প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধামান,১৪ আগষ্ট : ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে বর্ধমান জেলার নাম।দেশ মাতৃকাকে ব্রিটিশ শৃংখল মুক্ত করার শপথ নিয়ে এই জেলার অনেক বীর সন্তান বিপ্লবী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।তাঁদের মধ্যে অবশ্যাই অগ্রগণ্য এই জেলার সদর দক্ষিণ মহকুমার বটুকেশ্বর দত্ত, রাসবিহারী বোস, রাসবিহারী ঘোষ ও অনিল বরণ রায়। এই চার দেশবরেণ্য বিপ্লবীর নাম আজও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।এনারা ছাড়াও অবিভক্ত বর্ধমান জেলার আরও অনেকে আছেন যারা দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে জোরদার করার কাজে সামিল হয়েছিলেন।তাঁরা হয়তো বিস্মৃতির অতলে রয়ে গিয়েছেন। তবে দেশের ৭৫ তম স্বাধীনতা দিবসে তাঁদের প্রতিও শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে ব্রতি হবেন বর্ধমান জেলার আপামোর বাসিন্দা ।
ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায় ,লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ১৯০৫ সালে সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল তার ঢেউ আছড়ে পড়েছিল বর্ধমান জেলাতেও।শুধু শহর বর্ধমানের মানুষজনই নয় ,গ্রামীন বর্ধমানের মানুষজনও সেই সময়ে সামিল হয়েছিলেন বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ আন্দোলনে। তদানিন্তন সময় কালে অবিভক্ত বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামের সন্তান কাজী নজরুল ইসলামের দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা স্বাধীনতা আন্দোলনকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ১৯২৫ সালে বর্ধমানে এসে বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদের আতিথ্য গ্রহন করেছিলেন । এইসবের পরিপ্রেক্ষিতে ইতিহাসবিদরা মনে করেন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে কোন অংশেই কম ছিল না বর্ধমানের গুরুত্ব ।
স্বদেশী আন্দোলন থেকে শুরু করে বিপ্লবী আন্দোলন ,সবেরই উত্তোরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বর্ধমানের বিপ্লবীদের নাম । এই জেলার
জ্যোতিন্দ্রনাথ বন্দ্যেপাধ্যায় যৌবনে বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন । পরে অবশ্য তিনি
আধ্যাত্মিকতায় মনোনিবেশ করে ’নিরালঙ্গ স্বামী ’নামে পরিচিত হন । ১৮৭৬ সালে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ’ভারত সভা’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । সেই ’ভারত সভার’ তিনটি শাখা গড়ে উঠেছিল বর্ধমান জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ।
ওই শাখাগুলি বর্ধমান শাখা , কালনা শাখা ও পূর্বস্থলী হিতকরী সভা নামে আত্মপ্রকাশ করে
। কালনার কবিরাজ বংশীয় উপেন্দ্রনাথ সেন ও দেবেন্দ্রনাথ সেনের উদ্যোগে কালনা ও কাটোয়ায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ বিরোধী
সভা।ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা গিয়েছে সেই সভায় স্বয়ং সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন ।কালনা মহকুমা ইতিহাস ও পুরাতত্ব চর্চা কেন্দ্রের সভাপতি সিদ্ধেশ্বর আচার্য্য বলেন ,’স্বদেশী আন্দোলনের ঢেউ সেই সময়ে কালনার বাঘনা পাড়ার যুবক মহলে প্রভাব ফেলেছিল। ১৯০৬ সালে বিদেশী দ্রব্য লুঠ করে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল কালনার বাঘনা পাড়ার যুবকরা। সেই ঘটনায় ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন গৌর গোবিন্দ গোস্বামী, মণিগোপাল মুখোপাধ্যায়,সন্তোষ বন্দ্যোপাধ্যায়,বৃন্দাবন গোস্বামী ,বলাই গঙ্গোপাধ্যায় ও বলাই দেবনাথ । সিদ্ধেশ্বর বাবু এও বলেন, ‘এদের গ্রেপ্তারি সংক্রান্ত মোকদ্দমাই ছিল বঙ্গে প্রথম রাজনৈতিক মোকদ্দমা ।’ তদানীন্তন সময়ে বাঘনা পাড়ায় স্বদেশী ভাণ্ডারও প্রতিষ্ঠা হয়েছিল । ১৯৪২ শে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে বাঘনা পাড়ার যুবকরা জড়িত হয়েছিলেন বলে সিদ্ধেশ্বর আচার্য্য জানিয়েছেন।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে উৎসাহিত করার জন্য নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু দু’বার বর্ধমানে এসেছিলেন । ইংরেজ আমলে জাতীয় শিক্ষা নিয়েও বর্ধমান জেলা উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিল । ইংরেজি বিদ্যালয়ের পরিবর্তে জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপনে খণ্ডঘোষের তোরকোনা রাসবািহারী ঘোষ প্রভূত অর্থদান করেছিলেন। কালনা , বর্ধমান সদর,বৈকন্ঠপুর প্রভৃতি স্থানে জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় । বান্ধব সমিতি ,মহামায়া সমিতি প্রভৃতি নামে জেলার কালনা, পূর্বস্থলী ও মন্তেশ্বরে বিপ্লববাদী গুপ্তসমিতি গড়ে উঠেছিল। মানকরের জমিদার রাজকৃষ্ণ দিক্ষিত ও দুর্গাপুরের ভোলানাথ রায় সেই সময়ে স্বদেশী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে কারারুদ্ধ হন। স্বরাজ তহবিলের চাঁদা তোলার জন্য ১৯২১-২২সালে চিত্তরঞ্জন দাস বর্ধমানে এসেছিলেন। তাঁর আগমনে বর্ধমান জেলায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ভিন্ন মাত্রা পেয়েছিল। জাতীয়তাবাদী কবিতা লোখার জন্য বর্ধমানের জামালপুরের গোপালপুর গ্রাম নিবাসী গোবিন্দরাম বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্কুল থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল । ১৯২২ সালের ৫ জানুয়ারি এই গোপালপুরের ইংরেজ বিরোধী মানুষজনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা পায় গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয় । গান্ধীজীর
অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে
বিদ্যালয়ের প্রথম পরিচালন সমিতি এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়।সিদ্ধান্ত হয় , “ ইংরেজদের নিয়ম মেনে রবিবার নয় – বিদ্যালয় ছুটি থাকবে সোমবার।সেই থেকে আজও রবিবার পুরোমাত্রায় পঠনপাঠন চালু থাকে গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয়ে । এই বিদ্যালয় ছুটি থাকে সোমবার ।
পরাধীন ভারতবর্ষের মাটিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ভিন্নমাত্রায় পৌছে দিতে বর্ধমানের মহিলারাও মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। এই বিষয়ে উল্লেখযোগ্য নির্মলা সান্যাল ও সুরমা মুখোপাধ্যায়ের নাম । ১৯৩১ সালে কংগ্রেসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বর্ধমান জেলা কৃষক সমিতি’। তদানিন্তন কালেই কৃষক সমিতির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যে সভার সভাপতি হয়েছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ।তাঁর নামেই পরবর্তীকালে হাটগোবিন্দপুরে গড়ে ওঠে ভূপেন্দ্রনাথ মহাবিদ্যালয় ।
পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের সহ-সভাধীপতি দেবু টুডু বলেন , দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে
অবিভক্ত বর্ধমান জেলাবাসীর অবদান কোন অংশেই কম ছিলনা। এই জেলার বটুকেশ্বর দত্ত ,রাসবিহারী বসু ,রাসবিবাহী ঘোষ, অনীল বরণ রায় প্রমুখ দেশবরেণ্য বিপ্লবীর নাম দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। এনারা ছাড়াও জেলার আরও যারা দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন তাঁদের অবদানও জেলাবাসী মনে রেখেছে । ৭৫ তম স্বাধীনতা দিবসে বর্ধমানবাসী সকল বিপ্লবী স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহন কারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে তাই ব্রতী হবেন ।।