জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,বর্ধমান,০২ ফেব্রুয়ারী :
যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্রাইসের মতে – There is no better test of the excellence of a government than the efficiency of its Judicial system. বিচারবিভাগের কর্মদক্ষতা যেকোনো গণতান্ত্রিক সরকারের উৎকর্ষ বিচারের শ্রেষ্ঠ মানদণ্ড। বাস্তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ভাবনার সঙ্গে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ভাবনার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। ফলস্বরূপ দিনের পর দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে ভারতের বিচারব্যবস্থা ।
কয়েকদিন আগে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে একটি মর্মান্তিক ঘটনা প্রকাশ পায়। জানা যায়, জনৈক ব্যক্তি এক বিএসএফ জওয়ানের নাবালিকা কন্যাকে অপহরণ ও ধর্ষণ করে। পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে। পরে সে আদালত থেকে জামিনে ছাড়া পায়। নিয়মমাফিক সে আদালতে হাজিরা দিতে আসে এবং আদালতের গেটে নিজ উকিলের জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় সংশ্লিষ্ট জওয়ান তাকে গুলি করে হত্যা করে। এইভাবেই সে তার কন্যার উপর পাশবিক অত্যাচারীকে শাস্তি দেয়। এক্ষেত্রে ঘটনার স্থান বা অভিযুক্ত ব্যক্তির সামাজিক পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ নয়। কে তাকে গুলি করে মেরেছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো ঘটনার প্রেক্ষিত বিচার। বিষয়টিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা না ভেবে গভীরভাবে ভাবতে হবে। আর যাই হোক ওটা কোনো ভাল বিজ্ঞাপন নয় ।
ঘটনাটি সমাজ মাধ্যমে প্রকাশ পেতেই বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য ফুটে ওঠে। কারও কারও বক্তব্য – এইভাবে আইন নিজ হাতে তুলে নেওয়া ঠিক নয়। আইনের উপর ভরসা রাখতে হতো। অধিকাংশের বক্তব্য,সংশ্লিষ্ট জওয়ান অপরাধীকে শাস্তি দিয়ে ঠিক করেছে । নাহলে কবে যে অপরাধী শাস্তি পেত বা আদৌ পেত কিনা তার কোনো ঠিক নাই। কার্যত আইনের প্রতি সরাসরি অনাস্থা প্রকাশ ।
অনেক ভালোর মধ্যে ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার বড় সমস্যা হলো দীর্ঘসূত্রতা। এখানে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকেও কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। কিন্তু অধিকাংশ বিচার প্রক্রিয়া এত দীর্ঘ মেয়াদি হয় যে বিচারের মূল তাৎপর্য হারিয়ে যায়। শোনা যায় কোনো কোনো বিচার প্রক্রিয়া শেষ হতে ১০-২০ বছর লেগে যাচ্ছে। কোনোটা আবার তার থেকেও বেশি। অনেক মামলার নাকি ফাইলই খোলা হয়নি। যখন সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি শপথ নেন তখনই ‘পেণ্ডিং’ থাকা বিচারের সংখ্যাটা প্রকাশ্যে আসে।
দীর্ঘসূত্রতার পেছনে একাধিক কারণ দেখতে পাওয়া যায়। লোকসংখ্যা বাড়লেও এখনো বাড়লনা আদালতের সংখ্যা। বিচারপতির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াতো দূরের কথা উল্টে শূন্য সংখ্যা পূরণ হয়না। একজন বিচারপতিকে একাধিক মামলার শুনানি করতে হয়। ফলে বিচারপতিদের উপর চাপ বেড়েই যায়। হয়রানির শিকার হতে হয় সাধারণ মানুষকে।
শুধু বিচারপতি নয়, আদালতের কর্মী সংখ্যাও কম। তার ফলেও বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়। অনেক সময় কিছু পুলিশ ও উকিলের মধ্যে অশুভ আঁতাতের কথা শোনা যায়। এটাও নাকি দেরির কারণ। বিচারের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি মানুষকে ভাবতেই হবে সমাজে কিন্তু এখনো তাদের জন্য আলাদা সম্মান আছে ।
দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো বিচারপতি বা আদালতের সংখ্যা সংক্রান্ত সমস্যা থাকলেও আজ পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দলকে, শাসক বা বিরোধী যেই হোকনা কেন, সংসদে এই বিষয়ে সোচ্চার হতে দেখা গেলনা। অথচ অকারণে দিনের পর দিন তারা সংসদ অচল রেখেছে। দেশে সাংসদ সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য অথবা সাংসদদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য এদের যতটা তৎপরতা দেখা যায় তার একাংশ যদি আদালতের ও বিচারপতির সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য তৎপরতা দেখাতো তাহলে সাধারণ মানুষের অনেক সুবিধা হতো। দুর্জনেরা বলে বর্তমানে অধিকাংশ দুর্নীতির সঙ্গে রাজনীতিবিদদের একাংশ অথবা তাদের সাগরেদরা যুক্ত আছে। এখন আদালত ও বিচারপতির সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন হবে এবং সেক্ষেত্রে অনেকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারে। হয়তো সেই আশঙ্কায় বিচার বিভাগ অবহেলিত থেকে যাচ্ছে।
সুষ্ঠুভাবে বিচার কার্য সমাধানের জন্য বিচারপতিদের পুলিশি তদন্তের উপর নির্ভর করতে হয়। অনেক সময় সঠিক সময়ে তদন্ত শেষ হয়না অথবা শুনানির সময় তদন্তকারী পুলিশ আধিকারিক অনুপস্থিত থাকেন। হয়তো সংশ্লিষ্ট আধিকারিক একাধিক তদন্তের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, অন্য থানায় বদলি অথবা চাকরি জীবন থেকে অবসর নিয়ে নেন। এই সমস্যা দূর করার জন্য অবশ্যই বিকল্প ভাবতে হবে। দেরির জন্য বাদী-বিবাদী পক্ষের উকিলের অনুপস্থিতিও কম দায়ী নয়। দিনের শেষে ফল ভোগ করতে হয় অভিযুক্তদের ।
বিচারব্যবস্থাকে অর্থবহ করে তোলার জন্য দলমত নির্বিশেষে প্রতিটি দলকে নিরপেক্ষতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। দল নয় দেশের স্বার্থকে বড় করে দেখতে হবে। দ্রুত শূন্য বিচারপতি পদ পূরণ করতে হবে। আদালতকে ব্লক স্তর পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হবে। ব্যবহার করতে হবে আধুনিক প্রযুক্তির। নাহলে একদিন গণতন্ত্রের এই গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভটি মুখ থুবড়ে পড়বে ।।