এইদিন ওয়েবডেস্ক,বিহার,২০ জুন : মুঘল হানাদারের নাশকতার স্মৃতি ভুলে বুধবার নবরূপে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী । ৪২০-৩০ সালের দিকে যখন সারা পৃথিবীতে ধর্মশিক্ষা বা পারিবারিকভাবে শিক্ষালাভের বাইরে তেমনভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরুই হয়নি, ঠিক সেই সময়ে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় দশ হাজার ছাত্র ও ২০০০ শিক্ষক নিয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল । নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে মহাচার্য শীলভদ্র, ধর্মপাল, আর্যভট্ট, অতীশ দীপঙ্করের মত মহান পন্ডিতরা অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করেছেন । নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বাধিক আলোচিত এবং চিত্তাকর্ষক ভবনটি ছিলো এর গ্রন্থাগারটি । ৯০ হাজারের অধিক পবিত্র ও বিরল শাস্ত্রের এই গ্রন্থাগারটি ছিল একটি বিশাল এলাকা জুড়ে । গ্রন্থাগারটির ভবন নয়তলা উঁচু ছিলো। ওই সময়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে শব্দবিদ্যা, হেতুবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা,দর্শনশাস্ত্র, ধর্মশাস্ত্র, বৌদ্ধধর্ম, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, শরীরতত্ববিদ্যা, সংগীত, চিত্রকলাসহ একাধিক বিষয় পড়ানো হতো । কিন্তু ১২ শতকে বর্বর, নৃশংস মুঘল হানাদার বখতিয়ার খিলজি দ্বারা ধ্বংস করা হয়েছিল মহান এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে । সেখানে উপস্থিত সমস্ত অধ্যাপক ও পড়ুয়াদের হত্যা করা হয়েছিল ৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারটি তিন মাস ধরে জ্বলতে থাকে ।
বুধবার বিহারের রাজগীরে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন,’নালন্দা শুধু একটি নাম নয়। নালন্দা একটি পরিচয়, একটি সম্মান। নালন্দা একটি মান, একটি মন্ত্র, একটি গর্বের গল্প। নালন্দা হল সেই সত্যের ঘোষণা যে বই আগুনের শিখায় জ্বলতে পারে, কিন্তু আগুনের শিখা জ্ঞানকে মুছে দিতে পারে না।’ তিনি আরও বলেন,’নালন্দা ভারতের সৌভ্রাতৃত্বের মন্ত্র ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’-এর আত্মা । এই বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ভারত নয়, গোটা এশিয়ার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বছরের পর বছর ধরে এখানে পড়ুয়ারা জ্ঞান অর্জন করতে এসেছেন। বর্তমানে নালন্দায় ২০টির বেশি দেশের ছাত্রছাত্রী অধ্য্যন করছেন ।’ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস উদ্বোধনের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান নালন্দার প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শন করেন।
নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসটি ঐতিহাসিক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রতিরূপ হিসাবে তৈরি করা হয়েছে।ক্যাম্পাসে ৪০ টি শ্রেণীকক্ষ সহ দুটি একাডেমিক ব্লক রয়েছে, যার মোট বসার ক্ষমতা প্রায় ১৯০০ জন। এটির প্রতিটিতে ৩০০ টি আসনের ধারণক্ষমতার দুটি অডিটোরিয়াম রয়েছে। এটিতে প্রায় ৫৫০ শিক্ষার্থীর ধারণক্ষমতা সহ একটি ছাত্র হোস্টেল রয়েছে। রয়েছে একটি আন্তর্জাতিক কেন্দ্র, একটি অ্যাম্ফিথিয়েটার যা ২০০০ জনের বসার মত সভাকক্ষ । একটি ফ্যাকাল্টি ক্লাব এবং একটি ক্রীড়া কমপ্লেক্স সহ অন্যান্য বিভিন্ন সুবিধা রয়েছে নতুন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৷ ক্যাম্পাস একটি ‘নেট জিরো’ গ্রিন ক্যাম্পাস,এটি সোলার প্ল্যান্ট, গার্হস্থ্য এবং পানীয় জল শোধনাগার, বর্জ্য জল পুনঃব্যবহারের জন্য একটি জল পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্ল্যান্ট,১০০ একর জলাশয় এবং অন্যান্য অনেক পরিবেশ-বান্ধব সুবিধাগুলির সাথে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তোলা হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ।
