প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১১ অক্টোবর : শারদোৎসবে সর্ব শক্তিরুপেন দেবী রুপেই পুজিতা হন দুর্গা।সর্বশক্তীমান এই নারীরুপের পুজোঘিরে আপামোর বাঙালির ভক্তিভাবের কোন খামতি থাকেনা । তবুও দুর্গপুজোয় পর্দানসীন থাকতে হয় পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের চকদিঘির সিংহরায় জমিদার বাড়ির মহিলাদের ।একদা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সাহচর্য্য পাওয়া এই জমিদার পরিবারে মহিলাদের আজও শুধুমাত্র আভিজাত্য বজায় রাখতেই এমন ভবিতব্য মেনেনিয়েই চলতে হচ্ছে ।
ইংরাজ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্ব কালে এই বাংলায় জমিদারি ব্যবস্থার পত্তন হয় । সেই সমসাময়িক কালের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে জামালপুরের চকদিঘির জমিদারদের নামও । দেশ স্বাধীন হবার পর জমিদারি প্রথা বিলিন হয়েগেলেও প্রায় ৩৭০ বছর ধরে চকদিঘির বাগান বাটি সেই জমিদারি ঐতিহ্যের স্বাক্ষ বহন করে চলেছে । একশো বিঘা জমি জুড়ে রয়েছে জমিদারদের বাগান বাটি । যার কোনায় কোনায় ছড়িয়ে রয়েছে জমিদারি রাজত্বের নানা নিদর্শন । ঐতিহ্য পরম্পরা মেনে এই বাগানবাটির সুবিশাল মন্দিরে ২৮৪ বছর ধরে পুজিত হয়ে আসছেন দেবী দুর্গা । একসময়ে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় দুর্গা পজোয় এসে থাকতেন এই বাগান বাটিতে । কিংবদন্তি চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ তার সিনেমার সুটিং এরজন্য এই বাগান বাটিকেই বেছে নিয়েছিলেন ।জমিদারি রাজত্ব আর নেই ।তবে জমিদারি আভিজাত্যের গড়িমা অটুট রেখেছেন চকদিঘীর জমিদার সারদপ্রসাদ সিংহরায়ের উত্তরশুরিরা ।
চকদিঘির জমিদারদের পূর্ব পুরুষরা ছিলেন রাজপুত ক্ষত্রিয় । ইতিহাস প্রসিদ্ধ বুন্দেলখণ্ডের শাসকদের বংশধররা এখানে জমিদারি চালাতেন । দুর্গাচরণ রায় লিখিত “দেবগণের মর্ত্যে আগমন ” নামক গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে চকদিঘির জমিদারদের কথা । তা থেকে জানাযায় রাজস্থান থেকে চকদিঘিতে সর্বপ্রথম এসে ছাঁউনি ফেলেছিলেন নল সিং । সেখানেই তিনি বসবাস শুরু করেছিলেন । পরবর্তী কালে জমিদারি সত্ব লাভের পর নল সিং অগাধ ঐশ্বর্য্য ও খ্যাতি লাভে সমর্থ হন ।কথিত আছে এই জমিদারি তিনি লাভকরেছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছথেকে । দামোদরের পূর্ব তীরের শুড়া মৌজাস্থিত হাজামজা জলাশয় ও দিঘি বিশিষ্ঠ নিস্কর জমিদারি স্থানটি পরবর্তিকলে পরিচিতি পায় চকদিঘি নামে । এই জমিদার বংশের খ্যাতি শীর্ষে পৌছেছিল সারদাপ্রসাদ সিংহরায়ের হাত ধরে । প্রজাবৎসল জমিদার সারদাপ্রসাদ তার জমিদারি এলাকার