প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থায় শাস্তি দান সম্পর্কিত বহু কাহিনী প্রচলিত আছে। তখন শিক্ষাবিদগণ বিশ্বাস করতেন শিক্ষা ক্ষেত্রের শাস্তি একটি অপরিহার্য কৌশল।প্রাচীন শিক্ষা শিক্ষাবিদগণ মনে করতেন শিক্ষার্থীর চারিত্রিক বিকাশ করতে হলে তাকে কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে রাখতে হবে।এবং তার কোনো ব্যতিক্রমী আচরণ দূর করতে হলে শাস্তি প্রদান করতে হবে।মহাকাব্যের যুগে দেখা যায় শিষ্য কোন বিধি-নিষেধ অনিচ্ছাকৃতভাবে লংঘন করলেও গুরু তাকে কঠোর শাস্তি দিতেন। প্রাচীন ভারতীয় আশ্রমিক শিক্ষায় ও শিষ্য কে বা শিক্ষার্থীকে কঠোর শাস্তি দানের ব্যবস্থা ছিল।পরবর্তীকালে শাস্তি দান প্রথায় দৈহিক নির্যাতন বিশেষভাবে প্রধান প্রাধান্য লাভ করে।
“Spare the rod and spoil the Child”-এই চিন্তাধারাই প্রচলিত হয়। বন্য পশুকে বশে আনার জন্য তার স্বাভাবিক আদিম প্রবৃত্তিগুলোকে দমন করার জন্য যেমন তাদের নির্যাতন করা হয়, তেমনি শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক আচরণ গুলিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে হলে তাদের দৈহিক নির্যাতন করতে হবে অর্থাৎ এই ধারণা অনুযায়ী শিক্ষার্থীকে বন্য পশুর সমগোত্রীয় বিবেচনা করা হতো। বর্তমানকালেও বহু ক্ষেত্রে এ ধরনের নীতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে।দৈহিক নির্যাতনমূলক শাস্তি বহুপ্রকার লক্ষ্য করা যায় সামান্য কান মলা থেকে শুরু করে চরম দৈহিক নির্যাতন পর্যন্ত।
কিন্তু আধুনিক শিক্ষাবিদগণ এই ধরনের দৈহিক নির্যাতন মূলক শাস্তির পক্ষপাতী নন।তাঁরা মনে করেন নির্যাতনমূলক শাস্তি শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষার প্রতি এক ঋণাত্মক মনোভাব(Negative attitude) গড়ে তোলে।যদিও এই ধরনের শাস্তির প্রভাবে শিক্ষার্থীগণ অবাঞ্ছিত কাজ থেকে বিরত থাকে। তবুও দেখা গেছে তার ফল চিরস্থায়ী হয় না।শিশু মন ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এবং তার ফলস্বরূপ তারা একসময় বিভিন্ন রকমের অপসংগতিমূলক(Maladjusted behaviour) আচরণ করে থাকে। এমনকি সুযোগ পেলেই তারা তাদের আদিম প্রবৃত্তিগুলোকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রকাশ করে।এই কারণে আধুনিক শিক্ষাবিদগণ এই ধরনের দৈহিক নির্যাতন মূলক শাস্তি দানের পক্ষপাতী নন।
আজকের বিশ্বে সবাই একমত যে, দেশ ও জাতির ভাগ্য উন্নয়নে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষাই দেশের সার্বিক উন্নয়নের ভিত মজবুত করে। আর এক্ষেত্রে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষার ভূমিকা সর্বাপেক্ষা বেশি সে কথাও আজ ঢালাও করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ স্তরের শিক্ষায় জেঁকে বসে আছে শাস্তি। গ্রাম-শহর সর্বত্র শ্রেণিকক্ষে নানা রকম শাস্তির প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশ শাস্তির প্রয়োগ আইন করে নিষিদ্ধ করেছে। জাতিসংঘ জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে(ধারা-৩১) শিশুর প্রতি যে কোনো ধরনের শাস্তি পরিহার করা, শিশুর সমান অধিকার, অংশগ্রহণ, মতামত প্রদান, খেলাধুলা ও আনন্দময় কাজে অংশগ্রহণের সুযোগের কথা জোর দিয়ে বলা হয়েছে।
শাস্তি দানের মনোবৈজ্ঞানিক ভিত্তি:
