জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,গুসকরা(পূর্ব বর্ধমান),২৩ ফেব্রুয়ারী : ২৭ শে ফেব্রুয়ারি রাজ্যের ১০৮ টি পুরসভার নির্বাচন। বর্তমান রাজনীতির গতিপ্রকৃতি দেখে ফলাফল সহজেই বলে দেওয়া যায় – রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধীদের শূন্য হাতে ফিরতে হবে । কোনো পুরসভা বিরোধীদের দখলে আসবে না। সান্ত্বনা পুরস্কারের মত কিছু ওয়ার্ডে অবশ্যই বিরোধীরা জয়লাভ করবে। যদিও কোথাও বিরোধীদের বোর্ড গঠন করতে না পারাটা বা বিরোধী শূন্য পুরবোর্ড গঠন গণতন্ত্রের পক্ষে সুস্থ লক্ষণ নয়। যদিও এরজন্য তৃণমূল দায়ী নয় ।
তার আগে কলকাতা সহ আরও চারটি পুরনিগমের নির্বাচন হয়েছে। সবকটিতেই প্রত্যাশিতভাবেই বিজেপিসহ বিরোধীরা পর্যুদস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ইণ্টারেস্টিং ছিল আসানসোল ও শিলিগুড়ি পুরনিগমের নির্বাচনী ফলাফল ।
সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের সায়নি ঘোষকে পরাস্ত করে বিজেপি প্রার্থী আসানসোলে জয়লাভ করে। আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রও বিজেপির দখলে । যদিও সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের সাংসদ বাবুল সুপ্রিয় পদত্যাগ করে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। তার পরেও আসানসোলের পুরনিগমের ভোটে কার্যত বিজেপি ধূলিসাৎ। এর থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট আসানসোলের মানুষ বিজেপিকে খুব একটা পচ্ছন্দ করছে না এবং ব্যক্তি স্বার্থে আসানসোলের একদল স্থানীয় তৃণমূল নেতা নিজস্ব উদ্যোগে দলের প্রার্থী সায়নির পরাজয়ের পথ প্রশস্ত করেছে ।
২০১৯ এর লোকসভা ভোটের পর থেকেই উত্তরবঙ্গে বিজেপি যে দাপট দেখাতে শুরু করেছিল বিধানসভা ভোটেও সেই দাপট বর্তমান ছিল। বলা যেতেই পারে উত্তরবঙ্গ ধীরে ধীরে বিজেপির গড় হয়ে উঠেছে। সেই উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ির বিধায়কও বিজেপির। আসানসোলের মত শিলিগুড়ির পুরনিগমের ভোটেও বিজেপির অস্তিত্ব চরম সংকটে ।
বোর্ড গঠন করার বিষয়ে বামফ্রন্ট আসানসোলে আশাবাদী না থাকলেও শিলিগুড়িতে চরম আশাবাদী ছিল। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব বাবুর অনুরোধ বা আদেশে ভোটে অবতীর্ণ হয়েছিলেন উত্তরবঙ্গের ‘মুখ্যমন্ত্রী’ প্রবীণ অশোক ভট্টাচার্য। ভোটের পরও ‘যেভাবে ভোট হয়েছে’ তাতে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেছেন এবং বোর্ড গঠনের বিষয়ে চরম আশাবাদী ছিলেন। এখানেও ভোটের ফল সবার জানা ।
