এইদিন ওয়েবডেস্ক,ঢাকা,০৬ ফেব্রুয়ারী : ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি অর্ধেকের বেশি গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর সেই কর্মকাণ্ড বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে বাড়িতে থাকা বই, বিভিন্ন আসবাবপত্র, লোহা, ভাঙা গ্রিল, কাঠ- যে যার মতো যা পারছে লুটপাট চালাচ্ছে বুবুক্ষু বাংলাদেশিরা ।
ভারতে পালিয়ে আসা শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির ছয় মাস পূর্তির দিন বুধবার রাতে ‘বুলডোজার মিছিল’ কর্মসূচি থেকে এই ভাঙচুর শুরু হয়। রাতে একটি ক্রেন ও দুটি এক্সক্যাভেটর দিয়ে ওই বাড়ি ভাঙা শুরু হলেও সকালে দেখা যায় একটি এক্সক্যাভেটর। যান্ত্রিক ত্রুটির কথা বলে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় সেটিও সরিয়ে নেওয়া হয়।এদিকে ভাঙা দুই ভবন এবং পেছনের বর্ধিত জাদুঘর ভবন থেকে রড কেটে নিতে দেখা গেছে নিন্ম আয়ের মানুষদের। হাঁতুড়ি, শাবল, লোহা কাটার ব্লেড দিয়ে যে যার মতো কেটে বগলদাবা করছে । বয়ে এনে সড়কে স্তূপ করে সেখান থেকে রিকশা বা ভ্যানে করে সেসব কাটা রড, গ্রিল ও কাঠ সরিয়ে নিতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশের হাজারীবাগের বাসিন্দা সিরাজুল নামে একজন লুন্ঠনকারী ভ্যানে করে এমন নানান জিনিসপত্র বোঝাই করেছিল ।এগুলো কী করবেন, এ প্রশ্নের উত্তরে সে বলে,’ভাঙারির দোকানে নিয়া বেঁচমু, কী করমু আর। সবাই নিতেছে, আমিও নিলাম যা পাইছি আইসা।’ আধভাঙা ভবনের রড কাটছিলেন সুজন শেখ নামে একজন । তার কথায়,’ভাইঙাইতো ফেলতেছে, আমরা কিছু নিয়া যাই। যা পাই, তাই লাভ।’
দুপুর গড়ালেও পেছনের ওই ছয়তলা বর্ধিত জাদুঘরের ভবনটিতে শত শত মানুষ ঢুকছেন, আর বের হচ্ছে । ভবনটিতে থাকা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত বিভিন্ন বইগুলোও হাতে হাতে নিয়ে যাচ্ছে অনেকেই। সামনের আধাভাঙা ভবন দুটিতেও উৎসুক জনতার ঢল। কেউ কেউ ছবি তুলছে-ভিডিও করছে, আবার ক্ষণে ক্ষণে বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা গেছে।
সকাল থেকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে নানান স্লোগান দিলেও বেলা সাড়ে ১২টার দিকে বাড়িটির সামনে একটি মাইক নিয়ে অবস্থান নেয় একটি দল। মাইকেও তাদেরকে ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’; ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’; ‘বত্রিশ না ছত্রিশ, ছত্রিশ ছত্রিশ’; ‘একটা একটা লীগ ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর’; ‘দালালি না আজাদি, আজাদি আজাদি’ ‘খুনি হাসিনার ফাঁসি চাই’; ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাইরে’; ‘জনে জনে খবর দে, মুজিববাদের কবর দে’সহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা যায়। জিহাদুল ইসলাম নামে একজন বলে,কই গেল ক্ষমতার দম্ভ? কই গেল স্বজন হারানোর বেদনা? এই বাড়ির সামনে দিয়ে দিনের বেলাও হেঁটে যেতে পারতো না মানুষ। আজ সেই মানুষ এসে বাড়ি ভেঙে দিচ্ছে, যে যার মতো ইটগুলো খুলেও নিয়ে যাচ্ছে। স্বৈরাচারের এমন পরিণতি দেখে আশা রাখি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিক্ষা নেবে।
