প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,০৫ জুলাই : আদালতে বিচারাধীন থাকা মামলার বিচারের জন্যে ডাকা হয়েছিল সালিশী সভা ! সেই সালিশী সভায় হাজির না হওয়ার চরম মাশুল এখন গুনতে হচ্ছে বৃদ্ধ দম্পতি ও তাঁর ছেলেকে। তাদের ব্যাপক মারধর করার পাশাপাশি খুনেরও হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এক তৃণমূল নেতার সাগরেদদের বিরুদ্ধে।আর অমন ভয়ংকর হুমকি শোনার পরেই প্রাণ বাঁচাতে ওই বৃদ্ধ দম্পতি ও তাঁর ছেলে বাধ্য হয়েছেন নিজেদের ঘর বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পালাতে ।পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর থানার কুবাজপুর গ্রামের এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই তোলপাড় পড়ে গিয়েছে।প্রতিবাদে স্বোচ্চার হয়েছে বিরোধীর।তারই মধ্যে ন্যায় বিচার পাওয়ার প্রত্যাশায় বৃদ্ধা দ্বারস্থ হয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর। এমনকি তিনি তাঁদের উপর হওয়া হামলা ও আক্রমনের সবিস্তার লিখিত ভাবে রাজ্য পুলিশের ডি-জি,জেলার পুলিশ সুপার ও জেলাশাসককেও জানিয়েছেন।প্রশাসন কি ন্যায় বিচার দেয়,সেই দিকেই এখন তাকিয়ে অসহায় বৃদ্ধ দম্পতি। জেলার পুলিশ সুপার আমন দীপ জানিয়েছেন,অভিযোগের তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে ।
জামালপুর ব্লকের চকদিঘী পঞ্চায়েত এলাকার প্রত্যন্ত গ্রাম কুবাজপুর।এই গ্রামেই বাড়ি কৃষিজীবী পরিবারের বৃদ্ধ দম্পতি শেখ বোরহান আলি ও সাহানারা বিবি’র।তাঁদের সঙ্গেই একই বাড়িতে থাকেন তাঁদের ছেলে শেখ বসির আলি।বৃদ্ধা সাহানারা বিবি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সহ পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তাদের জানিয়েছেন,’২০১৮ সালে তাঁর ছেলে বসির আলির সঙ্গে বর্ধমান থানা এলাকা নিবাসী এক তরুণীর বিয়ে হয়। কিন্তু ছেলের বিবাহিত জীবন সুখের হয় না।বৌমা তাঁর বাবার বাড়িতে চলে যায়।পরে বৌমা ’বধূ নির্যাতনের’ অভিযোগ এনে মামলা করে।ওই মামলায় বর্ধমান সিজেএম আদালত তাঁদের জামিন মঞ্জুর করে। এরপর বৌমা ’খোরপোষের’ মামলা করে।সেই মামলা এখন বর্ধমান আদালতের বিচারাধীনে রয়েছে।
সাহানারা বিবির অভিযোগ,’আদালতে বিচারাধীন ওই মামলার বিচার এখন আদালতকে টপকে করতে চাইছেন তাঁদের এলাকার তৃণমূলের নেতা। সেই কথা জানাতে,’গত ১৩ জুন তাঁদের বাড়িতে আসে চকদিঘী অঞ্চল তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি আজাদ রহমানের সাগরেদরা।তারা জানিয়ে যায়,’আমাদের বৌমার করা মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে আজাদ রহমান চকদিঘী অঞ্চল তৃণমূল কংগ্রেস অফিসে বিচারসভা ডেকেছে। ১৪ জুন সেই বিচার সভায় আমাদের পরিবারের সবাইকে হাজির থাকতে হবে।’ আজাদ রহমানের সাগরেদরা ওই দিন এও জানিয়ে যায়,“আমরা যদি আজাদ রহমানের বিচার সভায় হাজির না হই,তাহলে তারা আমাদের বাড়ি ঘর ভাঙচুর করে, বাড়ি জ্বালিয়ে দেবে। এমনকি আমাদের প্রাণে মেরে দেওয়া হবে বলেও তারা হুমকি দিয়ে যায় ।
এমন হুমকি পেয়েই ওই দিন সন্ধ্যায় বৃদ্ধা সাহানারা বিবির ছেলে শেখ বসির আলি জামালপুর থানায় অভিযোগ দায়ের করেন বলে জানান।সাহানারা বিবির কথা অনুযায়ী,“জীবনহানির শঙ্কায় তাঁরা কেউ ১৪ জুন চকদিঘীর তৃণমূল পার্টি অফিসে আজাদ রহমানের বিচার সভাতে যান নি।তার কারণে ওইদিন রাতেই লাঠি-সোটা ও ধারালো অস্ত্র সস্ত্র নিয়ে তাঁদের বাড়িতে চড়াও হয় আজাদ রহমানের ১২ জন সাগরেদ সহ আরো অনেকে।তারা বলতে থাকে,’আমরা শাসকের শাসন করতে এসেছি’।এই টুকু কথা বলেই তাঁর ছেলে বসির আলিকে ব্যাপক মারধোর শুরু করেদেয় আজাদের সাগরেদরা।তারা বসিরকে প্রাণে মেরে দিতে বসিরের গলায় পা তুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।এমনটা দেখে তিনি ও তাঁর স্বামী তাঁদের ছেলে বসির কে বাঁচাতে যান।তখন তাঁদের উপরেও হামলা আক্রমণ শুরু হয়ে যায়।আজাদ রহমানের সাগরেদরা তাঁর শ্লীলতাহানি করা শুরু করলে তিনি ও তাঁর স্বামী চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেন।