প্রভুত উন্নতি সাধনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন । শিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি চকদিঘিতে তৈরি করেছিলেন বিদ্যালয় । যে বিদ্যালয়ের উদ্বোধন করেছিলেন স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় । এছাড়াও চকদিঘি হাসপাতাল এবং আজকের মেমারি চকদিঘি সড়কপথ সবই তৈরি হয়ছিল সারদাপ্রসাদ সিংহরায়ের একান্ত উদ্যোগে । জমিদার হয়েও ভোগবিলাসকে তুচ্ছকরে তিনি জনসেবা মূলক কাজে নিজেকে নিয়জিত করেছিলেন । প্রজারা একন্তভাবেই ছিলেন সারদাপ্রসাদ সিংহরায়ের গুনমুগ্ধ । জমিদার বংশের পরবর্তি প্রজন্ম লোলিতমোহন সিংহরায় , লীলামোহন সিংহরায় প্রমুখরা সারদাপ্রসাদ সিংহরায়ের পথ অনুসরন করে জমিদারি চালিয়েছিলেন । বর্তমান বংশধর অম্বরিশ সিংহরায় একই ভাবে পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্য বজায় রেখে চলেছেন ।
জমিদারদের বাগান বড়ির জন্য চকদিঘির নামডাক । বাগান বাটি জুড়ে আছে বড় বড় অট্টালিকা, কাছারি বাড়ি,অন্দর বাড়ি ,একাধিক দিঘি ও গোমস্তাখানা । জমিদার পরিবারের অত্যন্ত কাছের মানুষ ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর । এই বাগান বাটিতেই বিদ্যাসাগর মহাশয়ের থাকার জন্য একটি জলাশয়ের ধারে তৈরি হয়েছিল হাওয়াখানা ঘর । যে ঘরটির পরিচিত হাওয়া মহল নামেই । জমিদারি আমলে বাগান বাটিতে তৈরি হওয়া হাঁতি শাল ও ঘোড়া শালের অস্তিত্ব এখন বিলিন হতে বসেছে ।
বাগান বাটির ভিতর কাছাড়ি বাড়ির সামনেই রয়েছে দুর্গা পুজোর স্থায়ী মন্দির । মন্দিরের সঙ্গেই রয়েছে টিনের ছাউনি দেওয়া বিশাল আকার বসার জায়গা । জমিদার বাড়ির কেয়ারটেকার সুশান্ত দত্ত জানিয়েছেন ,এই জমিদার পরিবারের অপর দুর্গা মন্দিরটি রয়ছে চকদিঘি থেকে প্রায় তিন কিমি দূরে মণিরামবাটি গ্রামে । সেখানকার মন্দিরটিও একই আদলে তৈরি । সেখানেও জমিদারি ঐতিহ্য মেনে পুজোর যাবতীয় আয়োজন করা হয় । পঞ্জিকার সময় সারনি মেনে একই সময়ে দুই ঠাকুর মন্দিরে হয় পুজো । ব্যবসা ও কর্মসূত্রে সিংহরায় পরিবারের বর্তমান সদস্যরা বছরের বাকি দিনগুলিতে কলকাতা ও অন্যত্র কাটান । তবে পুজোর কটাদিন গোটা পরিবার একত্রিত হন চকদিঘির বাগান বাটিতে ।
বৈদিক মতে হয় সিংহরায় জমিদার বড়ির দুর্গা পুজোর আরাধনা ।