প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৯ ডিসেম্বর : ডোকরা শিল্পে অসামান্য কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরুপ রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে পুরস্কার মিললেও তাতে ভাগ্যের চাকা ঘোরে নি।তাই এখন নিদারুন কষ্টেই দিন কাটছে পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের দরিয়াপুরের প্রখ্যাত ডোকরা শিল্পী রামু কর্মকারের । সেরিব্রাল স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার পর শারীরিক সক্ষমতা কমে যাওয়ায় তিনি শিল্পের কাজ আর করতে পারছেন না। সেই কারণে সংসারে দেখা দিয়েছে দৈনতা। তবুও জোটেনি শিল্পী ভাতা।এই অবস্থায় একান্তই নিরুপায় হয়ে কিছু উপার্জনের আশায় রামুবাবু এখন তাঁর বাড়ি লাগোয়া জায়গায় একটা ছোট গুমটি দোকান খুলে চালাচ্ছেন।তারই ফাঁকে ফাঁকে শিল্পী ভাতার জন্য নানা মহলে দরবার করে যাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত এই ডোকরা শিল্পী ।
মানুষ যখন পাথরের যুগ পেরিয়ে ধাতুর যুগে পা রেখেছিল,সেই তখনকার শিল্পকর্মই হল ডোকরা। দেশজ পদ্ধতিতে কাঁসা,পিতল ও তামা গলিয়ে মোমের ছাঁচে ফেলে ঢালাই করে শিল্পীরা এই শিল্পের কাজ করেন। মুর্তি, বিগ্রহ পুতুল ছাড়াও
ডোকরার নানা অলংকারও তৈরি করেন শিল্পীরা।
সেই ডোকরা শিল্পের খাসতালুক হিসাবে এখন আউশগ্রামের দিকনগর ২ পঞ্চায়েতের অন্তর্গত দরিয়াপুরের খ্যাতি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে।এখানকার ৫০-৬০ ঘর বাসিন্দার সকলেই
ডোকরা শিল্পের কাজের সঙ্গে যুক্ত।ডোকরা শিল্পের কাজ করেই তাঁদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিল্পীরাও মাঝে মধ্যে দরিয়াপুরে আসেন ডোকরা শিল্পের আঁতুড়ঘরের শিল্পীদের কাজ দেখতে ও কাজ শিখতে।মূলত কল্পনা,বৈচিত্র ও কারিগরি এই তিনটের সংমিশ্রণ ঘেটেছে গ্রাম বাংলার এই লোকশিল্পে।দেশ বিদেশের উচ্চবিত্তদের ড্রয়িংরুম ও অভিজাত প্রতিষ্ঠানে এই শিল্পকর্ম এখন পাকাপাকি ভাবে জায়গাও করে নিয়েছে।
রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরষ্কার নেওয়ার মুহুর্তে শিল্পী রামু কর্মকার
ডোকরা শিল্পের কাজে অসামান্য কৃতিত্বের স্বীকৃতি
স্বরুপ এই দরিয়পুরের একাধিক শিল্পী রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৬৬ সালে এই গ্রামের যে শিল্পী প্রথম রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছিলেন সেই শিল্পীর নাম শম্ভু কর্মকার।এর ২০ বছর পরে ১৯৮৬ সালে হারাধন কর্মকার এবং ১৯৮৮ সালে মটর কর্মকার ও বৈকুণ্ঠ কর্মকার রাষ্ট্রপতি পুরস্কার লাভ করেন। তার পর থেকে দীর্ঘ ২৩ টা বছর পেরিয়ে যাবার পরে ২০১২ সালে দরিয়াপুরের ডোকরা শিল্পী রামু কর্মকারও রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পান। কিন্তু পুরস্কার ও সন্মান যাই জুটুক,তাতে ভ্যাগ্যের চাকা ঘোরে নি।৫২ বছর বয়সী রামু কর্মকার বলেন,’কোন দিনও কোদাল হাতে নিয়ে মাঠের কাজে যাই নি।ছোট বয়স থেকেই ডোকরা শিল্পের কাজ করে উপার্জন করেছি। সুনামও কুড়িয়েছি। হাঠাৎ করে ২০১৬ সালে সেরিব্রাল স্ট্রোকে আক্রান্ত হন।তার পর থেকেই হাত ও পায়ের শক্তি কমে গিয়েছে।শরীর সায় না দেওয়ায় এখন পরিশ্রমের কাজ করতে পারেন না।তিনি মেয়ের বিয়ে দেওয়া হয়ে গেছে। ছেলে শুভ কর্মকার ডোকরা শিল্পের কাজ করে যে টুকু রোজগার করে তা দিয়েই এখন সংসার চলে।নিজের হাত খরচ ও ওষুধের পয়সা জোগাড় করতে তাই আমি বাড়ি লাগোয়া জায়গায় ছোট্ট একটি গুমটিতে দোকান খুলে চালাচ্ছি ।রামু কর্মকার আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন,“আমি রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেলেও শিল্পী ভাতা পাওয়ার সৌভাগ্য আজও আমার হয় নি। সরকার বা প্রশাসন যদি আমার শিল্পী ভাতার ব্যবস্থা করে দেয় তবে খুবই উপকার হত ।’।
শিল্পী রামু কর্মকারের ছেলে শুভ কর্মকার বলেন, ‘অসুস্থ শরীর নিয়ে আভার বাবা আর ডোকরা শিল্পের কাজ করতে পারেন না বলে মনকষ্টে ভোগেন। বাবার কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা নিয়ে আমি কিছু কারিগরকে সঙ্গে নিয়ে শিল্পের কাজ করে যাচ্ছি। শিল্পী ভাতাটা পেলে বাবার খুবই উপকার হত ।’ আর রামু বাবুর স্ত্রী সাধনাদেবী বলেন,’আভার স্বামী খুবই নামজাদা ডোকরা শিল্পী । রাষ্ট্রপতি পুরস্কার অর্জন করে উনি পূর্ব বর্ধমান
জেলাকে গর্বিত করেছেন। তাই আমি চাই অসহায় পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসন আমার স্বামীর পাশে দাঁড়াক’।আউশগ্রামের বিধায়ক অভেদানন্দ
থান্ডার বলেন,“প্রখ্যাত ডোকরা শিল্পী রামু কর্মকারের এইরকম অসহায় অবস্থার কথা আমার জানা ছিল না। আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি । ওনার জন্য নিশ্চই কিছু একটা করতে হবে । আমাদের সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রী দরিয়াপুরের ডোকরা শিল্পীদের পাশে সব সময়ের জন্য রয়েছে ।’।