প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,২৮ জুলাই : ধর্ম যার যাই হোক ’মানবতাই’ সবথকে বড় ধর্ম । শুধু মনে প্রাণে এ কথা বিশ্বাস করাই নয়,বাস্তবেও সেই পথই অনুসরণ করে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন ইব্রাহিম মল্লিক ও তারাপদ রায় । পূর্ব বর্ধমানের খণ্ডঘোষ থানার প্রত্যন্ত গ্রাম উখরিদে পাশাপাশি বাড়িতে বসবাস অভিন্ন হৃদয় এই দুই ব্যক্তির । তাঁদের একে অপরের প্রতি স্নেহ ,ভালবাসা ও মানবিক হৃদয় বন্ধনে আবদ্ধ থাকা দেখে মুগ্ধ খণ্ডঘোষ থানার পুলিশ বাবুরাও ।আইনের রক্ষকরা অকপটে বলছেন, ‘হ্যাঁ ,এটাই আমাদের দেশ। আমাদের সর্বধর্ম সমন্বয়ী মাতৃভূমি ভারতবর্ষের মাটিতে এখনও বেঁচে আছে মানবতা ।’
উখরিদ গ্রামের তারাপদ রায় বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত । তাঁর শরীরও তেমন সুস্থ সবল নয় । তবে ইব্রাহিম মল্লিক ও যে একেবারের সুস্থ তাও বলা যাবে না। ব্যাঙ্কের পাস বইটি হারিয়ে যাওয়ায় তারাপদ বাবু সমস্যায় পড়েন । মনের মানুষ,কাছের মানুষ ইব্রাহিম মল্লিককে নিজের সমস্যার কথা জানান তারাপদ বাবু । তা শুনে ইব্রাহিম তাঁর পাশে থাকার আশ্বাস দেন । সম্প্রতি বৃদ্ধ তারাপদ বাবুকে সঙ্গে নিয়ে ইব্রাহিম স্ক্র্যাচে ভর দিয়ে হেঁটেই হাজির হয় খণ্ডঘোষ থানায়।সেই সময়ে থানায় ডিউটি অফিসার হিসাবে দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন এএসআই রিটন সেখ ।
ইব্রাহিম ও তারাপদ বাবু ডিউটি অফিসার রিটন বাবুর কাছে গিয়ে দাঁড়ান । রিটন বাবু জানান, তিনি থানায় আগত ওই দুই ব্যক্তির সমস্যার কথা জানতে চান । তখন তারাপদ রায় বলেন , ‘তাঁর ব্যাংকের পাস বইটি কিছুদিন আগে হারিয়ে গেছে। সেই কারণে তিনি ব্যাংকে লেনদেন করতে পারছে না। সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যাংকে গিয়েছিলেন । ব্যাঙ্কের অফিসারা তাঁকে বলেছেন এই বিষয়ে থানা থেকে ’মিসিং ডায়েরি’ করা কপি আনতে হবে ।’
রিটন বাবু বলেন, ‘তাঁর খারাপ লাগলো এই কথা ভেবে যে বৃদ্ধ তারাপদবাবু নিজেই ঠিকমত চলতে পারে না । অথচ সেই ব্যক্তি প্রায় ৮ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে থানায় এসেছেন একটা মিসিং ডায়েরি করতে ! তাই বিলম্ব না করে বৃদ্ধর অবস্থা বুঝে সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটি মিসিং ডায়েরি করে জিডি নাম্বার কার্তিক বাবুকে দিয়ে দেন । ডিউটি অফিসার রিটন বাবু হতবাক হয়ে পড়েন থানায় তারাপদ রায়ের সমস্যা মিটিয়ে দিয়ে ইব্রাহিমের কাছে তার সমস্যার কথা জানতে চেয়ে । ডিউটি অফিসার বলেন, ‘ইব্রাহিম সরল মনে জানায় ,’স্যার আমার কোন সমস্যা নেই । ব্যাঙ্কের পাস বই হারিয়ে যাওয়ায় তারাপদদাদা খুব সমস্যা পড়ে গিয়েছিলেন । দাদা এতটা রাস্তা পেরিয়ে একা থানায় আসতে পারবে না বলেছিলেন । তাই তারাপদদাদাকে সাহায্য করার জন্য তিনি স্ক্র্যাচে ভর দিয়ে হেঁটেই ওনাকে সঙ্গে নিয়ে থানায় এসেছেন। এই কথা শুনে অভিভূত হয়ে পড়া ডিউটি অফিসার রিটন সেখ এরপর তারাপদ বাবু ও ইব্রাহিম সেখকে কাছে ডেকে নেন । এই দু’জনকে চেয়ারে বসিয়ে তাঁদের সঙ্গে আরও নানা কথা বলেন ডিউটি অফিসার ।
কথোপকথনে ডিউটি অফিসার রিটন সেখ জানতে পারেন পাশাপাশি বাড়িতে বসবাস করেন তারাপদ রায় ও ইব্রাহিম মল্লিক । তাঁরা একে অপরের সুখ -দুঃখের নিত্যসঙ্গী । বিপদে আপদে তাঁরা একে অপরের ভরসা । কোন দিনের জন্য তারাপদ বাবু ও ইব্রাহিম মল্লিক একে অপরের সঙ্গে বিভেদ অশান্তিতে জড়াননি । তাঁরা দু’জনে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বোঝেন না । ধর্মীয় সুড়সুড়ি বোঝেন না । বুঝতে চানও না । খুশির ঈদ থেকে শুরু করে বকরিদ, মহরম, দুর্গাপূজা, কালীপূজা সবই তাদের কাছে এক বলে খণ্ডঘোষ থানার পুলিশ বাবুদের জানান তারাপদ রায় ও ইব্রাহিম মল্লিক । যা শুনে কার্যত স্তম্ভিত হয়ে যান থানার ডিউটি অফিসার রিটন সেখসহ অন্য পুলিশ বাবুরা । তাঁরা সবাই মুগ্ধ হয়ে ইব্রাহিম ও তারাপদকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে তাঁদের ছবিও তোলেন ।
পুলিশ কর্তারা এদিন বলেন , ‘তারাপদ ও ইব্রাহিমের এই স্নেহ ভালবাসার বন্ধন প্রমাণ করছে,স্বার্থান্বেষীরা চক্রান্ত যতই করুক না কেন ’মানবতা’ আজও বেঁচে আছে । সর্বধর্ম সমন্বয়ী মাতৃভূমি ভারতবর্ষের মাটিতে’। খণ্ডঘোষ থানার ওসি প্রসেনজিৎ দত্ত বলেন, ‘ইব্রাহিম মল্লিক ও তারাপদ বাবুর এই স্নেহের বন্ধন অটুট থাক । সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ুক তাঁদের পারস্পরিক স্নেহ ও ভালোবাসার বন্ধনের মায়াজাল ।’।