ভোলানাথ সেন হত্যা মামলা ১৯৩১ : হাওড়ার শ্যামপুর বাজার ব্যাবসায়ী সমিতি দুর্গাপূজা প্যান্ডেলে আগুন ও প্রতিমা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনার আসল কারন কি ? এই প্রশ্নের উত্তর অধিকাংশ রাজ্যবাসীর অজানা । পুজো কমিটির কর্মকর্তাকে পর্যন্ত একটা ভিডিও বিবৃতি জারি করে স্থানীয় মুসলমানদের কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে বলতে হয়েছে,’ভবিষ্যতে এই ভুল আর হবে না’ । কিন্তু কি ভুল করেছিল পুজো কমিটি ? যেটা জানা যাচ্ছে যে একটা ছবিকে কেন্দ্র করে হিংসার সূত্রপাত । হাওড়ার পুলিশ সুপার সংবাদ মাধ্যমকে সোমবার জানিয়েছেন,পুজো মণ্ডপে একটা ছবি টাঙানোর প্রতিবাদে এক সম্প্রদায়ের লোকজন বিদ্রোহ শুরু করেছিল । তারা এনিয়ে থানায় ডেপুটেশন দিতে আসে । তাদের অভিযোগ গ্রহণ করা হয়,মামলা হয়,গ্রেফতারও করা হয়৷ তারপরেও তাদের মধ্যে কিছু লোক পুলিশের উপর হামলা করে । পরে আমরা খবর পাই কোথাও কোথাও পুজো প্যান্ডলে ভাঙচুর হয় । সাংবাদিকদের পুলিশ সুপার জানান যে ২৫-৩০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে । এখন প্রশ্ন ছবিটি কার ? যেটা হাওড়ার শ্যামপুরের আক্রান্ত পুজো কমিটির কর্মকর্তাকে বলতে শোনা গেছে যে প্রতি বছর দুর্গাপূজার পঞ্চমীর দিন ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের নিয়ে বসে আঁকো প্রতিযোগিতা করা হয়ে থাকে৷ যথারীতি এবারও ওই প্রতিযোগিতা হয় । ওই সমস্ত শিশুদের আঁকা ছবি পুজো প্যান্ডেলে টাঙানো হয় । বিভিন্ন মনীষীদের আঁকা ছবি প্যান্ডেলের টাঙানো হয় । অন্যান্য মনীষীদের সঙ্গে এবারে ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ এর ছবি টাঙ্গানো হয়েছিল । কিন্তু ইসলামের নবীর ছবি আঁকা যে নিষিদ্ধ সেটা তারা জানতেন না বলে তিনি জানিয়েছেন ।
অর্থাৎ পুরো ঘটনাটা হয়েছে ইসলামের নবীর ছবি আঁকাকে কেন্দ্র করে । যে কারণে পূজা মন্ডপে হামলা এবং মূর্তি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটায় স্থানীয় মুসলিমরা । তবে ইসলামের নবীর ছবি আঁকাকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গে এই ধরনের ঘটনা এই প্রথম নয় । কলকাতার ‘বই বাজার’ বলে পরিচিত কলেজ স্ট্রিটে ১৯৩১ সালে নিজের দোকানে কর্মরত অবস্থায় দুই মুসলিম যুবকদের হাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছিলেন ভোলানাথ সেন নামে একজন লেখক,প্রকাশক সংস্থার মালিক তথা পাইকারি বই বিক্রেতা । খুন হন তার দুই বিশ্বস্ত কর্মচারী সতীশ আর হরিদাসও । সেই ঘটনায়
লোয়ার চিৎপুর রোডে মুসা শেঠ নামক এক ব্যক্তির ‘মুসাফিরখানা’ লজ থেকে অমৃতসরের বাসিন্দা আবদুল্লা খান নামে এক জিহাদিকে ধরে পুলিশ । তার আগে লাহোরের বাসিন্দা পেশায় কামার আমীর আহমেদ নামে আর এক জিহাদিকে রাস্তা থেকে ধরা হয় ।
কিন্তু সুদুর লাহোর ও অমৃতসর থেকে কলকাতায় এসে তারা একজন প্রকাশককে খুন করল কেন? যেটা জানা যায় যে খুনের আগের তিনদিন তারা রাত্রিবাস করেছিল লোয়ার চিৎপুর রোডের মুসা শেখের ওই মুসাফিরখানা লজে । পুলিশ তদন্তে নেমে প্রথমেই লজের সেই ঘর তল্লাশি করল। ঘর থেকে মিলল দুটো স্টিলের ট্রাঙ্ক। কী কী রয়েছে সেই ট্রাঙ্কে? উত্তর-পশ্চিম রেলওয়ের একজন কর্মচারীর পাস। যা দেখে পুলিশ বুঝতে পারল, আবদুল্লা খান রেলওয়ের কর্মচারী। উত্তর-পশ্চিম রেলওয়েতে সে ছুতোরমিস্ত্রীর কাজ করে। তার বাবার নাম মীরন বক্স। বাড়ি অমৃতসর। এছাড়া মিলল কিছু উর্দু বই, ৩রা মে, ১৯৩১ তারিখের লাহোরের একটি সংবাদপত্রের ছেঁড়া পাতা, ইংল্যান্ডের ইতিহাসের ওপর লেখা একটা বই এবং একখানা এয়ারগান।
