‘বন্দে মাতরম্‘ কথার অর্থ ‘মা তোমার বন্দনা করি‘ । ‘মা’ মানে দেশমাতৃকা । বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক ১৮৮২ সালে রচিত আনন্দমঠ উপন্যাসের অন্তর্ভুক্ত একটি গান এই ‘বন্দে মাতরম্’ ৷ সংস্কৃত-বাংলা মিশ্রভাষায় লিখিত এই বন্দনাগীতি শুনে উদ্বুদ্ধ হতেন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা । সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অস্ত্র হয়ে উঠেছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই গান । ঋষি অরবিন্দ বন্দে মাতরম্ গানটিকে “বঙ্গদেশের জাতীয় সংগীত” বলে উল্লেখ করেছিলেন । কিন্তু দেশমাতৃকার যে বন্দনাগীতিতে এক সময় আসমুদ্রহিমাচল উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল,সেই গানটিকেই মওলানাদের আপত্তিতে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে বাতিল করেছিলেন জহরলাল নেহেরু ।
১৯৩৭ সালে, মওলানারা বন্দে মাতরম গানটির উপর তাদের আপত্তি নথিভুক্ত করেছিলেন, মাওলানাদের আপত্তির পরে, জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বাধীন কমিটি প্রথম দুটি অনুচ্ছেদকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে অনুমোদন করেছিল। এই কমিটিতে মৌলানা আবুল কালাম আজাদও ছিলেন। কমিটি দেখেছিল যে প্রথম দুটি প্যারায় মাতৃভূমির স্তুতি, আর হিন্দু দেবতাদের নাম গানে উল্লেখ রয়েছে। সেজন্য মাত্র দুটি প্যারাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল, যাতে কারও অনুভূতিতে আঘাত না লাগে এবং এই বিরোধ ১৯৩৭ সালেই শেষ হয়েছিল। অবশেষে,১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারী, এটি জাতির দ্বারা জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গৃহীত হয় এবং তখন থেকেই এটি গাওয়া হয়।
উল্লেখ্য,মাওলানা আবুল কালাম ইসলামের একজন মহান আলেম ছিলেন । যিনি আজাদ মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রীও হয়েছিলেন । কিন্তু বন্দে মাতরম্-এ কেন আপত্তি তুলেছলেন মওলানারা ?
আসলে ইসলাম বলে যে মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা শুধুমাত্র আল্লাহর সামনে মাথা নত করবে। শুধু তাঁরই উপাসনা করবে আর কাউকে নয়। সেই অর্থে ইসলামের দৃষ্টিতে এটা ‘হারাম’ ! যদিও শিয়া ধর্মীয় নেতা ইয়াসুব আব্বাস বলেছিলেন, বন্দে মাতরমের বিরোধিতা শুধুই অজ্ঞতা। এর কোথাও মাতৃভূমির পূজা করার কথা বলা হয়নি। যে জমিতে আমরা জন্মেছি, সেখানে ফিরে গিয়ে দেখা করতে হবে, এটা আমাদের সম্মানের ব্যাপার। তার বক্তব্যকে আরও এগিয়ে নিয়ে তিনি ইসলাম নিয়ে আলোচনা করেন এবং বলেন যে ইসলামে আল্লাহর সামনে মাথা নত করার কথা বলা হয়েছে, এটা সত্য এবং প্রত্যেক মুসলমানের তা করা উচিত। এটা না করা গুনাহ হবে, কিন্তু ইসলাম এটা বলে না যে কাউকে সম্মান করো না। সেটা ব্যক্তি হোক, সংগঠন হোক, প্রতীক হোক বা অন্য কিছু। সম্মান মানে ইবাদত নয়। বন্দে মাতরমের সহজ অর্থ হল মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা এবং অন্য কিছু নয় যা মানুষ বিরোধিতা করে।
আপনি জেনে গর্বিত এবং অবাক হবেন যে বন্দে মাতরম ভারত ভূমির গান যা ২০২৩ সালে সেরা দশটি গানের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। সাত হাজার গানের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে নির্বাচিত হওয়ায় এর জনপ্রিয়তা বোঝা যায়। বিবিসির এই জরিপে ১৫৫ টি দেশ অংশ নিয়েছে। মূলত বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় লেখা এই গানটি অন্যান্য অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে, যাতে এই গানটির ব্যাপক জনপ্রিয়তা প্রমান করে ।
সত্যকে অস্বীকার করা যায় না যে ভগৎ সিং, সুখদেব, রাজগুরু, রামপ্রসাদ বিসমিল এবং আশফাকুল্লাহ খান সহ অগণিত শহীদ এই বন্দে মাতরম গান গাইতে গাইতে ফাঁসির মঞ্চে শহীদ হয়েছিলেন । এই গানটি বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয় আন্দোলনে দেশব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল । তখন থেকেই বন্দে মাতরমের স্লোগান প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে ওঠে । আর এখন বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় এই গান বন্দে মাতরম হারাম হয়ে গেছে !
বন্দে মাতরম্৷
সুজলাং সুফলাং মলয়জশীতলাম্ শস্যশ্যামলাং
মাতরম্!
শুভ্র-জ্যোত্স্না-পুল¬কিত-যামিনীম্ ফুল্লকুসুমিত-দ্রুমদল¬শোভিনীম্, সুহাসিনীং সুমধুরভাষিণীম্ সুখদাং বরদাং মাতরম্৷৷
সপ্তকোটীকন্ঠ-কল-কল-নিনাদকরালে, দ্বিসপ্তকোটীভুজৈধৃতখ¬রকরবালে, অবলা কেন মা এত বলে! বহুবলধারিণীং
নমামি তরিণীং রিপুদলবারিণীং
মাতরম্৷
তুমি বিদ্যা তুমি ধর্ম্ম তুমি হৃদি তুমি মর্ম্ম
ত্বং হি প্রাণাঃ শরীরে৷ বাহুতে তুমি মা শক্তি, হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি, তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে৷
ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী কমলা কমল-দলবিহারিণী
বাণী বিদ্যাদায়িণী
নমামি ত্বাং
নমামি কমলাম্
অমলাং অতুলাম্,
সুজলাং সুফলাং
মাতরম্
বন্দে মাতরম্
শ্যামলাং সরলাং
সুস্মিতাং ভূষিতাম্
ধরণীং ভরণীম্
মাতরম্ ৷।