০ম দিনে আমরা মরিয়া হয়ে উঠি। নারীদের দেখে অন্তত দয়া হবে এই আশায় আমরা একটা নৌকাতে ১৬ জন মহিলাকে পাঠাই।। কিন্তু “ইন্দ্রজিৎ এমভি ৭৯” নামের একটি লঞ্চ দ্রুত গতিতে নৌকাটির নিকট এগিয়ে আসে এবং নদীর মাঝপথে নৌকাটিকে ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দেয় । ১৪ জন মহিলার আমরা প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হই । পরে আরও দু’জনকে বাগনান জঙ্গল থেকে উদ্ধার করি, যাদের উপর শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছিল ।’
মরিচঝাঁপির ‘অপারেশন’ নিয়েও মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন জ্যোতি বসুরা । সরকারি পরিসংখ্যানে পুলিশের গুলিতে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করা হয় । কিন্তু ভুক্তভোগী হিন্দু উদ্বাস্তুদের কথায় অন্তত ১,০০০ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ।
তৎকালীন প্রবীণ সাংবাদিক সুখরঞ্জন সেনগুপ্তর বলেছিলেন,’দেশভাগের অপরিণামদর্শিতার গর্ভের সন্তান দণ্ডকারণ্য । আর দণ্ডকের সীমাহীন অন্যায় ও অবিচারের গর্ভে জন্ম মরিচঝাঁপির । দেশভাগ যদি হয় অখণ্ড ভারতের রাজনীতিবিদদের পাপ, তবে মরিচঝাঁপি হলো পশ্চিমবঙ্গের বাম জমানার আদি পাপ ।’।
তথ্যসূত্র ও ছবি : সৌজন্যে গুগুল ।