প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৩ মার্চ : স্বনির্ভর গোষ্ঠী(Self Help Group)তৈরিতে ‘দেশের সেরা’ স্বীকৃতি পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।ন্যাশনাল রুরাল লাইভলিহুড মিশনের বিচারে বাংলার এই শিরোপা পাওয়ার কথা মাস সাতেক আগে মুখ্যমন্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গর্বের সাথে ঘোষণা করেছিলেন।আর আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটের মুখে সেই গর্ব চুরমার করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে পূর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুর ব্লকের এক তৃণমূল নেতা, বিডিও, পঞ্চায়েতের প্রধান,উপ-প্রধান ও লেডি গ্রাম সেবিকার (lGS) বিরুদ্ধে ।প্রশাসনের কাছে তাঁদের বিরুদ্ধে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ ও অনিয়মে মদত দেওয়ার লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন একাধিক স্বনির্ভর গোষ্ঠীর নেত্রীরা । যা নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় পড়ে গিয়েছে জেলা প্রশাসন ও রাজ্যের শাসক দলের অন্দরে ।
জামালপুরের দোলোরডাঙ্গা এলাকার বাসিন্দা মীরাতাজ শেখ (বেগম)।জেলাশাসক,জেলা পুলিশ সুপার সহ প্রশাসনের নানা মহলে দায়ের করা অভিযোগে তিনি নিজেকে ‘নারী চেতনা মহিলা মাল্টি পারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের’ একজন পদাধিকারী বলে দাবি করেছেন। মীরাতাজের অভিযোগ,’নারী চেতনা মহিলা মাল্টি পারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের’ নামে বেআইনি নথীপত্র তৈরি করে
এবং তাঁর সই নকল করে জামালপুরের দুটি পৃথক
ব্যাঙ্ক শাখায় এ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে।যাঁরা মিলে পরিকল্পনা করে ওই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলো খুলেছেন তাঁদের মধ্যে ব্লকের বিডিও শুভঙ্কর মজুমদার, পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সভাপতি তথা বর্তমান ব্লক তৃণমূলের সভাপতি মেহেমুদ খাঁন,এল-জি-এস চন্দনা ঘোষ, জামালপুর-১পঞ্চায়েতের প্রধান ডলি নন্দী, উপ-প্রধান সাহাবুদ্দিন মণ্ডলও রয়েছেন । মীরাতাজ তাঁর দায়ের করা অভিযোগে আরও উল্লেখ করেছেন,তাঁর সই নকল করে তৈরি করা দুটি ব্যাঙ্ক এ্যাকন্টে রেখা দাস নামে একজনকে নেত্রী সাজানো হয়েছে।আর ওই দুটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে লেনদেনের মাধ্যমে কমবেশী ’আড়াই কোটি টাকা’ আত্মসাৎ করে নেওয়া হয়েছে বলে মীরাতাজের অভিযোগ ।
মীরাতাজ বেগম তাঁর অভিযোগে এও জানিয়েছেন,
খুবই গোপনে নারীচেতনা কো-অপারেটিভ
সোসাইটি লিমিটেডের“ নামে দুটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। তাই তিনি সহ তাঁদের গোষ্ঠীর অনেকেই সেটা জানতে পারেন নি।কিছুদিন আগে এমন খবর পাবার পর তিনি দুটি ব্যাঙ্কের অফিসে খোঁজ নিতে যান । তখন তাঁকে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ জানায় ’ব্লকের বিডিও শভঙ্কর মজুমদার,পঞ্চায়েত সমিতির পূর্বতন সভাপতি মেহেমুদ খাঁন,এল জি এস চন্দনা ঘোষ এবং তাদের সঙ্গী সাথীদের কথায় ওই অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে’।এমনটা জানতে পারার পরেই তিনি জামালপুর থানায় অভিযোগ জানাতে যান।