একচালার কাঠামোয় ডাকের সাজে প্রতিমা সাজানো হয় । দেবী মূর্তির দুপাশে বসানো থাকে জয়া ও বীজয়া নামে দুই পরির মূর্তি । মন্দিরচত্ত্বর সাজানো হয় এক ভিন্ন আঙ্গিকে । একটি গোটা নারকেল , আম্র পল্লব ও একটি কাঁঠালি কলা একসাথে নিয়ে বাঁধা থাকে মন্দির চত্ত্বরের প্রতিটি থামে । প্রতিপদের দিনথেকে শুরু হয় পুজো। পঞ্জিকার নির্ঘন্ট মেনে পুজো করেন হুগলীর লোকনাথ এলাকা নিবসী কুলো পুরোহিত ভোলানাথ চতুর্বেদি । পুজোয় অন্যন ফল যাই থাক কাজু , কিসমিস , পেস্তা , আখরোট ও মেওয়া ফল চাই । নৈবেদ্য সাজানো হয় চিনির সন্দেশ , ছোট ও বড় মুণ্ডি , ডোনা , নবাত , রশকরা, মুড়কি প্রভৃতি দিয়ে । পারিবারিক নিয়ম মেনে স্থল পদ্মে হয় দেবীর পুজো । একমাত্র সন্ধীপুজোয় লাগে ১০৮ টি জল পদ্ম । সন্ধী পুজোর সময় দুটি মন্দিরের দেবী প্রতিমার সামনে ব্রাহ্মন পরিবারের বিধবা মহিলাকে দিয়ে ধুনো পোড়ান হয় । পুজোর প্রতিটি দিন দেবীর কাছে নিবেদন করা হয় হরেক রকম নিরামিশ ভোগ । মহাষ্টমির দিন থেকে পুজোর নৈবেদ্যে দেওয়া হয় মাখা সন্দেশ । পূর্বে ছাগ বলিদান প্রথা থাকলেও বেশকয়েক বছর হল বলিদান বন্ধ করেদেওয়া হয়েছে । পরিবর্তে এখন সন্দেশ নিবেদন করা হয় । নবমির দিন একই সময়ে চকদিঘি ও মণিরামবাটির মন্দিরে কুমারী পুজো অনুষ্ঠিত হয় । জমিদার বাড়ির পুজোর জোগাড়ে মহিলাদের অংশগ্রহন নিষিদ্ধ । সবকিছুই করেন জমিদার বংশের পুরুষরা । সবথেকে আশ্চর্য্যের বিষয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যাতায়াত যে বাড়িতে ছিল সেই সিংহরার পরিবারের মহিলারা এখনও পুজোয় পর্দানশিন থাকেন । জমিদার পরিবারের বর্তমান বংশধর অম্বরিশ সিংহরায় জানিয়েছেন , “অন্দর মহল থেকে পরিবারের মহিলারা মন্দিরে পুজোদিতে কিংবা ঠাকুর দেখতে আসার সময় তাদের পথের দুপাশ আড়াল করার জন্য কাপড়দিয়ে ‘কানাত’ টাঙানো হয় । এর কারণ প্রসঙ্গে অম্বরিশ বাবু বলেন , পারিবারিক প্রথা মেনে পুজোর সময় আমাদের বাড়ির বউরা পর্দার পেছনে থাকেন । বংশ পরম্পরয়ায় এই ঐতিহ্য মেনে আসা হচ্ছে । জমিদার বাড়ির বউদের মুখ অন্য কেউ যাতে দেখতে না পায় তাই এই ব্যবস্থা তৈরি রাখা থাকে বলে পরিবার সদস্যদের কথায় জানিয়েছেন । আগে পুজোয় বাগানবাটিতে হত যাত্রা পালা । এখন সেসব পাঠ উঠেগেছে । প্রথামেনে একাদশিতে কাঙ্গালী বিদায় পর্ব শেষে পুজোর সমাপ্তি ঘটে জমিদার বাড়িতে ।
পুজোর কটাদিন বাগান বাটির ভিতরে সর্বসাধারনের প্রবেশাধিকার থাকে । তাই পুজোর দিনগুলিতে জমিদারি নিদর্শন পরিদর্শনে আসা মনুষজনের ভিড় উপচে পড়ে চকদিঘির এই বাগানবাটিতে ।
চকদিঘি বাগান বাটির পরিবেশ মুগ্ধ করেছিল প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় মহাশয় কে । তার পরিচালিত ‘ঘরে বাইরে’ সিনেমার প্রায় পুরোটারই শুটিং হয়ছিল এই বাগান বাটিতেই। ছবিটি মুক্তি পাবার পর চকদিঘি জমিদার বাড়ির পরিচিতি দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে । পরবর্তি সময়ে সুবিশাল এই বাগান বাটিতে আরো বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের শুটিং হয় ।।