প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,২৯ জুলাই : পঞ্চায়েত দিয়েছিল ’এক তলা’ বাড়ি তৈরির অনুমোদন। কিন্তু তৈরি হয় পাঁচ তলার বিশাল বিল্ডিং।পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের ঘন জনবসতি পূর্ণ এলাকায় তৈরি হওয়া সেই বহুতলেই চক্ষু হাসপাতাল গড়ে তুলেছে একটি আন্তর্জাতিক ক্লাব সংগঠন । যেটির মালিকানা ও পরিচলনা, সবই রয়েছে ’লায়ন্স ক্লাব অফ জামালপুর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের’ নামে ।নিজস্ব ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকা ওই বহুতল হাসপাতাল সৃষ্ট দুর্গন্ধে অতিষ্ট হয়ে জামালপুর-২ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার এক বাসিন্দা কলকাতা হাইকোর্টে মামলা রুজু করেন । সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে বহুতল নির্মানের যাবতীয় ’বেনিয়নের’ পর্দাফাঁস হয়ে যায় । ওই বহুতলের ’নির্মান অবৈধ’ বলে দাবিকরে সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েতের বর্তমান প্রধান হাইকোর্টের বিচারপতি অমৃতা সিনহার এজলাসে ’হলফনামা’ জমা দিয়েছেন। আর তা জানাজানি হওয়ার পর থেকেই জোরালো হচ্ছে বহুতল ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার দাবি ।
জামালপুর থানার ঠিক বিপরীতে রয়েছে ’লায়ন্স ক্লাব অফ জামালপুর ওয়েলফেয়ায় ট্রাস্টের’ পাঁচতলার বিল্ডিংটি । সেটির একটু পাশেই রয়েছে লায়ন্স ক্লাবের আরো একটি তিন তলার বিল্ডিং । এই দুটি বিল্ডিংয়ের মাঝে রয়েছে থানার কালি মন্দির। লায়ন্স ক্লাবের দুটি বিল্ডিংয়েয় দুই পাশে এবং পিছনে রয়েছে ঘন জনবসতি,দোকান ও বাজার। এমনকি লায়ন্স ক্লাবের দুটি বিল্ডিংয়ের কয়েক হাত দূরেই রয়েছে সেচ দফতরের অফিস, জমি রেজিস্ট্রি (এ ডি এস আর) অফিস ও পোস্ট অফিস । সেচ দফতরের অফিস,জামালপুর থানা ও লায়ন্স ক্লাবের দুটি বিল্ডিংয়ের মাঝ বরাবর রয়েছে একফালি রাস্তা।
জামালপুরের রাধাবল্লববাটী মৌজার যে জমির উপর ’লায়ন্স ক্লাব অফ জামালপুর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ তাদের পাঁচ তলা বিল্ডিংটি তৈরি করেছে সেই জমিটির পরিমাণ ১৭২০ বর্গফুট অর্থাৎ ৪ শতক । আদালতে পেশ হওয়া নথি অনুযায়ী ,ওই জায়গায় ’হাসপাতাল বাড়ি’ নির্মাণের জন্য ’ ’ট্রাস্টের’ চেয়ারম্যান প্রদীপ রায় ২০১১ সালের ২৩ জুন জামালপুর-২ গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসে আবেদন করেন । তবে কত তলার (Roof) বাড়ি তৈরি হবে তার কোন কিছুই প্রদীপ রায়ের আবেদনপত্রে উল্লেখ থাকে না । নির্দিষ্ট টাকার রসিদ কেটে ২৭ জুন সেই আবেদন মঞ্জুর করেন তদানিন্তন সিপিএম পরিচালিত গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান রমা বিশ্বাস ।অনুমোদন পত্রের দস্তাবেজে উল্লেখ থাকে, পঞ্চায়েতের বিধি মেনে আবেদন নির্দিষ্ট জায়গায় ’লায়ন্স ক্লাব অফ ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’কে ’একতলা’ বাড়ি তৈরির অনুমতি দেওয়া হল“ ।
সেই অনুমতির ভিত্তিতে উক্ত দাগ নম্বরের জমিতে বাড়ি নির্মান কাজ শুরু করে ’ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ’।
। তবে ’একতলা’ বাড়ি নয়, তৈরি হয়’পাঁচ তলার’ বিশাল বিল্ডিং । অভিযোগ,একতলা বাড়ি তৈরির অনুমতি নিয়ে ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকায় পাঁচ তলার বিশাল বিল্ডিং তৈরি হলেও তা নিয়ে তখন রহস্যজনক ভাবেই নীরব থাকে পঞ্চায়েত ও ব্লক প্রশাসন । বছরের পর বছর ধরে ওই বহুতলেই রমরমিয়ে চলছে ’চক্ষু’ হাসপাতাল । এই তথ্য সামনে আসার নানা ভাবে রমা বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতে হয়। তাঁর স্বামীকে ফোন করে রমা বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে,বাইরে আছি বলে তিনি জানিয়ে দেন’।
এদিকে বহুতল হাসপাতাল চালু হলেও তার নিজস্ব কোন ’ড্রেনেজ’ ব্যবস্থা থাকে না। তারা সাধারণের ব্যহৃত ড্রেন (Public Drain) ব্যবহার করে চলে।
