প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,২৫ জুলাই : জালিয়াতদের খপ্পরে পড়ে মোটা টাকা খোয়ানোর ঘটনা হামেশাই শোনা যায় । এছাড়াও পরীক্ষায় জালিয়াতি,নির্বাচনে জালিয়াতি এসব অভিযোগ তো রয়েইছে । তবে এই সব কিছুকেই এবার যেন ছাপিয়ে গেল ’গাড়ি জালিয়াতি’ (Car fraud) কাণ্ড। তাও আবার যে সে গাড়ি নয়,একেবারে খোদ সরকারী ড্রাইভার দ্বারা চালিত ’Government Of West Bengal’ লেখা গাড়ি। যা প্রকাশ্যে আসতেই তুমুল শোরগোল পড়ে গিয়েছে পূর্ব বর্ধমান জেলার প্রশাসনিক মহলে। প্রতিবাদে স্বোচ্চার হয়েছে বিরোধী নেতৃত্ব। জেলা বিজেপির সহ-সভাপতি মৃত্যুঞ্জয় চন্দ্র এবং সিপিএমের জেলা নেত্রী ভারতী ঘোষাল এই ’গাড়ি জালিয়াতি’ কাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও দোষীদের শাস্তির দাবি করেছেন।
দুধ সাদা রঙের যে চারচাকা গাড়িটি নিয়ে এত হইচই,সেই গাড়িটির রক্ষাকর্তা বিধাতা হল পূর্ব বর্ধমানের ’জামালপুর ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিস’। গাড়িটির সামনে ও পিছনে লাগানো রয়েছে নম্বার প্লেট।সেই নম্বার প্লেট অনুযায়ী ‘বোলেরো মডেল’ রূপী গাড়িটির নম্বার W G J 2585।পাশাপাশি গাড়িটির ’বডির’ সামনের দুই জায়গায় এবং পিছনের ’দরজার কাঁচের’ উপরে লাল রঙের বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে ‘Government Of West Bengal’। গাড়িটির অঙ্গসজ্জা দেখে বোঝারই উপায় নেই যে গাড়িটির সর্বাংশ জালিয়াতিতে ভরা ।
গাড়িটি জামালপুর বিডিও অফিসে গেলেই দেখতে পাওয়া যায় ।ওই গাড়িটির চালকের আসন বছরের পর বছর ধরে আলংকৃত করে আসছেন সরকারী ড্রাইভার অনিল মুর্মু। বিডিও অফিসের সরকারী আমলারা ’সরকারি তেল খরচে’ চলা ওই গাড়িতে চেপেই প্রশাসনিক কাজ মেটাতে বের হন।এছাড়াও জেলা শাসকের অফিস,মহকুমা শাসকের অফিসসহ জেলার বিভিন্ন সরকারী দপ্তরে যাতায়াতের ক্ষেত্রেও ওই গাড়িটি ব্লকের আমলাদের ভরসা। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় নির্বাচনী কাজে নিযুক্ত সরকারী আমলারা ওই গাড়িটিকে পুরোমাত্রায় ব্যবহারও করেন । সেই সময় গাড়িটির ’জাল জোচ্চুরির’ বিষয়টি কেন্দ্রীয় বাহিনীর এক বিচক্ষণ জওয়ানের নজরে আসে। তার থেকেই গাড়িটি চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ।
ভোট পরবর্তিতে এনিয়ে জামালপুর বিডিও অফিসের অন্দরমহলে খোঁজখবর চালিয়ে জানা যায়,একদা জামালপুর বিডিও অফিসের জন্য বরাদ্দ ছিল ২ টি ’জিপ’ গাড়ি ।তার মধ্যে একটি জিপ গাড়ি বিকল হয়ে যাওয়ার কারণে অনেকদিন আগেই সেটিকে ’কাটাইয়ে’ পাঠিয়ে দেওয়া হয় । ওই জিপ গাড়িটির পরিচিতি এখন শুধুমাত্র বিডিও অফিসের পুরানো নথিতেই রয়ে আছে। অপর বিকল ১টি জিপ গাড়ি এখনও বিডিও অফিসের গ্যারেজ ঘরে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।সেই গাড়িটিতে এখনও WGJ 3135 লেখা নম্বার প্লেট লাগানো রয়েছে।এই নম্বারের গাড়িটি দীনবন্ধু দে নামে বিডিও অফিসেরই সরকারী ড্রাইভার চালাতেন।অবসর গ্রহনের পর কয়েক বছর আগে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। জামালপুর বিডিও অফিসে এখন একজনই সরকারী ড্রাইভার রয়েছেন। তিনি হলেন অনিল মুর্মু ।তিনি W G J 2585 ,এই নম্বার প্লেট লাগানো থাকা গাড়িটি চালান ।
