প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,২৩ জুলাই : পঞ্চায়েত অফিসে চড়াও হয়ে প্রধান এবং উপ প্রধানকে মারধোর ও সরকারী সম্পত্তি ভাঙচুরের অভিযোগে গ্রেপ্তার হল ১৫ জন । ধৃতদের মধ্যে দু’জন মহিলাও রয়েছেন । ধৃতরা সকলে পূর্ব বর্ধমানের মেমারি থানার আউশা,নবস্তা ও হৈরগ্রাম এলাকার বাসিন্দা । শুক্রবার রাতভর অভিযান চালিয়ে পুলিশ এদের গ্রেপ্তার করে । সুনির্দিষ্ট ধারায় মামলা রুজু করে পুলিশ শনিবার ১৫ জন ধৃতকে পেশ করে বর্ধমান আদালতে।এই ধরপাকড় নিয়ে থমথমে হয়ে রয়েছে নবস্তা ১ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে,নবস্তার আউশা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের অসুস্থ হয়ে পড়া নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত ঘটে । প্ল্যাসটিক ক্যারি ব্যাগ ও প্ল্যাসটিক সামগ্রীর ব্যবহার বন্ধের বার্তা দিতে শুক্রবার নবস্তা ১ পঞ্চায়েত একটি র্যলির আয়োজন করে । সেই র্যলিতে আউশা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের যোগদান করানো হয় । সেই র্যলি শেষে খুদে পড়ুয়ারা স্কুলে ফেরার পর তাঁদের দেওয়া হয়েছিল প্যাকেটজাত ঠাণ্ডা পানীয় ও কেক।আর তা খেয়েই আউশা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬২ জন ছাত্র ছাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ে। অসুস্থ পড়ুয়াদের সকলকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে পাঠানো হয় । এই ঘটনার পরেই এলাকাবাসী ও অভিবাবকদের রোষ আছড়ে পড়ে নবস্তা ১ পঞ্চায়েত অফিসে। পঞ্চায়েতের প্রধান ,উপ প্রধান ও আধিকারিকদের মারধোর করার পাশাপাশি পঞ্চায়েতের সরকারী সম্পত্তিও ভাঙচুর করা হয় ।বিশাল পুলিশ বাহিনী সেখানে পৌছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার পরেই ধরপাকড় অভিযানে নামে। পাশাপাশি পড়ুয়াদের অসুস্থ হয়ে পড়ার প্রকৃত কারণ জানতে প্রশাসনও তদন্ত শুরু করে।
স্কুলের এক পড়ুয়ার অভিভাবক শেখ ইব্রাহিম বলেন,প্ল্যাসটিক ক্যারি ব্যাগের ব্যবহার বন্ধের বার্তা দিতে নবস্তা ১পঞ্চায়েত র্যলির আয়োজন করে। সেই র্যলিতে আউশা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খুদে পড়ুয়াদের নিয়ে যাওয়া হয় । র্যালি শেষে খুদে পড়ুয়ারা স্কুলে ফিরলে তাদের প্যাকেটজাত ঠান্ডা পানীয় ও কেক খেতে দেওয়া হয়।তা খাওয়ার পরেই একের পর এক পড়ুয়া অসুস্থ হয়ে পড়তে শুরু করে। পড়ুয়াদের পেটে ও মাথায় যন্ত্রনা, মাথা ঘোরা ও বমি ভাব দেখা দেয়।বিদ্যালয়ের অপর এক ছাত্রী রিয়া ঘড়ুই এর বাবা রণজিৎ ঘড়ুই বলেন ,’প্যাকেটে ভরা যে জুস ও কেক খেতে দেওয়া হয়েছিল তা খেয়েই তাঁর মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে’ । এই ঘটনার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে উদাসীনতার অভিযোগ
তোলার পাশাপাশি নবস্তা ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের বিরদ্ধেও তীব্র ক্ষোভ উগরে দেন শেখ ইব্রাহিম, রণজিৎ ঘড়ুই সহ অন্য অভিভাবকরা । এই অভিযোগের বিষয়টি জানার পর জেলা প্রশাসনিক মহলও নড়ে চড়ে বসে । অসুস্থ খুদে পড়ুয়াদের শারীরিক অবস্থার খোঁজ খবর নিতে বর্ধমান হাসপাতালে পৌছান জেলা পরিষদের সবাধীপতি তথা বিধায়ক শম্পা ধারা ,সহ- সভাধীপতি দেবু টুডু ও জনস্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ বাগবুল ইসলাম।জনস্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ বাগবুল ইসলাম বলেন ,“ফুট পয়জন থেকে সম্ভবত এমনটা হয়ে থাকতে পারে ।’
