প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,০৩ অক্টোবর : রাজ্যের শিক্ষা দফতরের কেউ কোনদিন মুখ ফিরেও তাকান নি।তবুও শিক্ষকের আকালে বন্ধ হতে বসা এই রাজ্যেরই পূর্ব বর্ধমান জেলার একটি জুনিয়র হাই স্কুল চালিয়ে যাচ্ছেন পাঁচ শিক্ষিত বেকার যুবক যুবতী এবং এক অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক।তাঁরা কোন বেতন বা সান্মানিকও পান না। শুধুমাত্র ছাত্র ছাত্রীদের শিক্ষা লাভের আকাঙ্খা পূরণের জন্য তাঁরা বছরের পর বছর ধরে স্কুলে পাঠ দান করে যাচ্ছেন জেনে স্তম্ভিত বাংলার রাজ্যপাল।
জেলার জামালপুর ব্লকের বসন্তপুর জুনিয়ার হাই স্কুল ছয় শিক্ষক শিক্ষিকার এই মহানুভবতার খবর গত ২০ সেপ্টেম্বর ‘এইদিন’ কে প্রথম জনসমক্ষে আনে। তার পর শারদোৎসব কাটতে না কাটতেই ওই স্কুলটির বিষয়ে খোঁজখবর নিলেন স্বয়ং বাংলার রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস ।আর রাজ্যপাল খোঁজ খবর নেওয়ার পর থেকেই স্কুলটির হাল ফেরার ব্যাপারে আশার আলো দেখছেন স্কলটির শিক্ষক শিক্ষিকারা ।
জামালপুরের পাড়াতল-১ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার প্রত্যন্ত গ্রাম বসন্তপুর । একদা এই গ্রামের ছেলে মেয়েদের শিক্ষা লাভের ভরসা বলতে ছিল শুধুমাত্র
একটি প্রাথমিক স্কুল।আশপাশেও ছিল না কোন জুনিয়র হাই স্কুল বা হাই স্কুল। তাই লেখাপড়া শেখার জন্য বসন্তপুর ও তার সংলগ্ন বেত্রাগড়, সজিপুর প্রভৃতি গ্রামের ছেলে মেয়েদের প্রায় ৫-৭ কিলোমিটার দূরে জামালপুর বা সেলিমাবাদ হাই স্কুলে যেতে হত।এই দূরত্ব স্কুল বিমুখ করে তুলছিল এলাকার দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর পরিবারের ছেলে মেয়েদের।বিষয়টি নিয়ে বসন্তপুর গ্রামের অনেক মানুষজনই ভাবিত হয়ে পড়েন।এমন এক সময়ে গ্রামের ছেলে মেয়েদের শিক্ষার স্বার্থে একটি জুনিয়র হাই স্কুল গড়ার জন্য অগ্রণী ভূমিকা নেন স্থানীয় অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঘোষ।
এবিষয়ে দ্বিজেন্দ্রনাথ বাবু জানান,বসন্তপুর গ্রামে একটি জুনিয়র হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ২০১০ সালের প্রথম থেকে লড়াই শুরু করেন।এই ব্যাপারে তিনি গ্রামের মানুষজন এবং তদানিন্তন জামালপুর ব্লকের স্কুল পরিদর্শক (এস আই) সমরেশ দাসের প্রভূত সহযোগীতা পান।ওই বছরের জুন মাসে শিক্ষা দফতর থেকে বসন্তপুর গ্রামে জুনিয়র হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার সবুজ সংকেত মেলে।স্কুলের একটি ঘর তৈরির জন্য ৪ লক্ষ ৫৫ হাজার টাকাও অনুমোদন হয়ে যায়। কিন্তু অনুমোদনের নথিতে ত্রুটি থাকায় ’প্রপোজাল’ ফেরৎ চলে যায়।এরপর থেকে স্কুল ঘর তৈরি নিয়ে টালবাহানা চলতেই থাকে।এমনকি স্কুলের জন্য জমি পাওয়া নিয়েও চুড়ান্ত জটিলতা তৈরি হয়। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি ।
দ্বিজেন বাবুর কথা অনুযায়ী শেষমেষ স্কুল তৈরির জন্য সরকারের তরফে বসন্তপুর গ্রামে দুই বিঘার মত জমি’ বরাদ্দ করা হয়।তারপর পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি ওই জমির তথ্য উল্লেখ করে সেখানে স্কুল তৈরির অনুমোদন দেয়।পূর্বে পাওয়া ৪ লক্ষ ৫৫ হাজার টাকায় ওই বছরেরই শেষের দিকে স্কুল ঘর তৈরির কাজ শুরু হয়।ছাত্র ছাত্রীদের পড়ানোর জন্য চারজন ’গেস্ট টিচারও’ মেলে।এখন স্কুলের ১৩৯ জন পড়ুয়ার মিডডে মিল রান্নার ঘর ছাড়াও টিচার্স রুম সহ পাঁচটি ঘর রয়েছে।এছাড়াও অপর একটি ঘরের নির্মান কাজ চলছে ।