তদন্তের দায়িত্ব বর্তায় ভারতীয় পুলিশের গোয়েন্দা শাখার ইনস্পেক্টর গুলাম হায়দারের ওপর । হত্যাকাণ্ডের পরের দিনের তিনি ট্রেনে রওনা দিলেন অমৃতসর। সেখানে গিয়ে খুঁজে বের করলেন আবদুল্লা খানের বাবা মীরন বক্সের বাড়ি। গুলাম হায়দার স্থানীয় কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে মিরন বক্সের বাড়ি তন্নতন্ন করে সার্চ করে ফেললেন। বাড়ির যে ঘরে আবদুল্লাহ থাকত, সেই ঘর থেকে বেশ কিছু চমকপ্রদ জিনিস উদ্ধার হল। যেগুলো গোটা তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দিল এক লহমায়। এক, সরদা বিল, ১৯২৯ সালের বিরুদ্ধে প্রচার হওয়া অসংখ্য প্যাম্ফলেট। আবদুল্লাহর বাবা মীরন বক্সকে গুলাম হায়দারকে সঙ্গে করে তিনি নিয়ে গেলেন সাহু গলিতে, যেখানে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে আবদুল্লাহ তার কাঠের কাজ করত। সেখান থেকেও মিলল একইধরনের কিছু জিনিসপত্র।অতিরিক্ত বলতে চোখে পড়ল, একটা বইয়ের কিছু ছেঁড়া পাতা। বইটা বাংলা ভাষায় লেখা, নাম প্রাচীন কাহিনী। লেখক ভোলানাথ সেন। গুলাম হায়দার জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার ছেলে কি বাংলা পড়তে জানত? মীরন বক্স অস্বীকৃতি জানায় । পরে রেল ওয়ার্কশপে আবদুল্লাহর ঠেকে হানা দেন ওই পুলিশ আধিকারিক । রেলের সেই ওয়ার্কশপে যাওয়ার পরেই প্রকাশকের হত্যাকাণ্ডের কারন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে উঠল তার কাছে।
আসলে শিশু কিশোরদের জন্য ভোলানাথবাবুর লেখা ‘প্রাচীন কাহিনী’ নামে একটা বই মেলে সেখানে । প্রকাশক ভোলানাথ সেন খুব সহজসরল প্রাঞ্জলভাবে ইতিহাসকে তুলে ধরতে পারতেন। তিনি চেয়েছিলেন, ধর্মের বাতাবরণে বন্দি না হয়ে মুক্তমনে ছেলেমেয়েদের সবকিছু বোঝাতে। প্রস্তর যুগ, বৈদিক যুগ হয়ে তাঁর বইতে একে একে এসেছিলেন যীশুখ্রিস্ট এবং হজরত মহম্মদ। দুজনকেই মানবতার পূজারি ও ঈশ্বরের দূত হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল সেখানে। বইয়ের ৯৬ পাতায় ছিল হজরত মহম্মদের ছবি । যদি মহম্মদের ছবিটি কোনো ভারতীয় শিল্পীর আঁকা নয়। ছবিটি এঁকেছিলেন পঞ্চদশ শতকের একজন তুর্কি শিল্পী।
ছবিটিতে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মহম্মদ বসে বাক্যালাপ করছেন হিব্রু বাইবেলে বর্ণীত দেবদূত গ্যাব্রিয়েলের সঙ্গে। দুজনেরই মুখে হাসি, চোখে প্রশান্তি। দুটি ধর্মের মধ্যে সহিষ্ণুতা ও সৌহার্দ্যতার ভাব এই ছবিকে অনন্য করে তুলেছিল। যে কারণে ছবিটিকে পরে মুসলিম ধর্মগ্রন্থ ‘কোরান’-এর অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি এডিশনে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং হিন্দু ও মুসলিম দুই ধরনের সদস্য থাকা ভারতীয় শিক্ষা কমিটি ছবিটিকে পাঠ্যপুস্তকে দেওয়ার অনুমতিও দেন । আর এই ছবি দেখেই ধর্মোন্মাদ আবদুল্লাহ, আমীররা তাদের নবীকে অপমান অর্থাৎ ধর্মনিন্দার অভিযোগ তুলে ওই বাঙালি প্রকাশককে হত্যার ছক কষে ৷
