এইদিন ওয়েবডেস্ক,তেহেরান,০২ মে : নরওয়ে ভিত্তিক একটি মানবাধিকার গোষ্ঠী বলছে যে ইরান মে মাসে ১৪২ বন্দিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে, ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের জন্যও এটি ছিল একটি অন্ধকারময় মাস । অসলো-ভিত্তিক ইরান মানবাধিকার সংস্থা বৃহস্পতিবার তার সর্বশেষ প্রতিবেদনে ঘোষণা করেছে যে এই সংখ্যাটি ২০১৫ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ মাসিক মৃত্যুদণ্ড, মে মাসে সারা দেশে প্রতিদিন গড়ে পাঁচজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়।প্রতিবেদন অনুসারে,২০২৩ সালের প্রথম পাঁচ মাসে সরকার কমপক্ষে ৩০৭ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে, যা বছরে ৭৬ শতাংশ বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয় ।বছরের প্রথম প্রকাশ্য মৃত্যুদণ্ড ছাড়াও, মাদক সংক্রান্ত অভিযোগে ৭৮ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, যাদের মধ্যে ছিল প্রায় ৩০ জন বালুচ সংখ্যালঘু । উল্লেখ্য,বালুচ সংখ্যালঘুদের ইরানের সবচেয়ে নির্যাতিত সম্প্রদায় বলে মনে করা হয় ।
আন্তর্জাতিক রিপোর্ট অনুযায়ী,২০২৩ সাল থেকে এযাবৎ কার্যকর করা ৩০৭ টি মৃত্যুদণ্ডের মধ্যে ৫৯ শতাংশ বা ১৮০ জনকে মাদক সংক্রান্ত অভিযোগে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে । মাদক সম্পর্কিত মৃত্যুদণ্ড বৃদ্ধির পাশাপাশি ধর্মনিন্দা এবং একজনকে ব্যভিচারের জন্য মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে ইসলামিক রিপাবলিক অফ ইরান । আইএইচআর এর পরিচালক মাহমুদ আমিরি-মোগাদ্দাম ইরানের ক্রমবর্ধমান মৃত্যুদণ্ড সম্পর্কে বিশ্বকে সতর্ক করে একটি শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া এবং ব্যবহারিক শাস্তিমূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের হত্যা যন্ত্র বন্ধ করতে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন । তিনি ইরান ইন্টারন্যাশনালকে বলেছেন,’ইসলামী প্রজাতন্ত্রের নির্বিচারে মৃত্যুদণ্ডের তীব্রতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্য হল সমাজে ভয় ছড়িয়ে দেওয়া যাতে সাধারণ মানুষ আর সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ না নেয় , এইভাবে তারা নিজেদের শাসনকে দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করছে ।’ তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন,’আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি মৃত্যুদণ্ডের বর্তমান তরঙ্গের বিরুদ্ধে এখনই কোনো কঠোর প্রতিক্রিয়া না দেখায়, তাহলে আগামী মাসগুলিতে আরও শত শত লোক ইরান সরকারের হত্যার যন্ত্রের শিকার হবে ।’ আমিরি মোগাদ্দাম উল্লেখ করেছেন, ইরান সরকারের ঘোষিত পরিসংখ্যান মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রকৃত সংখ্যার তুলনায় অনেক কম।
তিনি ইরান সরকারের সমালোচনা করে বলেন,’ইসলামিক প্রজাতন্ত্র অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে না বরঞ্চ শাসনক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য নাগরিকদের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করছে,যাতে বিদ্রোহ মাথা চাড়া না দিতে পারে । আর মৃত্যুদণ্ড হল ভয় দেখানোর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ।’ ইরানের বর্তমান শাসনযন্ত্রকে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলে তিনি জানান ।
মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ প্যারাস্তু ফাতেমিওর মতে,’মৃত্যুদণ্ডের বৃদ্ধি প্রতিবাদকারীদের রাস্তা থেকে তাদের বাড়িতে ঠেলে দেওয়ার একটি কৌশল মাত্র । যখনই শাসন রাস্তায় প্রতিবাদের মুখোমুখি হয়, এটি মানুষের মধ্যে ভয় জাগানোর জন্য মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে ।’এদিকে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিচার বিভাগীয় প্রধান গোলামহোসেন মোহসেনি এজেই মৃত্যুদণ্ডকে সমর্থন করে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, কোনো বিবেচনা ছাড়াই দাঙ্গাকারীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হচ্ছে এবং হবে ।
ইসলামিক প্রজাতন্ত্র সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে তার হত্যার প্রবণতাকে আরও তীব্র করেছে, যা সারা দেশে আরও বিক্ষোভকে উস্কে দিয়েছে । জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র জানুয়ারি থেকে অন্তত ২৫৯ ইরানিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে । এপ্রিলের শেষের দিক থেকে ইরানে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় । তারপর গত ১৯ মে কর্তৃপক্ষ নির্বিচারে তিনজন নির্যাতিত প্রতিবাদকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেয় । মাজিদ কাজেমি, সাঈদ ইয়াঘুবি এবং সালেহ মিরহাশেমি নামে ওই ৩ জনকে অন্যায়ভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল এবং ইসফাহানে (এসফাহান) মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল ।
২০২২ সালে সেপ্টেম্বরে ২২ বছরের কুর্দি তরুনী মাহসা আমিনিকে ইরানি পুলিশ পিটিয়ে মারার পর হেফাজতে মৃত্যুর পর থেকে কমপক্ষে সাতজন বিক্ষোভকারীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে ইরান । ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে । মার্চের শুরুতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছিল যে ইরানে অন্তত সাতজন ব্যক্তিকে বিক্ষোভ প্রদর্শনের কারণে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হয়েছে, এবং আরও কয়েক ডজন মৃত্যুদণ্ডের ঝুঁকিতে রয়েছে । এযাবৎ নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে প্রায় ৭৫০ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে এবং অন্তত ৩০,০০০ গ্রেপ্তার হয়েছে। যদিও অনেককে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, প্রায় ১,৫০০ জনকে ফৌজদারি অভিযোগের মুখোমুখি করা হয়েছে এবং আরও অন্তত ৮০ জন বন্দীকে মোহারেবেহ ( ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়া) এবং দুর্নীতির অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের সম্মুখীন হতে হয়েছে ।।