আধুনিককালের শিক্ষাবিদগণ প্রাচীন প্রথা শাস্তিদান নীতির সমালোচনা করলেও শিক্ষা ক্ষেত্রে তার প্রয়োজনীয়তা কে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করতে পারেননি। সাধারণভাবে সকলে না হলেও তাদের মধ্যে অনেকে ই শাস্তিদান প্রথা র সমর্থনে, বিখ্যাত মনোবিদ থনডাইকের ফল লাভের সূত্রটি উল্লেখ করেন। থনডাইক তার শিখনের এই সূত্রে বলেছেন, কোন কাজের ফল যদি শিক্ষার্থীর কাছে আনন্দদায়ক হয়, তবে সে কাজ করার প্রবণতা চিরস্থায়ী হয়। অন্যদিকে কাজের ফল যদি শিক্ষার্থী দের কাছে বেদনাদায়ক হয়, তবে পরবর্তীকালে ওই কাজ করার প্রবণতা শক্তি হাস পায়।থনডাইকের এই সূত্রের শেষ অংশটি উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে এই সকল শিক্ষাবিদগণ শাস্তিদান প্রথার সমর্থন করলেন। তারা এই মনোবৈজ্ঞানিক সূত্রের তাৎপর্য ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন শিক্ষার্থী কোনো অবাঞ্ছিত আচরণ সম্পাদন করলে অথবা সঠিকভাবে পাঠাভ্যাস করতে ব্যর্থ হলে তাকে যদি শাস্তি প্রদান করা যায় সে ক্ষেত্রে তার যে বেদনাদায়ক অনুভূতি হয় তা তাকে অনুরূপ আচরণ পুনরাবৃত্তিতে বাধা দেয়। অর্থাৎ এই সকল শিক্ষাবিদগণ এর মতে শিক্ষা ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য এবং শিক্ষার কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য শাস্তিদান মনোবিজ্ঞান সম্মত। এই সকল শিক্ষাবিদগণ শিক্ষাদানের প্রথাকে সমর্থন করলেও দৈহিক নির্যাতনমূলক শাস্তিদানের বিরুদ্ধে। তারা মনে করতেন দৈহিকশাস্তি শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিহিংসার মনোভাব জাগ্রত করে।তারা মনে করেন শিক্ষক যখন শিক্ষার্থীদের দৈহিকভাবে নির্যাতন করেন তখন শিক্ষার্থীদের মনে যুযুৎসা প্রবৃত্তি সক্রিয় হয়ে ওঠে।এই কারণে তারা যেকোন সময়ে প্রতিবাদস্বরূপ শিক্ষকের প্রতি অনুরূপ আচরণ করতে পারে।আধুনিক শিক্ষাবিদগণ দৈহিক শাস্তির পরিবর্তে মানসিক শাস্তি দানের প্রথা প্রবর্তন করার পরামর্শ দিয়েছেন।শিক্ষার্থী কোন অবাঞ্ছিত আচরণ সম্পাদন করলে তাকে দৈহিক নির্যাতন না করে শিক্ষক যদি তাকে তার স্নেহ থেকে সাময়িকভাবে বঞ্চিত করেন তাহলে যে মানসিক পীড়ন হয়, সেই অবস্থা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সে তার আচরণকে সংশোধন করতে পারে। এই ধরনের শাস্তি মূলক ব্যবস্থা মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আচরণ অভিমুখী প্রেষনা(Motive) সঞ্চার করা যায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর রাশিয়ার চিঠিতে এই জাতীয় শাস্তি প্রদানের নীতি কে বিশেষভাবে সমর্থন করে বলেছেন-” কাউকে অপরাধী করারই শাস্তি, তার চেয়ে শাস্তি আর নাই”
শাস্তিদানের অপকারিতা:
এক, যে-কোনো ধরনের শাস্তি শিক্ষার্থীর মনে আত্মগ্লানিবোধ সৃষ্টি করে এবং যার ফলস্বরূপ শিক্ষার্থীর ব্যক্তিসত্তার সুষম বিকাশ ঘটে না. সে ভীরু প্রকৃতির প্রতি দুর্বলচিত্ত হয়ে পড়ে।
দুই, অনেক ক্ষেত্রে শাস্তি মূলক ব্যবস্থার সঙ্গে অনুবর্তনের ফলে শিক্ষার্থীর বিশেষ বিশেষ পাঠ্যবিষয়ের প্রতি অনাগ্রহ এবং অনগ্রসরতা দেখা যায়।
তিন, শাস্তির দরুণ শিক্ষার্থীর মনে অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষক এবং শিক্ষালয় উভয়ের প্রতি স্থায়ী ঋণাত্মক মনোভাব গড়ে ওঠে।এই ধরনের মানসিকতা সুস্থ শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক স্থাপনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এবং তার ফলে সম্পূর্ন শিক্ষা পরিবেশ ই নষ্ট হয়ে যায়।
চার, শিক্ষাবিদ P.T. Marique বলেছেন শৃঙ্খলাজাত ভয়, শিক্ষার্থীকে তার বৌদ্ধিক কাজে স্থায়ীভাবে সহায়তা করতে পারে না। শাস্তির দরুন যেটুকু বৌদ্ধিক অগ্রগতি শিক্ষার্থীর মধ্যে লক্ষ্য করা যায় তা সাময়িক এবং নগণ্য বলা যায়।
পাঁচ, শিক্ষালয় শাস্তিদানের ফলস্বরুপ কোনো কোনো শিক্ষার্থীর মধ্যে পালায়নই মনোবৃত্তি তীব্র আকার ধারণ করে।
ছয়, শিক্ষার্থীর দৈহিক নির্যাতনমূলক শাস্তি প্রদানের ফলস্বরূপ তাদের অনেক ক্ষেত্রেই অঙ্গহানি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বর্তমান শিক্ষায় শাস্তির ধারনা :
