জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,ফলতা,২৯ এপ্রিল :
‘জন্মদিন কিভাবে পালন করলি’- প্রধান শিক্ষকের প্রশ্ন শুনে হেসে ওঠে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রটি। ‘আমাদের আবার জন্মদিন! দু’বেলা পেটভরে খাবার জোটেনা’- একরাশ বিষণ্নতা ঝরে পড়ে বাচ্চাটির কণ্ঠে। তার বিষণ্নতা স্পর্শ করে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ফলতা অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যতিক্রমী প্রধান শিক্ষক তিলক নস্করকে। ওদের জন্য জন্মদিনে কিছু একটা করার ভাবনা মাথায় চেপে বসে। তারপর অবাক বিস্ময়ে এলাকাবাসী দেখল প্রতিমাসে বিদ্যালয়ের মধ্যেই পালিত হচ্ছে বাচ্চাদের জন্মদিন। শুরুটা হয়েছিল বছর তিনেক আগে ।
এলাকাটিতে মূলত গরীব মানুষের বাস। কষ্ট করে অভিভাবকরা বাচ্চাদের বিদ্যালয়ে পাঠায়। স্বাভাবিক ভাবেই জন্মদিন পালন ওদের কাছে বিলাসিতা। দূর থেকে সুসজ্জিত পরিবেশে রঙিন পোশাক পরিহিত ধনী বাড়ির ছেলেমেয়েদের জন্মদিন পালন করা দ্যাখা ও দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া ওদের কিছু করার থাকেনা। কিন্তু প্রধান শিক্ষক সহ অন্যান্য শিক্ষকদের সৌজন্যে সেই দুঃখ ওদের দূর হয়েছে।
এপ্রিল মাসে ছিল বত্রিশ জন ছেলেমেয়ের জন্মদিন। পঠনপাঠন বজায় রেখে গত ২৮ শে এপ্রিল যতটা সম্ভব বিদ্যালয়ের মধ্যে সৃষ্টি হয় জন্মদিন পালনের পরিবেশ। মাথায় রঙিন টুপি পড়ে সেজে ওঠে বত্রিশ জন। কেক কাটা হয়। নিজেরা তো খায়, বাকি সহপাঠীদের সঙ্গে ভাগ করে নেয়। বত্রিশ জনের হাতে তুলে দেওয়া হয় জন্মদিনের উপহার। সবশেষে মধ্যাহ্নভোজন। চিরাচরিত খাবারের সঙ্গে সেখানেও থাকে স্পেশাল মেনু। এইভাবে গত তিন বছর ধরে খুশিতে মেতে ওঠে ওরা।
প্রসঙ্গত,বিখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর স্মৃতিধন্য এই অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়টি পড়াশোনা থেকে শুরু করে অন্যান্য ক্ষেত্রেও বিশেষ ছাপ রেখেছে। শিক্ষক থেকে শুরু করে মিড ডে মিলের রন্ধনকর্মীরা পর্যন্ত বিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন স্থানীয় মানুষ তথা অভিভাবকরা। সবার প্রচেষ্টায় ‘নির্মল বিদ্যালয়’, ‘শিশু মিত্র’ পুরস্কার, জেলার ‘সেরা বিদ্যালয়’, ‘যামিনী রায়’ পুরস্কার সহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভরে ওঠে বিদ্যালয়ের ঝুলি। গতবছর পালিত হয় ভাইফোটা অনুষ্ঠান। যেসব শিশুদের ভাই বা বোন নাই তারা আনন্দ করার সুযোগ পায়। সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষিকারাও।
প্রধান শিক্ষক ছাড়াও লিপিকা করণ,ধরিত্রী পুরকাইত, সবিতা মিস্ত্রী, মণিশ চক্রবর্তী, শুভাশিস হালদার, কুন্তল মণ্ডল, মৌসুমী প্রামাণিক প্রত্যেকেই বিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য প্রাণপাত করেন। দেখলে মনে হবে এটা যেন তাদের কর্মক্ষেত্র নয়, বাড়ি। কথা হচ্ছিল ফলতা সার্কেলের এস.আই (শিক্ষা) পিয়ালী বড়ুয়ার সঙ্গে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সহ প্রতিটি শিক্ষক-শিক্ষিকার ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি বললেন,’ফলতা অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় আমাদের গর্ব। এর উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেককে জানাই কুর্ণিশ। জন্মদিন পালন সত্যিই এক অভিনব ভাবনা’।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তিলক নস্কর বললেন, আমার সহকর্মী লিপিকা করণ, ধরিত্রী পুরকাইত, সবিতা মিস্ত্রী, মণিশ চক্রবর্তী, শুভাশিস হালদার, কুন্তল মণ্ডল, মৌসুমী প্রামাণিক প্রত্যেকের সহযোগিতার জন্য আজ আমরা ছেলেমেয়েদের জন্মদিন পালন করতে পারছি। ওই বাচ্চাদের মুখের হাসি আমাদের বড় পাওনা ।।