থানা অভিযোগ নিতে অস্বীকার করায় অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্টার কো-অপারেটিভ সোসাইটির কাছে তিনি সবিস্তার জানান। পরে তিনি সমস্ত নথিপত্র নিয়ে এই ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্ট খোলার কারণ জানতে বিডিওর কাছে পৌছান। মীরাতাজের অভিযোগ , তাঁকে বিডিও বলেন,তুমি মহিলা হয়ে অনেক বাড়াবাড়ি করছো । তুমি যদি ভাল চাও,তাহলে আমাদের বিরুদ্ধে যে যে জায়গায় অভিযোগ দায়ের করেছ, সেই অভিযোগ প্রত্যাহার করে নাও । মীরাতাজ বলেন,বিডিও সাহেব এমন হুমকি দেবেন সেটা আমার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল ।তাই আমি নিরুপায় হয়ে জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তর ও মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে অভিযোগ জানিয়ে গোটা ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবি জানাতে বাধ্য হয়েছি ।
এই অভিযোগের বিষয়ে জেলাশাসক প্রিয়াংকা সিংলা বলেন,অভিযোগ পত্র পেয়েছি। খুবই গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে । অভিযোগের তদন্ত করতে বলা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে“।সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ডিস্ট্রিক্ট প্রোজেক্ট অফিসার আনন্দ ধারা বলেন,অভিযোগের তদন্তের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট হাতে আসার পর পরবর্তী যা পদক্ষেপ নেওয়ার নেওয়া হবে“।জেলার পুলিশ সুপার কামনাশিস সেন জানিয়েছেন,এমন বিষয় সংক্রান্ত অভিযোগ আমার দপ্তরে দাখিল হয়ে থাকলে অবশ্যই তার তদন্ত হবে। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মিললে আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া হবে ।
তবে শুধু মীরাতাজ বেগম একাই নয় । স্বনির্ভর গোষ্ঠী নিয়ে এমন আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আরো অনেক গোষ্ঠীর মহিলারাও করেছেন। জামালপুর-২ এবং আঝাপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা যে সব বিষয় নিয়ে জেলা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন তাও যথেষ্ট চমকে দেওয়ার মতোই।জামালপুর-২ পঞ্চায়েতের ’শ্রীমা মহিলা বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের’ সদস্য সুমিতা বর ও তপতী মালিক বলেন,স্বনির্ভর গোষ্ঠী নিয়ে চুড়ান্ত অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপোষণ চলছে। এল জি এস এবং প্রজেক্ট ডিরেক্টর (পি ডি) সহ যাঁরা যাঁরা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কাজকর্ম দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন তাদের ‘ঘুঁস’ না দিলে কোন গোষ্ঠী কাজ পায় না।আবার ‘ঘুস’ দিলেও যে কাজ মিলবে এমন নিশ্চয়তাও নেই । গোষ্ঠীর মহিলাদের প্রশিক্ষণের নামে লক্ষ লক্ষ টাকা দুর্নীতি হয় । কোন দল নেই,বডি মেম্বারও নয়,ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে লোন শোধ করেনি এমন কাউকে কাউকেও অনিয়ম করে সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে । অথছ যাঁরা সুযোগ সুবিধা পাবার যোগ্য তাঁরা সুযোগ সুবিধা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে । ধান ব্যবসা ও প্রাণী পালন ছাড়াও স্কুল ড্রেস নিয়ে সবথেকে বড় মাপের অনিয়ম ও আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে বলে ‘শ্রীমা মহিলা বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের’ সদস্যরা ব্লক ও জেলা প্রাশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়ে তদন্তের দাবি করেছেন ।
