এইদিন আন্তর্জাতিক ডেস্ক,১৬ নভেম্বর : সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও অপরাধ প্রবণতার কারনে বাংলাদেশিদের ভিসা দিচ্ছে না কোনো দেশ । ফলে ভিন দেশে পড়াশোনার করার সুযোগও হারাচ্ছে বাংলাদেশি পড়ুয়ারা । অথচ ভারতের পর্যটন ভিসা ছাড়া কার্যত কোনো দেশ থেকেই বাংলাদেশের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা নেই । কিন্তু কোনো দেশই আর বাংলাদেশিদের বিশ্বাস করতে চাইছে না ।
এতদিন ভিয়েতনাম কিংবা ইসলামি রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ার মতো যে দেশগুলো থেকে সহজেই ভিসা পেয়ে যেত বাংলাদেশিরা । এখন তারাও অনেক ক্ষেত্রে ভিসা দিচ্ছে না বলে । বিশ্লেষকরা বলছেন, ভিসার অপব্যবহার করে একদেশ থেকে অন্যদেশে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। ফলে কমেছে বিশ্বাসযোগ্যতা। এছাড়াও দেশের বাইরে সন্ত্রাসী ও অপরাধ মূলক কর্মকাণ্ডের জড়ানোয় বাংলাদেশকে এখন সন্দেহের চোখে দেখছে সব দেশ । যেকারণে পাসপোর্টের র্যাংকিংয়ে একেবারে নিচে নেমে এসেছে বাংলাদেশ ।
বিশ্লেষকদের কথায়,এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সবার আগে বাংলাদেশিদের নিজেদের শোধরাতে হবে । যদিও মহম্মদ ইউনূসের জমানায় সেটা কার্যত অসম্ভব বলে মনে করছেন তারা । কারন বর্তমান বাংলাদেশ এখন সন্ত্রাসীদের মুক্তাঞ্চল হয়ে গেছে । ফলে নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা না থাকার পরও বাংলাদেশিদের ভিসা দিচ্ছে না বেশ কয়েকটি দেশ। বিদেশে পড়তে, কাজ করতে কিংবা বেড়াতে যেতে আগ্রহীদের অনেকেই জানিয়েছেন এমন অভিযোগ। একই সমস্যার কথা জানিয়ে পর্যটন খাত সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, দেশগুলো ভ্রমণসহ অনেক ধরনের ভিসা দিচ্ছে না ।
ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ –টোয়াব-এর সভাপতি মহম্মদ রাফেউজ্জামান বলেন, ‘ইন্ডিয়া, ইউএই, কাতার, বাহরাইন, ওমান, উজবেকিস্তান, সৌদি আরব, ভিয়েতনাম- এই সব দেশ আমাদের ভিসা দিচ্ছে না। তিনি বলেন, শুধু তাই নয়, থাইল্যান্ডের ভিসা অনেক বেশি সময় নেয়। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার ভিসার রেশিও কম। ফিলিপাইন অনেক বেশি সময় নেয়। ইন্দোনেশিয়ার ভিসা ফি অনেক। এমনকি অ্যারাইভাল ভিসা দেওয়া শ্রীলঙ্কার ইলেক্ট্রনিক ভিসা হতেও সময় নিচ্ছে দুই-তিন দিন।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশে কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে ইসলামি জিহাদের অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর টালমাটাল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশিদের জন্য পর্যটন ভিসা বন্ধ করে দেয় ভারত। ভারতের এই সিদ্ধান্তকে অনেকটা রাজনৈতিক হিসেবে দেখা হলেও ঘোষণা ছাড়াই ইউরোপ, অ্যামেরিকাসহ এশিয়ার অনেক দেশ থেকে সব ধরনের ভিসা পাওয়াই কঠিন হয়ে উঠেছে বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। পর্যটন ব্যবসায়ীরা বলছেন, এতগুলো দেশের ভিসা নিয়ে এমন জটিলতা খুব বেশিদিনের না। এ নিয়ে ঢাকার পর্যটন ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন সেলিম জানান, যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছরই বাংলাদেশিদের জন্য পাঁচ থেকে ছয় লাখ ভি-১, ভি-২ ভিসা দিয়ে থাকে। কিন্তু চলতি বছর দেশটির দূতাবাস মনে হয় না দুই লাখের বেশি ভিসা দিয়েছে।
তিনি জানান, ইউএসএ,অস্ট্রেলিয়া বলেন বা কানাডা, কিন্তু ২০২৩-২৪ সালে আমাদের অনেক ভিসা দিয়েছে- পাসপোর্টের মেয়াদ যতদিন, ততদিন পর্যন্ত দিয়েছে। কিন্তু এবছর কিন্তু কোনো ভিসা দিচ্ছে না।
কিন্তু কেন ভিসা দিচ্ছে না বাংলাদেশিদের?