১৯৩১ সালের ৭ই মে সকালে কলেজ স্ট্রিটে ভোলানাথ সেনের দোকানে ক্রেতা হিসাবে যায় আরবি ধাঁচের পোশাক পরা দুই যুবক আবদুল্লা খান ও আমীর আহমেদ । কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগে তারা ঢিলেঢালা পোশাকের ভিতর থেকে দুটি ধারাল ছুরি বের করে । তারপর ‘আল্লা হু আকবর’ শ্লোগান দিয়ে একজন ভোলোনাথ সেনের বুকে ছুরি আমূল বসিয়ে দেয়। সতীশ আর হরিদাস মালিককে বাঁচাতে গেলে তাদেরও নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে দ্বিতীয় জিহাদি । মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তিনজনকে নির্মমভাবে হত্যার পরে তারা ছুটে পালিয়ে যায় । যদিও পরে পরে দু’জনেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায় ।
১৯৩১ সালের ৫ই জুন আমীর আহমেদ ও আবদুল্লাহ খানকে আদালতে তোলা হয় । ফাইল করা হল The Emperor of India VS Abdulla Khan and anr মামলা। দুই খুনির পক্ষে মামলা লড়েন মুসলিম আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা ফজলুল হক । ফজলুল হক কোর্টে নিয়ে আসেন কলকাতা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ রায়বাহাদুর হিদায়েত হুসেইনকে। হিদায়েত হুসেইন পরিষ্কার বললেন, ‘মহম্মদের ছবি বইতে দিয়ে ভোলানাথ সেন ইসলাম ধর্মকে অপমান করেছিলেন। এবং সেই অপরাধ শাস্তিযোগ্য।’ কিন্তু বিচারপতি লর্ড উইলিয়ামস কিছুদিন শুনানি চলার পর রায় দিলেন,‘আমীর আহমেদ ও আবদুল্লাহ খান যে ধর্মীয় উন্মত্ততার কারণে অমৃতসর থেকে কলকাতায় এসে ভোলানাথ সেনকে খুন করেছে, তা প্রমাণিত। সরকার ধর্মীয় আবেগকে সম্মান করে, কিন্তু উন্মত্ততাকে নয়। হিংসাকে নয়। তাই দুজনকেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হল।’
এই রায় ঘোষণামাত্র সারা দেশে উত্তেজনার আঁচ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। ফজলুল হক অনেক মান্যগণ্য মুসলিম ব্যক্তির স্বাক্ষর সংগ্রহ করে মৃত্যুদণ্ড রদের আর্জি পাঠালেন লন্ডনে প্রিভি কাউন্সিলে। সাময়িকভাবে সাজা স্থগিত হয়ে গেল। ১৯৩২ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি বাংলার বিধানসভার তিন সম্মানীয় সদস্য স্যার আবদুল্লাহ সুরাওয়ার্দি, ঘুজানভি এবং আসরাফ আলী খান টেলিগ্রাফ করলেন খোদ বাকিংহাম প্যালেসে।‘মহম্মদের ক্যারিকেচারের প্রতিবাদে মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত দুই সদ্যযুবককে মুক্তি দেওয়া হোক। সমগ্র মুসলিম সমাজের তরফ থেকে এই অনুরোধ।’ আবদুল্লাহ সুরাওয়ার্দি আরও বললেন, ‘ভুলে যাবেন না, আমার ভাইপো হাসান সুরাওয়ার্দি কিছুদিন আগে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বাংলার মহামান্য গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে ছাত্রী বীণা দাসের গুলি থেকে বাঁচিয়েছে। এতবড় উপকার করল যে সম্প্রদায়, তাদের প্রতি কি সরকারের কি কোনো কৃতজ্ঞতা বা দায়বদ্ধতা নেই?’
যদিও শেষরক্ষা হল না। গোটা দেশে বিক্ষিপ্তভাবে হতে থাকা আন্দোলনে কর্ণপাত না করে ব্রিটিশ সরকার ফাঁসির সাজা বহাল রাখল। ১৯৩২ সালের ১০ই মার্চ চূড়ান্ত সতর্কতার মধ্যে আমির আহমেদ ও আবদুল্লাহ খানের ফাঁসি কার্যকর করা হয় ।।
★ তথ্যসূত্র সৌজন্যে বাংলা লাইব্রেরি ।