জামালপুরের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা এও জানান,বিভিন্ন সরকারী প্রকল্পের কাজ কর্ম সরজমিনে খতিয়ে দেখতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল জামালপুরে আসে । তখন তাদের কাছেও ব্লকের স্বনির্ভর গোষ্ঠী গুলির মহিলারা সমস্ত অনিয়ম ও আর্থিক দুর্নীতির কথা তুলে ধরেছিলেন।এর কিছুদিন পরেই নাটকীয় ভাবে এল-জি-এস চন্দনা ঘোষকে অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হয় । অন্যদিকে আঝাপুর পঞ্চায়েতের
নারীশক্তি সংঘ মহিলা সমবায় সমিতি লিমিটেডের
বভি মেম্বার উমা দাস বলেন,বছরের পর বছর ধরে আঝাপুরের বাসিন্দা ’ঝর্ণা বেগম’ একাই স্কুল ড্রেসে দেবার অর্ডার পেয়ে যাচ্ছেন ।এর পিছনেও রয়েছে বড় সড় কেলেঙ্কারি।প্রশাসন সঠিক তদন্ত করলে এই দুর্নীতিতে জড়িত রাঘববোয়ালদের’ মুখোশ খুলে যাবে। প্রশাসন দুর্নীতির তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা না করলে ব্লকের সকল প্রতাড়িত স্বনির্ভর গোষ্ঠীরা মহিলারা মিলে হাই কোর্টের দ্বারস্থ হবেন বলে উমা দাস হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ।
এই বিষয়ে বিডিও (জামালপুর)শুভঙ্কর মজুমদার বলেন,আমাকে দায়ী করে যেসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে সেগুলি সবই অসত্য এবং উদ্দেশ্য প্রণদিত। কোন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর নামে ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্ট খোলার সময় ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ গোষ্ঠীর সমস্ত নথিপত্র যাচাই করে নিয়ে তা করেন। এই বিষয়টি ব্যাঙ্ক ও গোষ্ঠীর নিজস্ব বিষয় । ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্ট খোলা ও ব্যাঙ্ক থেকে লোন নেওয়ার বিষয়ে ব্লক কিংবা জেলা প্রশাসন বা পঞ্চায়েতের কোন সম্পর্ক নেই । হুমকি দেওয়ার যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে সেটাও অসত্য এমন কোন ঘটনাই ঘটেনি বলে বিডিও দাবি করেছেন। স্কুল ড্রেসের অর্ডার ঝর্ণা বেগমের একার পাওয়া নিয়ে যে অভিযোগ উঠেছে সেই প্রসঙ্গে বিডিও বলেন, পূর্বেকার বছরে স্কুল ড্রেসের জন্য ব্লকের ১৩ টি গোষ্ঠী ঝর্ণা-র গোষ্ঠীর নাম প্রস্তাব করেছিল।আর এই বছর ব্লকের একাধীক গোষ্ঠী স্কুল ড্রেস তৈরির কাজ করছে বলে বিডিও দাবি করেছেন। পাশাপাশি বিডিও এও বলেন, কোন কাজ কার মাধ্যমে হবে সেই সিদ্ধান্ত সর্বপরি সরকারই নিয়ে থাকে। ।সরকারও নিশ্চই ঝর্ণা বেগমকে যোগ্য মনে করেছিল তাই সে স্কুল ড্রেসের অর্ডার পেয়েছিল । বিডিও এও জানান ,স্বনির্ভর গোষ্ঠী নিয়ে এত সমস্যা তৈরি হওয়ার অন্যতম কারণ হল অধিকাংশ গোষ্ঠীর বড়ির মেয়াদ পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাবার পরেও ভোট না হওয়া। কোঅপারেটিভ অ্যাক্টে গোষ্ঠী গুলির নির্বাচন করানোর জন্য থাকা প্রিজাইডিং অফিসারের পদ দীর্ঘদিন শূন্য থাকার করনে গোটা পূর্ব বর্ধমান জেলায় জটিলতা তৈরি হয়েছে ।
যদি ব্লক তৃণমূলের সভাপতি মেহেমুদ খাঁন দাবি করেছেন,বিডিও সাহেবের উপস্থিতি তে হওয়া
নির্বাচনের মাধ্যমে ’নারীচেতনা কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের’ বড়ি চেঞ্জ হয়েছে । সরকারী রুল মোতাবেক হওয়া ওই নির্বাচনের সিস্টেমের বিষয়ে বিডিও এবং এলজিএস ম্যাডাম সব জানেন। নারীচেতনার সমস্ত সসদ্যরা ওই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল বলে মেহেমুদ খাঁন দাবি করেছেন । তাঁর কথায়,এর পর নারীচেতনার নামে কটি ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল সেটি বিডিও এবং এলজিএস ম্যাডাম জানেন।স্বনির্ভর গোষ্ঠীর অর্থ নয়ছয় ও দুর্নীতির সুস্পষ্ট তথ্য প্রমাণ প্রশাসন পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতেই পারে বলে মেহেমুদ খাঁন মন্তব্য করেছেন ।।