প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,০১জুলাই : সম্রাট সেলিম খানের দুর্গ স্থান হিসাবে পরিচিত সেলিমাবাদ গ্রাম । পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর ব্লকের এইগ্রামে হিন্দু দেবদেবীর কোন পুজোই পঞ্জিকা উল্লিখিত দিনে হয় না । সবই হয় পরদিন । সেই রীতি মেনেই শুক্রবারের পরিবর্তে শনিবার সেলিমাবাদ গ্রামে গোঁসাই মতে হবে রথযাত্রার পুজো পাঠ।তাও আবার প্রভু জগন্নাথদেব ,বলরাম ও সুভদ্রাদেবীর পুজো পাঠ নয়।ওইদিন পুজিত হবেন শুধুমাত্র রাধাকৃষ্ণ ও গোপাল।পুজো শেষে ওই দিন এই দুই দেবতার মুর্তি রথে চাপিয়ে গ্রামের মাসির বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে।শতাধীক বছরকাল ধরে এই ভাবেই ব্যতিক্রমী রথযাত্রা উৎসহ পালন করে আসছেন সেলিমাবাদ গ্রামের বাসিন্দারা ।
সেলিমাবাদ গ্রামটি পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর ১ পঞ্চায়েত এলাকার একটি প্রাচীন জনপদ । কথিত আছে,এককালে সম্রাট সেলিম খান এই গ্রামে আস্তানা গেড়েছিলেন। সেই থেকে গ্রামটি সেলিমাবাদ নামে পরিচিতি পায়। হিন্দু ও মুসলিম সহ বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ এই গ্রামে বসবাস করেন।গ্রামের মাঝামাঝি একটি জায়গায় রয়েছে ’বাল গোপাল জীউ’ এর প্রাচীন মন্দির।সেই মন্দিরেই রথযাত্রা সহ হিন্দুদের অন্য সকল আরাধ্য দেবদেবীর পুজোপাঠ হয় ।
সেলিমাবাদ গ্রামের বাসিন্দা মহলে কথিত আছে, সম্রাট সেলিম খান বহুকাল পূর্বে আরামবাগ থেকে বর্ধমানের দিকে যাচ্ছিলেন। দামোদরের বাঁধ ধরে যাওয়ার সময়ে পথে তাঁদের গ্রামের ’বাল গোপাল জীউর’ মন্দির সংলগ্ন জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে তিনি আশ্রয় নেন। পরে পাকাপাকি ভাবে তিনি সেখানেই তাঁর ’আস্তানা’ গড়ে তোলেন। সেলিম খানের নাম অনুসারে পরবর্তী কালে গ্রামটি ’সেলিমাবাদ’ গ্রাম নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। জামালপুর থানা এলাকা নিবাসী ইতিহাস ও পুরাতত্ত্ব গবেষক পূরবী ঘোষ জানিয়েছেন, কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল কাব্যে সেলিমাবাদের নাম উল্লেখ রয়েছে। প্রবাদ রয়েছে,এই গ্রামের সম্রাট সেলিম খান খালি হাতে বাঘ মেরে ছিলেন।পূরবী ঘোষ আরো জানান, ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা গিয়েছে ’শের আফগান কে হত্যা করার পর তার পত্নী মেহেরুন্নিসাকে সেলিমাবাদ গ্রামের দুর্গে এনে লুকিয়ে রেখেছিলেন সেলিম খান। পরবর্তী কালে এই মেহেরুন্নিসাই নুরজাহান নামে পরিচিত হয়েছিলেন’।একইভাবে সম্রাট হওয়ার পর ’সেলিম খান ’পরিচিত হয়েছিলেন ’সম্রাট জাহাঙ্গীর’ নামে। বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে পূরবী ঘোষ এও জানান,’পূর্বে সেলিমাবাদ গ্রামে হিন্দু ও জৈন এই দুই ধর্মের যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল।সেই থেকে সেলিমাবাদ গ্রামটি বহু সুপ্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে আসছে’ ।
এই সেলিমাবাদ গ্রামে ’বাল গোপাল জীউর’ মন্দির তৈরির পিছনেও রয়েছে এক প্রাচীন ইতিহাস। কথিত আছে ,’বহুকাল পূর্বে সেলিমাবাদ গ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন বৈষ্ণব সাধক দ্বীজবরদাস বৈরাগ্য ও তার স্ত্রী দয়ালময়ী দাসী।গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক শক্তিপদ সাঁতরা জানান, ১৯১৮ সালের পরবর্তী কোন এক সময়ে সেলিমাবাদ গ্রামে এসে সস্ত্রীক বসবাস শুরু করেন দ্বীজবরদাস বৈরাগ্য।বৈষ্ণব সাধক দ্বীজবরদাস বৈরাগ্য এই গ্রামে নিজের বাড়ির সামনেই মন্দির গড়ে তোলেন। সেই মন্দিরেই তিনি রাধাকৃষ্ণ ও গোপাল ঠাকুরের বিগ্রহের পুজোপাঠ শুরু করেন।তিথি অনুয়ায়ী গোটা দেশ জুড়ে হওয়া রথ উৎসবের পরের দিন সেলিমাবাদ গ্রামের রথযাত্রা উৎসবের সূচনা দ্বীজবরদাস বৈরাগ্যই করেছিলেন’। সেই প্রথা মেনে আজও রথের পর দিন রথের পুজোপাঠ সম্পন্ন করে আসছেন সেলিমাবাদের ’বাল গোপাল জীউ, সেবা সমিতি। শক্তিপদ বাবু আরো জানান,“পুরীর রথে জগন্নাথদেব,বলরাম ও সুভদ্রাদেবীর বিগ্রহের পুজোপাঠ হয়। রথের দিন এই তিন দেবতার বিগ্রহ রথে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের মাসির বাড়িতে।কিন্তু সেলিমাবাদ গ্রামের রথে রাধাকৃষ্ণের প্রস্তর মূর্তি এবং অষ্টধাতুর গোপাল মূর্তির পুজো হয়।তিথি মেনে দেশজুড়ে হওয়া রথযাত্রা উৎসবের পরের দিন সকাল থেকে সেলিমাবাদ গ্রামের ’বাল গোপাল জীউ’ মন্দিরে রাধাকৃষ্ণ ও গোপালে পূজা পাঠ শুরু হয়। ভক্তদের প্রসাদ ও ভোগ বিতরণ শেষে বিকালে কাঠের তৈরি প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতার রথে রাধাকৃষ্ণ মূর্তি ও গোপাল মূর্তি চাপিয়ে গ্রামের রাস্তা ধরে নিয়ে যাওয়া হয় দামোদরের ধারের মাসির বাড়িতে। মাসির বাড়িতে যাওয়ার পথে এই গ্রামের রথে রশিতে টান দেন সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষজন ।’
গ্রামের প্রবীণা মায়া সাঁতরা জানান,’শুধুমাত্র রথযাত্রার পুজোপাঠই নয়,দোল, শিবরাত্রি জন্মাষ্টমী, এমনকি রাস উৎসবও ’তিথি’ নির্দিষ্ট দিনে সেলিমাবাদ গ্রামে পালিত হয় না। হয় তার পরের দিন। পুরাকাল থেকেই সেলিমাবাদ গ্রামে এমন রীতি রেওয়াজ মেনেই যাবতীয় পূজা-অর্চনা হয়ে আসছে বলে মায়াদেবী জানিয়েছেন ।’।