ভিসা জটিলতার কারণ হিসেবে অনেকেই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে কারণ হিসেবে মনে করলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, এর মূল আরও গভীরে। তাদের মতে, অনিয়মিত পথে বাংলাদেশিদের বিভিন্ন দেশে ঢোকার প্রবণতা, আর তা করতে সহজলভ্য দেশের ভিসা নিয়ে অন্যদেশে পাড়ি জমানোর ঘটনা দেশগুলোর প্রশাসনের চোখে পড়েছে। এছাড়া ইসলামি রাষ্ট্র মালেশিয়ায় গিয়ে বাংলাদেশি ও পাকিস্তানিদের আইএসআইএস-এর মত কুখ্যাত সন্ত্রাসী সংগঠনের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার কাজ করার প্রমান পেয়েছে সেদেশের পুলিশ । বেশ কয়েকজন বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে ।
বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, ভিসা পাওয়ার সুযোগে বা এটাকে অপব্যবহার করে অনেকে কিন্তু অনিয়মিতভাবেও যাচ্ছে। সে প্রবণতার কারণেই আমার ধারণা যে দেশগুলোতে খুব বেশি অভিবাসনবিরোধী বাতাবরণ নেই সেই দেশগুলোও কিন্তু এখন সতর্ক হচ্ছে। যেমন ধরুন ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড। এমনকি কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ভ্রমণ ভিসায় বিদেশে লোক পাঠিয়ে শ্রমিক ভিসায় রূপান্তর করেন বলেও অভিযোগ আছে। আবার প্রতিবেশী দেশ থেকে বাংলাদেশের ওপর আরোপ করা ভিসা নিয়ন্ত্রণের কারণে ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু দেশ আরো বেশি সতর্কতা অবলম্বন করছে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ। যার কারণে অল্প সংখ্যক মানুষের অনিয়মিত বা আইন বহির্ভুত কাজে যুক্ত থাকার ফল অনেক বেশি সংখ্যক মানুষকে ভোগ করতে হচ্ছে বলে তিনি মনে করছেন ।
ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশি পাসপোর্টের র্যাংকিংয়ের বিষয়টিও আলোচনায় আসে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক নাগরিকত্ব ও পরিকল্পনা বিষয়ক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের তথ্যমতে, দুর্বলতম পাসপোর্টের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। বিশ্বের ৩৮টি দেশে ভিসা ছাড়াই ভ্রমণের সুযোগ আছে বাংলাদেশের নাগরিকদের। এই তালিকার বেশিরভাগ দেশই আফ্রিকা এবং ক্যারিবীয় অঞ্চলের, যেখানে বাংলাদেশিদের যাতায়াতের প্রবণতাও কম।
এছাড়াও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় অবৈধ অভিবাসনের সুযোগ খোঁজার প্রবণতা বেড়েছে।সমাধান
গত বছর ডিসেম্বরে ভারতের ভিসা সীমিত থাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর ভিসা সেন্টার দিল্লি থেকে অন্য দেশে সরাতে কূটনীতিকদের অনুরোধ জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনূস । তিন মাস পর মার্চ মাসে ঢাকা থেকেই নয়টি দেশের ভিসা প্রক্রিয়া শুরু হয়, কিন্তু সেই দেশগুলো থেকেও ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা যাচ্ছে। কয়েক মাস আগে সংবাদমাধ্যমে ভিসা জটিলতার কথা স্বীকার করে নেন বিদেশ বিষয়ক উপদেষ্টা। তিনি দায়ী করেন, বাংলাদেশিদের কর্মকাণ্ডকে।
কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সরকারকে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের ভ্রমণ ভিসার ক্ষেত্রে জটিলতার বিষয়টি পুরোপুরি রাজনৈতিক। সেক্ষেত্রে নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত পরিস্থিতি বদলানোর সুযোগ নেই। তবে ভারত ছাড়া অন্য দেশগুলোতে কূটনৈতিকভাবে উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ আছে। সেক্ষেত্রে অসৎ উপায়ে যারা দেশের বাইরে লোক পাঠাচ্ছেন কিংবা যারা যাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে বলে মনে করছেন প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির।তিনি বলেন, ডোমেস্টিক জায়গায় (দেশের ভেতরে) হাত দিয়ে সেখানে যথোপযুক্ত আইনি প্রক্রিয়ায় সমাধানের চেষ্টা করছি- এটা যদি দৃশ্যমান করতে পারি, তাহলে আমার ধারণা ভিসা প্রক্রিয়ার এই বাড়তি জটিলতা আমরা এই সাম্প্রতিককালে যা দেখছি সেটা থেকে হয়তো বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে। কিন্তু সন্ত্রাসবাদের বাড়বাড়ন্তের মাঝে কিভাবে এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব ? অবশ্য এর উত্তর তার কাছে নেই ।।
Author : Eidin.