যাই হোক ২৭ শে ফেব্রুয়ারি ভোটের আগেই একাধিক পুরভোট তৃণমূলের দখলে এসেছে। সেইসব জায়গায় প্রার্থী দিতে না পারাটা বিরোধীদের ব্যর্থতা না তৃণমূলের হুমকির কাছে নতিস্বীকার সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। গত বিধানসভা ভোটে অনেকগুলো পুরসভায় তৃণমূলের থেকে বিজেপি যথেষ্ট এগিয়ে ছিল। এটা ঠিকই বিধানসভা ভোটের ফল বের হওয়ার পর থেকেই এই রাজ্যে বেশ কিছু হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে। তৃণমূলী গুণ্ডাদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল বিজেপির কর্মী-সমর্থকরা। অনেকেই ঘর ছাড়া হয়েছিল। আদালত সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার পর বেশ কয়েকজন অভিযুক্ত গ্রেপ্তারও হয়েছে যারা এলাকায় তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী বলে পরিচিত । সেই সময় দুই তৃতীয়াংশের বেশি আসন পেয়ে সদ্য বিজয়ী একটা দল দ্বারা গঠিত সরকারকে বরখাস্ত করার দাবি নিয়ে বিজেপির বঙ্গ নেতারা যতবার দিল্লির শরণাপন্ন হয়েছে বা সদলবলে দিল্লি গেছে তার পরিবর্তে আক্রান্ত কর্মীদের পাশে যদি তারা দাঁড়াত তাহলে বঙ্গ বিজেপির এই দুর্দশা হতোনা। অথচ হাতের কাছে সিপিএমের হার্মাদদের হাতে আক্রান্ত কর্মীদের পাশে নিজের জীবন বিপন্ন করেও কিভাবে দাঁড়াতে হয় তার উদাহরণ ছিল। তার জন্যই কর্মীরা মমতাকে বিশ্বাস করে। তার জন্য নিজেদের জীবন বিপন্ন করতে কুণ্ঠাবোধ করেনা ।
কলকাতা পুরনিগমের ভোটের সময় তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব বিশেষ করে মমতা ব্যানার্জ্জী ও অভিষেক ব্যানার্জ্জী কর্মীদের সমস্ত রকম হিংসাত্মক কার্যাবলী থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দ্যান। তারপরও কয়েকটি হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে। বোমাও পড়েছে।রাজ্যবাসী তথা দেশবাসী টিভির পর্দাতেই সেইসব ঘটনার সাক্ষী থেকেছে। যেই ঘটনা ঘটাক না কেন দিনের শেষে ঘটনার দায় সরকার তথা শাসকদল তৃণমূলকে নিতেই হবে। শীর্ষ নেতৃত্বের সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে খোদ কলকাতার বুকে যদি হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে তাহলে আসন্ন পুরভোটে জেলা শহরগুলোতে কি হতে পারে সেটা ভেবে অনেকেই আতঙ্কিত। আশা করা যায় জেতার ব্যাপারে তৃণমূলের উৎসাহি নেতা, কর্মীরা তাদের প্রিয় ‘দিদি’র উন্নয়নের উপর নির্ভর করবে, বোমা-বন্দুকের উপর নয় ।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ১০৮ টি পুরসভায় তৃণমূলের বোর্ড গঠন নিছকই সময়ের ব্যাপার। প্রতিটি তৃণমূল বিরোধী দল সেটা ভাল করেই জানে। এখন শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে ‘পয়েণ্ট’ বাড়ানোর তাগিদে বিরোধী শূন্য বোর্ড গঠনের নেশায় অতি উৎসাহি স্হানীয় নেতা-কর্মীরা যদি হিংসাত্মক কার্যকলাপে মেতে ওঠে এবং জয়টা কলঙ্কিত করে তোলে তাহলে সেটা শুধু দল বা দলনেত্রীর কাছে লজ্জার নয়, সমস্ত রাজ্যবাসীর কাছে লজ্জার। সেইসব নেতা-কর্মীদের বোঝা উচিত ‘দিদির ছবি সরবে যবে’ সেদিন তারা অতি সাধারণ। বিধানসভা ভোটে তৃণমূল ত্যাগী নেতারা সেটা ভালভাবেই টের পেয়েছে। ২০১৮ এর পঞ্চায়েত ভোটের মত কোনো হিংসাত্মক ঘটনা যাতে না ঘটে সেব্যাপারে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব কি কোনো কঠোর অবস্থান নেবে ?