সাতগাছিয়া(ওয়েস্ট) সার্কেলের স্কুল ইনস্পেক্টর শ্যামল জানাকে শুক্রবারের ঘটনা বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন,’অউশা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ুয়ারাদের যে র্যলিতে হাঁটানো হবে তা আমাকে জানানো হয় নি।বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাধাকান্ত রায় শুধু জানিয়েছে, “ র্যালি শেষে যে খাবার পড়ুয়াদের দেওয়া হয় তা পঞ্চায়েত থেকেই দিয়েছিল“ । নবস্তা ১ পঞ্চায়েতের প্রধান সারদা হাজরা বলেন,“র্যলি শেষে পড়ুয়াদের যে খাবার দেওয়া হয় তা পঞ্চায়েতেরই দেওয়ার কথা । কিন্তু পরে কি হয়েছে তা আমি জানি না “। বর্ধমান ২ ব্লকের বিডিও সুবর্না মজুমদার জানান,“র্যালি শেষে আউশা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের যে খাবার দেওয়া হয় তা পঞ্চায়েত থেকেই দেওয়া হয়েছিল ।তবে ওই খাবার খেয়েই ফুড পয়জনের কারণে পড়ুয়ারা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, এমনটা এখনই নিশ্চিত ভাবে বলা যাবে না । তবে ওই খাবারের নমুনা পরীক্ষায় পাঠানো হয়েছে । রিপোর্ট আসলে বিষয়টি পরিস্কার হবে বলে বিডিও জানিয়েছেন ।
যদিও বর্ধমান মেডিক্যালের সুপার চিকিৎসক তাপস ঘোষ জানিয়েছেন,খাদ্যে ’বিষক্রিয়া’ থেকেই পড়ুয়ারা অসুস্থতা বোধ করেছে বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে । তবে হাসপাতালে আসা সবাই সুস্থ রয়েছে”। এসডিপিও (বর্ধমান উত্তর ) তীর্থঙ্কর বিশ্বাস
জানিয়েছেন,’যে দোকান থেকে খাদ্যসামগ্রী কেনা হয়েছিল, সেই দোকানটি আপাতত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ।
এদিকে পড়ুয়াদের অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক দলাদলিও চরমে উঠেছে। বর্ধমান ২ ব্লক তৃণমূলের নেতা তথা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি অরুণ গোলদার বলেন, ‘আউশা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাধাকান্ত রায় বিজেপির নেতা । তিনি গত বিধানসভা ভোটে বিজেপির প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ছিলেন । স্কুলের বাচ্চা অসুস্থ
হয়ে পড়ার পর ওই প্রধান শিক্ষক এলাকার বাসিন্দাদের ও অভিভাবকদের উস্কান । এর পরেই পঞ্চায়েত অফিসে বহু লোকজন চড়াও হয় । তারা পঞ্চায়েত অফিসে ঢুকে বেপরোয়া ভাবে সরকারী সম্পত্তি ভাঙচুর চালায় । প্রধান সাধনা হাজরা, উপ-প্রধান সুদীপ্ত মাজিল্য ও পঞ্চায়েত আধিকারিকদের মারধোর করে । পঞ্চায়েতের আসবাবপত্রও ভাঙচুর করা হয় । এই ঘটনার খবর পেয়ে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কল্যাণ সিংহ রায় ও এসডিপিও (বর্ধমান দক্ষিণ ) সুপ্রভাত চক্রবর্তীর নেতৃত্বে বিশাল পুলিশ বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌছান । পুলিশ লাঠি চার্জ করে বিক্ষোভকারীদের হঠিয়ে দিয়ে উত্তেজনা নিয়ন্ত্রনে আনে ।’
অরুণ গোলদার এও বলেন,’মারধোরে পঞ্চায়েতের উপ- প্রধান মারাত্বক জখম হয়েছেন।তাঁকে মেমারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় । ষেখান থেকে তাঁকে বর্ধমান হাসপতালে স্থানান্তর করা হয়েছে ।’ এলাকার সিপিএম নেতা শ্যামচাঁদ মুখোপাধ্যায়ও একই ভাবে দাবি করেন,’বিষয়টি মিটে যাওয়ার সময়ে বিজেপি অশান্তিটা পাকালো ।’ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে এদিন ফোনে পাওয়া যায়নি । বিজেপির জেলা মুখপত্র মৃত্যুঞ্জয় চন্দ্র দাবি করেছেন, ‘রাধাকান্তর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তোলা হচ্ছে । পুলিশ নামিয়ে অন্যায় ভাবে পড়ুয়াদের অভিভাবকদের মারধোর করা হয়েছে ।’।