দিব্যেন্দু রায়,কাটোয়া(পূর্ব বর্ধমান),১৫ এপ্রিল : ‘রোপওয়তে আমাদের ১৯ নম্বর ট্রলিতে তখন আমি, আমার বন্ধু নমন, এক মহিলা এবং একজন পুরুষ মিলে মোট চারজন ছিলাম । রবিবার বিকেল আমাদের ট্রলি থেমে যাওয়ার পর প্রথম মনে হয়েছিল যান্ত্রিক বিভ্রাট হয়েছে । অল্প সময়েই ঠিক হয়ে যাবে । কিন্তু রাত এগারোটা নাগাদ জানতে পারি দুর্ঘটনা ঘটেছে । তারপর থেকে শুরু আতঙ্কের প্রহর গোনা । সোমবার ভোরে অন্ধকার কেটে যাওয়ার পর দেখতে পাই শুধু আমাদের ট্রলি নয়,আরও কয়েকটি ট্রলি তখন রোপওয়েতে ঝুলে রয়েছে । সোমবার দুপুর থেকে শুরু হয় উদ্ধারকাজ ।’ শুক্রবার সকালে মা শিপ্রাদেবী এবং বাবা মিলন নন্দনের মাঝে বসে একটানা এই কথাগুলো বলে একটু থামলেন পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া পুরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের টাউনহল পাড়ার বাসিন্দা অভিষেক নন্দন ।
ঝাড়খণ্ডের ত্রিকূট পাহাড়ের রোপওয়ে দূর্ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে এরপর অভিষেক বলেন, ‘রবিবার সারা রাত কেটেছে আতঙ্কের মধ্যে । না ছিল খাবার, না ছিল জল । সারাক্ষণ তীব্র হাওয়া বইছিল । কেবল মনে হচ্ছিল এই বুঝি ধাতব দড়ি ছিঁড়ে দূর্ঘটনা ঘটে যায় । আমরা সকলে মিলে সারাক্ষণ ভগবানের নাম স্মরণ করছিলাম । শেষে সোমবার দুপুর থেকে শুরু হয় উদ্ধারকাজ । বিকেল নাগাদ সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার আমাদের ট্রলিতে এসে উদ্ধার কাজ শুরু করে । চারজনের মধ্যে প্রথমে ওই মহিলাকে তোলা হয় হেলিকপ্টারে । এরপর ট্রলিতে থাকা চল্লিশোর্ধ এক পর্যটককে তুলতে গিয়ে হেলিকপ্টারের গেট থেকে হাত ফস্কে নিচে তিনি কয়েক’শ ফুট পড়ে যান । তারপর সব শেষ । চোখের সামনে এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে আতঙ্কে আমরা দু’জন চোখ বন্ধ করে বসে থাকি । এরপর আমাদের উদ্ধার করতে এলে ওই উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে যেতে অস্বীকার করি । মঙ্গলবার দুপুর বারোটা নাগাদ নতুন একটা দল এসে আমাদের উদ্ধার করার পর আমাদের প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় । হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়ার পর বৃহস্পতিবার রাতে বাড়ি ফিরি ।’
অভিষেকরা দু’ভাই । সে বড় । ভাই অনুরাগ ভিনরাজ্যে বি ফার্ম পাঠরত । কাটোয়ার কাছারি রোডে পারিবারিক ওষুধের দোকান রয়েছে অভিষেকদের । গত ৪ এপ্রিল দেওঘরে নমন নীরজ নামে এক বন্ধুর বাড়িতে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন অভিষেক । রবিবার রামনবমীর দিন বিকেল চারটে নাগাদ দু’বন্ধু মিলে ত্রিকূট পাহাড়ের রোপওয়েতে চড়েছিলেন । অপরপ্রান্ত থেকে ফেরার সময় বিকেল পাঁচটা নাগাদ মাঝপথে থেমে গিয়েছিল তাদের ১৯ নম্বর ট্রলিটি ।
অভিষেকের মা শিপ্রাদেবী জানিয়েছেন,টানা ৪২ ঘন্টা পাহাড়ের রোপওয়ের ট্রলিতে কাটানোর ভয়ঙ্কর স্মৃতি এখনও ভুলতে পারছে না তাঁর ছেলে । বৃহস্পতিবার রাতে ছেলে বাড়ি ফেরার পর দু’চোখের পাতা এক করেনি । অভিষেক বলেন, ‘চোখের সামনে সহযাত্রীর হাত ফস্কে গভীর খাদে পড়ে যাওয়ার সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য এখনও ভুলতে পারছি না । চোখ বুজলেই সেই দৃশ্য কেবল মনে পড়ে যাচ্ছে ।’ প্রসঙ্গত,ত্রিকূট পাহাড়ে রোপওয়ে দুর্ঘটনায় মোট চারজনের মৃত্যু হয়েছে । তার মধ্যে এক পর্যটক ছিলেন অভিষেকদের ট্রলিতে । তবে এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্য থেকে বড় ছেলে সুস্থভাবে বাড়ি ফিরে আসায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন অভিষেকের বাবা-মা ।।