তা নিয়ে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। দুর্গন্ধ ও দূষণ নিয়ে আশপাশের বাসিন্দারা ব্লক,জেলা প্রশাসন,জেলা স্বাস্থ্য দফতর,দূষণ নিয়ন্ত্রন পর্ষদ সহ প্রশাসনের নানা মহলের অভিযোগ জানান। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হয় না এরপরেই ওই বহুতল হাসপাতালের সন্নিকটের বাসিন্দা সমীর সামন্ত ২০২০ সালে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। প্রায় তিন বছর ধরে চলা মামলায় বাদি- বিবাদি দু’পক্ষ ছাড়াও জামালপুর-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের বর্তমান প্রধান মণিকা মুর্মুকেও আদালতে হাজিরা দিতে হয় ।পঞ্চায়েতে থাকা যাবতীয় নথিপত্র নিয়ে চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি আদালতে হাজির হন প্রধান মণিকা মুর্মু । ওই দিনই তিনি ’লায়ন্স ক্লাব অফ জামালপুর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের পাঁচতলা বিল্ডিংটির নির্মাণ অবৈধ(Unauthorized Construction ) বলে দাবি করে বিচারপতি অমৃতা সিনহার এজলাসে ’হলফনামা’ জমা দেন ।
মামলাকারী সমীর সামন্তর আইনজীবী রবিশংকর চট্টোপাধ্যায় বলেন,’পাঁচ তলার বহুতল নির্মাণের অনুমতি দেওয়ার এক্তিয়ার পঞ্চায়েতের নেই । সেটা পঞ্চায়েত প্রধান মণিকা মুর্মুর বুঝতে অসুবিধা হয়নি । পঞ্চায়েতে থাকা নথি ঘেঁটেও প্রধান নিশ্চিত হন,’কোন অনুমোদিত নকশা(Sanction Plan) পঞ্চায়েতে জমা না দিয়েই তৈরি হয়েছে ওই পাঁচ তলার ‘বিশাল বিল্ডিং’। তাই মণিকা মুর্মু বিচারপতি অমৃতা সিনহার এজলাসে হলফনামা’ দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন,’লায়ন্স ক্লাব অফ জামালপুর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের পাঁচতলা বিল্ডিংটির ’নির্মাণ অবৈধ’। এর পরিপ্রেক্ষিতে অবৈধ ভাবে নির্মিত ওই বহুতল ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার দাবি ওঠাই স্বাভাবিক। এবিষয়ে কি পদক্ষেপ নেওয়া হবে,তা ঠিক করার দায়িত্ত্ব আদালত মহকুমা শাসক ( বর্ধমান দক্ষিণ) কে দিয়েছে বলে রবিশংকরবাবু জানান । পাশাপাশি তিনি এও বলেন,’অবৈধ ভাবে নির্মিত বহুতলে এখনও কি ভাবে চক্ষু হাসপাতাল চালছে সেটা অতি আশ্চর্য্যেরই বিষয় । এই বিষয়টি আদালতের নজরে আনবেন বলে আইনজীবী রবিশংকর চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন ।
মামলাকারী সমীর সামন্ত বলেন,’বহুতল গড়ে চক্ষু হাসপাতাল চালু করলেও ’লায়ন্স ক্লাব অফ জামালপুর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ নিজস্ব ’ড্রেনেজ’ ব্যবস্থা গড়ে তোলেনি । তার কারণে দুর্গন্ধ ও দূষনে তিনি সহ আরো অনেক বাসিন্দাই জেরবার হচ্ছেন
। শুধু তাই নয়,ওই বহুতলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে রক্ষা পাবে না আশপাশের একাধিক সরকারী অফিস, থানা সহ অনেক গৃহস্থের বাড়ি ও দোকান ।সমীরবাবু আরো বলেন,’বহুতলটির লাগোয়া জায়গায় ’লায়ন্স ক্লাব অফ জামালপুর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের’ অপর একটি তিন তলার বিল্ডিং রয়েছে । সেটি পূর্বে ছিল এক গৃহস্থের একতলা বাড়ি । প্রশাসনের অনুমোদন নিয়ে চক্ষু হাসপাতালের স্বার্থে ওই একতলা বাড়িটিকে তিনতলা বাড়িতে পরিণত করা হয়েছে কি না,তারও তদন্ত দাবি করেছেন সমীর সামন্ত ।
এবিষয়ে প্রতিক্রিয়া পাওয়ার জন্য লায়ন্স ক্লাব অফ জামালপুর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের’ চেয়ারম্যান প্রদীপ রায়কে ফোন করা হলে তিনি বলেন,’আদালতে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে আমি কোন মন্তব্য করবো না’ ।’ মহাকুমা শাসক (বর্ধমান দক্ষিণ) কৃষ্ণেন্দু মণ্ডল বলেন,’মামলা আদালতের বিচারাধীন রয়েছে।আদালত শুনানি (Hearing) করতে বলেছে । শুনানি হচ্ছে । শুনানিতে হওয়া সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ গৃহীত হবে ।’।