সাহানারা বিবির করা অভিযোগ অনুযায়ী তাঁদের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে কোন স্থানীয় কোন সহৃদয় ব্যক্তি জামালপুর থানায় ফোন করে দেন।সেই ফোন পেয়ে পুলিশ তাঁদের বাড়িতে পৌছায়।পুলিশ তাঁদেরকে উদ্ধার করে জামালপুর হাসপাতালে নিয়ে যায়।সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা করে চিকিৎসকরা মারধোরে জখম বসির কে বর্ধমান হাসপাতালে স্থানান্তর করেন।চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে বসির ওই দিনের হামলা মারধরের ঘটনার সবিস্তার ফের জামালপুর থানায় গিয়ে জানান।কিন্তু কোন ব্যবস্থা গৃহীত না হওয়ায় আজাদের ওই সগরেদরা আজও বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।এই অবস্থায় প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে ঘর বাড়ি,ফসল ফলে থাকা চাষের জমি,গবাদি পশু সব ফেলে রেখে তাঁদের বাড়ি ছাড়া হতে হয়েছে বলে সাহানারা বিবি জানিয়েছেন ।পাশাপাশি তিনি এও বলেছেন,প্রশাসন নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করলে তাঁদের আর বাড়ি ফেরা হবে না ।
বৃদ্ধার ছেলে বসির আলি জানিয়েছেন,ভবঘুরে হয়ে অর্ধাহারে অনাহারে এখন তাঁদের দিন কাটাতে হচ্ছে।এই কারণে তাঁর বৃদ্ধ বাবা বোরহান আলি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।মায়েরও শরীর ভালো যাচ্ছে না।তাঁদের চাষের জমির ফসল এখন জমিতে পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে।এই ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়।এই ভাবে চলতে থাকলে তাঁদের স্বপরিবার ’আত্মহত্যা’ করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না ।
এদিকে বৃদ্ধার আনা অভিযোগ নিয়ে তোলপাড় পড়তেই চকদিঘী অঞ্চল তৃনমূল কংগ্রেসের সভাপতি শেখ আজাদ রহমান সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।তিনি বলেন,’বসির আলির পরিবাকে আমি চিনি।তাদের যে মামলার বিচার আদালতে চলছে তার বিচারের জন্য আমি কোন বিচারসভা বা সালিশি সভা ডাকি নি। তবে খোঁজ নিয়ে জেনেছি বসিরের পরিবারের সাথে যে ঘটনা ঘটছে সেটা গ্রাম্য বিবাদ জনিত ঘটনা। মিথ্যা করে ওই ঘটনার সঙ্গে আমার নাম জড়ানো হয়েছে।’
জেলা তৃণমূলের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় বলেন,’এমন ঘটনা বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। আমি খোঁজ খবর নেব। আভিযোগ সত্য হলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে ।’ যদিও সিপিএমের মহিলা সংগঠন সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির রাজ্য কমিটির সহ-সভানেত্রী ভারতী ঘোষাল বলেন, ‘কুবাজপুরের বৃদ্ধা সাহানারা বিবি যে অভিযোগ এনেছেন তা সত্যি মারাত্মক।ওই বৃদ্ধার আনা অভিযোগই প্রমাণ করেদিচ্ছে বাংলায় এখন আর আইনের শাসন নেই ।চোপড়া থেকে শুরু করে কুবাজপুর, সব জায়গার ছবিটা এখন একই।তৃণমূল নেতারাই এখন আইন,তৃণমূলের নেতারই এখন আদালত হয়ে গিয়েছে।এ সবের জন্যেই আজকের পশ্চিমবঙ্গ মহিলাদের কাছে ’আতঙ্কের রাজ্য’ হয়ে উঠেছে।’ গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি সাহানারা বিবির পরিবারের পাশে দাঁড়াবে বলে ভারতী ঘোষাল জানিয়েছেন।
একই ভাবে ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন জেলা বিজেপির সহ-সভাপতি মৃত্যুঞ্জয় চন্দ্র।তিনি বলেন, ‘জামালপুরের কুবাজপুরের বৃদ্ধ দম্পতি ও তাঁর ছেলের উপর বর্বরোচিত হামলা,আক্রমণ ও হুমকির ঘটনাই প্রমাণ দিচ্ছে,পশ্চিমবঙ্গে এখন আর আইনের শাসন নেই। এখন বঙ্গে তৃণমূলী তালিবানি শাসন’ চলছে ।’।