পৌরাণিক নদী মা নর্মদার জল থেকে যে শিবলিঙ্গ বের হয় তাকে বলা হয় ‘নর্মদেশ্বর’। এটি একটি অত্যন্ত পবিত্র এবং অলৌকিক শিবলিঙ্গ যা বাড়িতেও স্থাপন করা খুবই শুভ ; যার পূজা খুবই ফলদায়ক। এটি শিব, সিদ্ধ এবং স্বয়ম্ভুর রূপে শিবলিঙ্গ যিনি ভক্তদের কল্যাণে নিজেকে আবির্ভূত করেছেন । নর্মদেশ্বর শিবলিঙ্গকে ওয়ানলিংও বলা হয়। দেবী নর্মদাকে শিবপুত্রীও বলা হয় ।
শাস্ত্রে বলা আছে মাটি বা পাথরের চেয়ে সোনার শিবলিঙ্গের পূজা করলে কোটি গুণ বেশি ফল পাওয়া যায়। সোনার চেয়ে দশ কোটি গুণ বেশি রত্ন এবং বনলিঙ্গ নর্মদেশ্বরের পূজা করলে রত্ন থেকে দশ কোটি গুণ বেশি ফল পাওয়া যায়। বাড়িতে এই শিবলিঙ্গ স্থাপন করার সময় জীবনের পবিত্রতার প্রয়োজন হয় না। গৃহস্থদের প্রতিদিন নর্মদেশ্বর শিবলিঙ্গের পূজা করা উচিত কারণ এটি শিবলিঙ্গ যা পরিবারের সৌভাগ্য নিয়ে আসে, সমস্ত সিদ্ধি এবং স্থিতিশীল লক্ষ্মী দেয়। সাধারণত, শিবলিঙ্গে দেওয়া কোনও জিনিস গ্রহণ করা হয় না, তবে নর্মদেশ্বর শিবলিঙ্গের প্রসাদ গ্রহণ করা যেতে পারে।
নর্মদা নদীর প্রতিটি পাথর কেন শিবলিঙ্গ?
স্কন্দপুরাণের কাহিনি অনুসারে, একবার ভগবান শঙ্কর ভগবান বিষ্ণুর ঘুমের সময় (চাতুর্মাস) দ্বাদশাক্ষর মন্ত্র (ওম নমো ভগবতে বাসুদেবায়) উচ্চারণ করে পার্বতীজিকে তপস্যা করতে বলেছিলেন। শঙ্করজীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে পার্বতীজী চাতুর্মাসের শুরুতে হিমালয় পর্বতে তপস্যা শুরু করেন। তাঁর সাথে তাঁর সখিরাও ছিলেন । পার্বতীজী যখন তপস্যায় মগ্ন তখন ভগবান শঙ্কর পৃথিবীতে বিচরণ করতে লাগলেন। একবার ভগবান শঙ্কর যমুনার তীরে বিচরণ করছিলেন । যমুনার উচ্ছল ঢেউ দেখে তিনি স্নান করতে জলে প্রবেশ করতেই তাঁর শরীরে আগুনের তীব্রতায় যমুনার জল কালো হয়ে গেল। তাঁর অন্ধকার রূপ দেখে যমুনাজী উপস্থিত হয়ে শঙ্করজীর প্রশংসা করলেন। শঙ্করজী বলেছিলেন যে এই অঞ্চলটিকে ‘হরতীর্থ’ বলা হবে এবং এতে স্নান করলে মানুষের পাপ বিনষ্ট হবে।
ভগবান শিবের লীলা অনন্য :
ভগবান শিব যমুনার তীরে সুন্দর দিগম্বর রূপে ডমরু হাতে নাচছিলেন, কপালে ত্রিপুণ্ড লাগিয়েছিলেন, আর বড়ো চুল নিয়ে ঋষিদের কুঠিরে কুঠিরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। কখনো গান গাইতেন, কখনো আনন্দে নাচতেন, কখনো হাসতেন, কখনো রাগ করতেন আবার কখনো নীরব হয়ে যেতেন। ভগবান শিব হলেন মদনজিৎ, তাঁর দিগম্বর রূপের ভুল ব্যাখ্যা করা উচিত নয়। দেবতা, ঋষি ও মানুষ সকলেই বস্ত্র ছাড়াই জন্মেছেন। যারা ইন্দ্রিয়কে জয় করতে পারেনি তারা সুন্দর পোশাক পরেও উলঙ্গ এবং যারা ইন্দ্রিয় জয় করেছে তারা উলঙ্গ হয়েও বস্ত্র দ্বারা আবৃত থাকেন । ভগবান শিব কামকে ধ্বংস করেছেন। তাঁর সুন্দর রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে অনেক ঋষির স্ত্রীও তার সাথে নাচতে লাগলেন। ঋষি এই ছদ্মবেশে শিবকে চিনতে পারলেন না এবং বরং তাঁর উপর ক্রুদ্ধ হলেন। ঋষিরা রেগে গিয়ে শিবকে অভিশাপ দিলেন যে তিনি লিঙ্গ হবেন। ভগবান শিব সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তাঁর লিঙ্গ রূপ অমরকন্টক পর্বত রূপে আবির্ভূত হয় এবং সেখান থেকে মা নর্মদা নদী আবির্ভূত হন । এই কারণে নর্মদার সমস্ত পাথর শিব রূপে রয়েছে। ‘নর্মদার প্রতিটি নুড়ি শঙ্কর’।
নর্মদেশ্বর শিবলিঙ্গ সম্পর্কিত আরেকটি কাহিনী আছে । গঙ্গা, যমুনা, নর্মদা এবং সরস্বতী ভারতের চারটি সেরা নদী। এগুলোর মধ্যেও এই পৃথিবীতে এমন কোনো নদী নেই যা গঙ্গার সাথে মেলে। প্রাচীনকালে নর্মদা নদী বহু বছর তপস্যা করে ভগবান ব্রহ্মাকে খুশি করেছিল। প্রসন্ন হয়ে ব্রহ্মা বর চাইলেন। তখন নর্মদাজী বললেন, হে ব্রাহ্মণ! আপনি যদি আমার প্রতি খুশি হন তবে আমাকে গঙ্গাজীর মত করে দিন । ব্রহ্মাজী হাসিমুখে বললেন, ‘যদি অন্য কোন দেবতা ভগবান শিবের সমকক্ষ হতে পারে, অন্য কোন পুরুষ যদি ভগবান বিষ্ণুর সমকক্ষ হতে পারে, অন্য কোন নারী যদি পার্বতীজীর সমকক্ষ হতে পারে এবং অন্য কোন নগর যদি কাশীপুরীর সমকক্ষ হতে পারে, তবে কেউ কেউ অন্য নদীও গঙ্গার মতো হতে পারে। ব্রহ্মার কথা শুনে নর্মদা বর ত্যাগ করে কাশীতে গিয়ে পিলপিলতীর্থে শিবলিঙ্গ স্থাপন করে তপস্যা শুরু করেন। ভগবান শঙ্কর তার উপর খুব খুশি হলেন এবং তাকে বর চাইতে বললেন। তখন নর্মদা বললেন, হে প্রভু! তুচ্ছ বর চেয়ে লাভ কি? তোমার পদ্মের চরণে আমার ভক্তি থাকুক ।।