জাল জোচ্চুরির যাবতীয় রহস্যের কেন্দ্রবিন্দুতে এখন W G J 2585 গাড়িটি। এনিয়ে বিস্তর খোঁজ খবর চালিয়ে জানা যায়,’জাল জোচ্চুরির’ যাবতীয় রহস্য গাড়িটির ’নম্বার প্লেট ’ এবং গাড়ির ‘মডেলে’ লুকিয়ে আছে।সেই রহস্যের কিনারা করা গেলে জানা যায়, ‘গাড়িটিতে লাগানো থাকা নম্বার প্লেটে উল্লিখিত নম্বরটি আসলে হল ’জিপ গাড়ির’ নম্বর । কিন্তু,বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে বর্ধমান জেলা ভাগের আগে সরকারী অর্থ খরচ করে ওই জিপ গাড়িটির রুপ বদলে দিয়ে সেটিকে ’বোলেরো গাড়ির’ রুপ দেওয়া হয়েছে‘ ।এমনটা করার জন্য W G J 2585 ,নম্বরের জিপ গাড়িটি তার নিজস্ব ’ইঞ্জিন ও ’চেসিস নম্বার’ সহ সবই খুইয়ে ফেলেছে। এমন গাড়ির জন্যে পেট্রোল না ডিজেল ,কোন তেলের খরচ সরকারী ভাবে তোলা হয় সেই প্রশ্নও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
সব সত্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর W G J 2585 নম্বরের গাড়িটির সরকারী ড্রাইভার অনিল মুর্মু অবশ্য আর সত্য ধামাচাপা দিতে পারেননি। তাঁকে ফোন করে গাড়িটির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ,WGJ 2585 নম্বরের গাড়িটি আসলে জিপ গাড়ি।জেলার আউশগ্রাম-১ ব্লক প্রশাসনের কাছে আবেদন করে গাড়িটি সেখান থেকে জামালপুর বিডিও অফিসে আনা হয়েছিল।তার পর ওই জিপ গাড়িটি গ্যারেজে পাঠিয়ে তার ইঞ্জিন,চ্যাসিস সহ অনেক কিছু বদলে দিয়ে গাড়িটিকে ডিজেল চালিত ’বোলেরো’ গাড়ির মডেলে করানো হয়। তবে গাড়ির মডেল চেঞ্জ করা হলেও গাড়িতে জিপ গাড়িটারই নম্বার প্লেট লাগানো হয় ।: কিন্তু যে গাড়িকে সরকারী খরচে এত অভিনব রুপ দেওয়া হল,সেই গাড়ির কোন তথ্য পরবিহন দপ্তরের ওয়েবসাইটে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? পরিবহন দপ্তরকে কি গাড়িটির বিষয়ে অন্ধকারে রাখা হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরে অনিল মুর্মু বলেন,’গাড়িটির ইঞ্জিন ,চ্যাসিস এবং মডেল বদলে দেওয়া হয়েছে বলেই হয়তো পরিবহন দপ্তরের ওয়েবসাইটে গাড়িটির তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না! এই বিষয়ে প্রতিক্রিয়া পাওয়ার জন্য বিডিও (জামালপুর ) পার্থসারথি দে কে ফোন করা হলেও তিনি বলেন,’আমি ব্লকের দায়িত্ব নেওয়ার আগে থেকেই গাড়িটি চলছে । গড়িটির বিষয়ে আমি সবিস্তার খোঁজ খবর নেব ।’
তবে এমন গাড়ি জালজোচ্চুরি কাণ্ড জেনে স্তম্ভিত আইনজ্ঞরা। তাঁদের কথায়,’এটা সম্পূর্ণ বেআইনি ও জালিয়াতির কাজ হয়েছে।দেশের নতুন পরিবহন আইন অনুযায়ী এমন কাজের জন্য কড়া শাস্তির বিধান রয়েছে। এমন গাড়ির দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে মৃতের পরিজনের ’এক্সিডেন্টাল বেনিফিট’ পাওয়াও দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে।’ আর আঞ্চলিক পরিবহন আধিকারিক (পূর্ব বর্ধমান) গোবিন্দ নন্দি’র কছে WGJ 2585 নম্বারে গাড়ির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন,’এই নম্বারের গাড়ির কোন অস্তিত্ব’ই পরিবহন দপ্তরের নথিতে নেই।এমন নম্বরের গাড়ি রোডে চলতে পারে না।খোঁজ খবর নিয়ে দেখছি। যদি কেউ এমন গাড়ি রোডে চালায় তবে আইনমাফিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে ।’।