আধুনিক শিক্ষানীতিতে শাস্তিদান প্রথাকে আদর্শগত দিক থেকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না আধুনিক শিক্ষায় উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে পরিপূর্ণ ভাবে বিকশিত হয়ে উঠতে সহায়তা করা। সুতরাং ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশের উদ্দেশ্যে যে শিক্ষাপরিকল্পনা রচিত সেই শিক্ষাব্যবস্থার শাস্তিদানের মতো ব্যক্তিসত্তা সংহারকারী কোনো কৌশলই গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত নয়।কিন্তু মানুষের যে-কোনো কর্মপ্রয়াসে, তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক প্রয়োগের মধ্যে সবসময় কিছু পার্থক্য থাকে। তাত্ত্বিক সিদ্ধান্ত যেখানে মূলত আদর্শমানের (Ideal) উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। প্রায়োগিক সিদ্ধান্ত সেখানে বাস্তব ভিত্তিতে গ্রহণ করা হয়। তাই বাস্তব অবস্থার বিচারে শিক্ষাবিদগণ বলেন শাস্তিদান প্রথার যদিও যথেষ্ট অপকারিতা আছে, তবুও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে পঠন-পাঠনের পরিবেশ রচনা জন্য অনেক ক্ষেত্রে শাস্তিদানের প্রয়োজন আছে। তারা তাই এই প্রথাকে শিক্ষা ক্ষেত্রে এক প্রকারের প্রয়োজনীয় কুপ্রথা(Necessary evil) হিসাবে বর্ণনা করে থাকে। যায় হোক আধুনিক শিক্ষামনোবিজ্ঞানীদের মতে, ভয়ভীতি বা শাস্তি তা যেভাবেই হোক না কেন- তা শিশুর ক্ষেত্রে শাস্তির প্রভাবটা যতটা না শারীরিক তার থেকে অনেকগুণ বেশি মানসিক, যা শিশুর ওপর দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
![](https://eidin.in/wp-content/uploads/2020/12/IMG-20201218-WA0001-1.jpg)
আধুনিককালে শিশুদের দেখা হচ্ছে অফুরন্ত সম্ভাবনাময় মানবসত্তা হিসেবে। শিশুর শিক্ষার জন্য প্রয়োজন সহায়ক পরিবেশ, আদর-ভালোবাসা ও খেলার মাধ্যমেই শেখার উপযোগী আনন্দময় বিদ্যালয়, যেখানে শিশু ভয়ভীতিমুক্ত আনন্দময় পরিবেশে শেখার সুযোগ পাবে।
শিশুদের সম্পর্কে কম জানা ও প্রয়োজনীয় প্রেষণার অভাবে শিক্ষকরা শাস্তি প্রয়োগ করেন, যা কোনোভাবে কাম্য নয়। এছাড়া, প্রচলিত ও পুরনো ধারণা, অঙ্গীকার ও জ্ঞানের অভাবে অনেকে শাস্তির আশ্রয় নেন। শিক্ষা হলো পারস্পরিক ক্রিয়ামূলক একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা মিলে একটি আনন্দময় পদ্ধতিতে তা অনুশীলন করে থাকে। এখানে শিশুরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পাবে। আর এ জন্য ভীতিমুক্ত, আদর-ভালোবাসা ও খেলার মাধ্যমেই শিশুর আনন্দময় পরিবেশ সৃষ্টিতে সঠিক সহায়তা করা অনস্বীকার্য।
বর্তমানে শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ এবং প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় খেলার মাধ্যমে শেখা ধারণাটি বিভিন্ন গবেষণার দ্বারা জোরালোভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিজ্ঞানী লেভ ভাইগোটস্কি (Lev Vygotsky) খেলাকে শিশুর সামাজিক, আবেগিক শারীরিক ও ভাষাভিত্তিক বিকাশের প্রতিনিধিত্বমূলক কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। মনোবিজ্ঞানী ডেভিড এলকিন্ড( David Elkind) বলেছেন, খেলা শুধু সৃজনশীল শক্তি না, এটা শেখার মৌলিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
শিশুরা যখন খেলা করে, তখন তারা বিভিন্ন বিষয় আবিষ্কার, অনুসন্ধান, নতুন চিন্তার উন্নয়ন ও তাদের শিক্ষার বিভিন্ন দিক প্রসারিত করার সুযোগ পায়।
![](https://eidin.in/wp-content/uploads/2020/12/IMG_20201218_141319_copy_304x382-1.jpg)
শিশুরা খেলার মাধ্যমে, পারস্পরিক মতবিনিময়, পরিকল্পনা করা, সমস্যা সমাধান, নতুন কিছু সৃষ্টি করা ও বাস্তব জীবনের অনেক দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পায়। বিশিষ্ট শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. ফ্রেজার মাস্টার্ডের (Dr. Fraser Mustard ) মতে, খেলা শিশুর জ্ঞান বৃদ্ধি করে, কল্পনাশক্তিকে প্রসারিত করে, সৃজনশীল চিন্তাকে প্রসারিত করে, সমস্যা সমাধান, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি হনও শিক্ষার প্রতি ইতিবাচক ধারণা তৈরিতে সহায়তা করে ।।