তবে সময় গড়ানোর সাথে সাথে স্কুলে শিক্ষকের আকাল দেখা দিলে স্কুল চালানো নিয়ে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়। তাই স্বস্তিতে নেই বসন্তপুর জুনিয়র হাই স্কুলের পড়ুয়ারা,অভিভাবক ও এলাকার শিক্ষানুরাগী মানুষজন। তারা এখন স্কুল বন্ধ হয়ে যাবার আশঙ্কায় ভুগছেন।এমন আশঙ্কা তৈরির কারণটাও যথেষ্ট চমকে দেওয়ার মতই ! দ্বিজেন ঘোষ বলেন, ‘আমাদের স্কুলের জন্য ২০১৮ সালে তিনজন স্থায়ী শিক্ষক অনুমোদন হয়েছিল । কিন্তু বাস্তবে এখনও পর্যন্ত স্কুলে একজনও স্থায়ী শিক্ষক নেই ।অতিথি শিক্ষকদের অধিকাংশই ইতিমধ্যে অবসর নিয়ে ফেলেছেন।এখন গোটা স্কুলের দায়িত্বে রয়েছেন মাত্র একজন অতিথি শিক্ষক। তিনিও অসুস্থ । এই অবস্থায় শিক্ষকের আকালের কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয় ।’
এমন পরিস্থিতিতে স্কুলে তালা পড়া আটকাতে বেতনের প্রত্যাশা না করেই তিনি এবং আরো পাঁচ শিক্ষিত বেকার যুবক যুবতী পড়ুয়াদের পাঠদানের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন বলে দ্বিজেন বাবু জানান । পাশাপাশি তিনি এও জানান,ওই বেকারদের মধ্যে সুমন মাঝি ও শ্বাগতা ঘোষ বাংলায় এম এ এবং শিল্পা সাহা ভূগোল ও সহেলি মণ্ডল ইতিহাস বিষয়ে এম এ পাশ করেছে। আর বিশ্বজিৎ মিত্র বিএসসি পাশ। এদের বেশীরভাগ জনের বি এড কোর্সও সম্পূর্ণ করা রয়েছে।দ্বিজেন বাবু বলেন,নিঃস্বার্থে এই শিক্ষিত ছেলে মেয়েরা পাশে দাঁড়িয়েছে বলেই এখনও স্কুলটি টিকিয়ে রাখা গেছে। তবে স্থায়ী শিক্ষক ছাড়া এইভাবে আর কতদিন স্কুলটি চালানো সম্ভব হবে তা নিয়েও দ্বিজেন বাবুও সংশয় প্রকাশ করেছেন।
এলাকার ছাত্র ছাত্রীদের শিক্ষার স্বার্থে পাঁচ উচ্চ শিক্ষিত বেকার যুবক যুবতী এবং অবসরপ্রাপ্ত এক প্রবীণ শিক্ষকের এমন অবদানের কথা জেনে কুর্ণিশ না জানিয়ে পারেন নি জেলাশাসক পূর্ণেন্দু মাজী। ‘এইদিন’কে তিনি বলেন,’স্কুল বাঁচাতে পাঁচ শিক্ষিত বেকার যুবক যুবতীর নিঃস্বার্থে পাঠদানের বিষয়টিকে কুর্ণিশ জানাই ।’
লক্ষ্মী পুজো শেষে স্কুল খোলার পর বৃহস্পতিবার দ্বিজেনবাবু বলেন,’আমাদের স্কুলের দুরাবস্থার বিষয়টি বাংলার রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস মহাশয়ও জানতে পেরেছেন। রাজ্যপাল মহাশয়ের নির্দেশে ওনার দফতরের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক দিন কয়েক আগে আমায় ফোন করেন । তিনি আমার কাছে আমাদের স্কুলের বর্তমান অবস্থা, সমস্যা সহ সবিস্তার জানতে চান।’
এমনকি রাজ্যপাল মহাশয় যে কোন দিন আমাদের স্কুলে আসতে পারেন ,এমন ইঙ্গিতও ওই আধিকারিক দিয়েছেন বলে দ্বিজেনবাবু জানান।
রাজ্যপালের দফতর স্কুলটির বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়ায় কিছুটা হলেও আপ্লুত দ্বিজেনবাবু সহ অপর শিক্ষক শিক্ষিকারা । দ্বিজেনবাবুর আশা,’এবার হয়তো বসন্তপুর জুনিয়র হাই স্কুলের সুদিন ফিরবে ।’ জামালপুর ব্লকের স্কুল পরিদর্শক অনিন্দিতা সাহা বলেন,’রাজ্যপাল দফতর থেকে ফোন করেছিল বলে শুনেছি। ওই স্কুলের সমস্যা মেটাতে আমরাও সচেষ্ট। ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো রয়েছে ।’।