এর আগে ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনার পতনের দিন বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিজড়িত এই বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছিল। বুধবার ব্যাপক ভাঙচুরের পর ভেতরে পোড়ার মত যা কিছু আছে, তাতে ফের আগুন দিয়ে শুরু হয় বাড়ি ভাঙা।
সুধা সদনেও লুটপাট
শেখ হাসিনার অনলাইন ভাষণের পর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে ‘বুলডোজার মিছিল’ কর্মসূচি কেবল সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ৩২ নম্বরের বাড়ি গুড়িয়ে দেওয়ার মধ্যেই বুধবার রাত পৌনে ১১টার দিকে আগুন দেওয়া হয় ধানমন্ডি ৫-এ শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদনে।
বুধবার রাতে দেওয়া আগুন বৃহস্পতিবার সকালেও ভবনটির কোথাও কোথাও জ্বলতে দেখা গেছে। দুপুরে বাড়িটির ভেতরে প্রচণ্ড তাপের মধ্যেই সেখান থেকেও যে যার মতো রড, সোফা, চেয়ার, টেবিলসহ আধপোড়া বিভিন্ন আসবাব, এসি, ফ্রিজসহ বিভিন্ন জিনিসপত্রের ভাঙা অংশ, তার লুটপাট চালাতে দেখা গেছে লোকজনকে। এমন নানা সরঞ্জাম বাড়ির সামনে থেকে রিকশায় তুলছিল সালেহা আক্তার। এসবের গন্তব্যও ভাঙারির দোকান জানিয়ে সালেহা বলে, ‘সবতো পুইড়াই গেছে, সকাল সকাল অনেকেই আইসা যা পারছে নিয়া গেছে। আমিও টুকটাক যা পাইছি নিয়া যাই। বেইচা যদি কয়ডা টেহা পাওন যায়।’
শেখ হাসিনার স্বামী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার ডাক নাম ছিল সুধা মিয়া। তার নামেই এ বাড়ির নামকরণ। সুধা সদনের সামনের ভবনের একটি অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা জানান, গত তত্ত্বাবধায়ক আমলে শেখ হাসিনা এই বাড়িতে কিছুদিন ছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচন এখান থেকেই করেন তিনি। সেই নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি রাষ্ট্রীয় বাসভবনে থেকেছেন। এই বাড়িতে কিছুদিন আওয়ামী লীগের কিছু অফিস ছিল। পরে সেটি তালা মারাই থাকত। বিভিন্ন দিবসে এই বাড়িতে মাঝেমধ্যে এসেছেন শেখ হাসিনা। তার পুরো আমল জুড়ে এ বাড়ির নিরাপত্তায় নিরাপত্তা বাহিনীর প্রচুর সদস্য মোতায়েন থাকতেন।
আওয়ামী লীগ সন্দেহে নারীসহ দুজনকে গণপিটুনি
বাড়ি ভাঙার মধ্যেই আজ বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ভিড়ের মধ্যে আওয়ামী লীগ সন্দেহে এক নারীসহ দুইজনকে গণপিটুনি দিয়েছে কথিত ছাত্র-জনতার নামের লুন্ঠনকারীর দল। প্রত্যক্ষ্যদর্শীরা জানিয়েছেন, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ায় এক নারীকে এবং কথা বলার সময় ‘আপার বাড়ি’ বলায় এক পুরুষের ওপর হামলা চালিয়ে তাদেরকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে তাদের মারতে মারতে ধানমন্ডি-৩২ থেকে প্রধান সড়কে নিয়ে যায়। পরে এক ফটোসাংবাদিকসহ কিছু লোকজন তাদেরকে রিকশায় উঠিয়ে দেন। এসময় ঘটনাস্থলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্যকে দেখা যায়নি।।