পাটনা থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত নালন্দা। পঞ্চম শতাব্দীতে বুদ্ধের সময়ে নালন্দার বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এটি পরবর্তী ৭০০ বছর ধরে বিকাশ লাভ করেছিল। পাল যুগের শেষভাগে এর পতন শুরু হয়, কিন্তু চূড়ান্ত আঘাত আসে ১২০০ খ্রিস্টাব্দে,বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের সময় । ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ-বিন- বখতিয়ার খিলজির নেতৃত্বে ধ্বংস করা হয়েছিলো নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। বাঙালি ঐতিহাসিক দীনেশ চন্দ্র সেন তাঁর ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল ‘বৃহৎ বঙ্গ’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে (পৃষ্ঠা ৫২৭) লিখেছেন,’মহম্মদ বক্তিয়ার যেমনি কুৎসিতদর্শন ছিলেন, তেমনি খুব ক্রুর ও নির্মম ছিলেন । বিহারে তিনি এরূপ নির্ব্বিচারে হিন্দুদিগকে হত্যা করিয়াছিলেন যে, সঙ্ঘারামের সম্বন্ধে মোটামুটি কয়েকটা প্রশ্ন করিয়া বিষয়টা জানিবার চেষ্টা করিয়া শুনিলেন নগরে একটিও হিন্দু নাই। একটা বিরাট সঙ্ঘারামকে তাহারা দূর্গ বলিয়া ভ্রম করিয়া আক্রমণ করিলেন। মুণ্ডিত-মস্তক নিরীহ বৌদ্ধাচার্যগণকে শত্রু-সেনাপতি মনে করিয়া অসহায় অবস্থায় ও অরক্ষিতে তাঁহাদের জীবন নষ্ট করিলেন, তখন পর্যন্তও খিলজি বুঝিতে পারেন নাই যে তিনি শত শত একান্ত নিরীহ, অধ্যয়নরত শ্রমণগণের প্রাণ নষ্ট করিয়াছেন। পরে তাহার চক্ষু আসিয়া ঠেকিল বিহারের বিরাট পাঠাগারের প্রাচীরের নিকট।’
জানা যায়, কয়েক বছর পরে, কিছু সন্ন্যাসী নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসার সাহস করেছিলেন। তবে এটি পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছিলো এবং ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ-বিন-বখতিয়ার খিলজির সন্ত্রাসের হৃদয়হীন ক্রোধের কারণে চেষ্টা করা হলেও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় তেমন আকর্ষণ অর্জন করতে পারেনি ।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় এবং এরকম আরো কিছু প্রাচীন ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করা না হলে এবং দিনে দিনে তাদের শ্রীবৃদ্ধি ঘটলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে বর্তমান বিশ্বে ভারতীয় উপমহাদেশই হয়তো আজ নেতৃত্ব দিত ।
পশ্চিমা বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুবছর পরে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে । কায়রোতে আল আজহার ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয় ৯৭২ সালে, যা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর পর। ইতালির বোলোনিয়া ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১০৮৮ সালে এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ১০৯৬ সালে অস্তিত্বলাভ করে, যা ১১৬৭ সাল থেকে পূর্ণাঙ্গভাবে কাজ শুরু করে। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি জন্ম নেয় ১২৩১ সালে ও আমেরিকার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ১৬১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের বিবরণ থেকে জানা যায়, নালন্দার শিক্ষা ছিলো সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা সবই ছিলো বিনামূল্যে। মূল ব্যয় বহন করতেন দেশের রাজা। জনসাধারণও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে সন্ন্যাসী ও ছাত্রদের জন্যে খাদ্যদ্রব্য, বস্ত্র ইত্যাদি দান করতেন। এখানে মূলত স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা প্রদান করা হতো। ভর্তি প্রক্রিয়া ছিলো অত্যন্ত প্রতিযোগিতাপূর্ণ কারণ দেশি-বিদেশি বহু শিক্ষার্থীর স্বপ্ন ছিলো নালন্দায় পড়াশোনা করার। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শীলভদ্র সমস্ত শাস্ত্র ও সূত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। এই বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও দার্শনিকের জন্ম ৫২৯ সালে এবং তিনি হিউয়েন সাঙ-এর গুরু হিসেবেই সবচেয়ে বেশি পরিচিত। তাঁর গুরু ছিলেন ধর্মপাল।মুঘল হানাদাররা ভারতীয় সংস্কৃতির কি অপুরণীয় ক্ষতি করেছে তার প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ।।