খেচরী মুদ্রা হলো একটি প্রাচীন যোগ মুদ্রা, যা হঠযোগের একটি অংশ। যেখানে জিহ্বাকে পেছনের দিকে বাঁকিয়ে তালুর উপরের অংশে ঠেকানো হয় এবং ক্রমে নাসা পথে প্রবেশ করানো হয়। এই মুদ্রা অভ্যাস করার মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক উভয় প্রকার উপকারিতা লাভ করা যায় বলে মনে করা হয়।যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী এই প্রাচীন যোগ পদ্ধতিকে সাধারণ মানুষের কল্যাণে প্রচার করে গেছেন । যোগীরাজ লাহিড়ী বাবা মহাবতার বাবাজির শিষ্য ছিলেন।মহাবতার বাবাজির কাছে শিখে, ১৮৬১ সালে তিনি ক্রিয়াযোগ যোগবিজ্ঞানকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন ।
যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী বলেছিলেন,”খেচরী মূদ্রায় ইন্দ্রিয় দমন হয় ।” যোগীরাজ পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা “শ্যামাচরণ ক্রিয়াযোগ ও অদ্বৈতবাদ” পুস্তকে খেচরী মূদ্রা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে । লেখক লিখেছেন,খেচর অর্থে আকাশ। আকাশে গমন করলে অর্থাৎ আকাশে অবস্থান করলে নিরালম্বে স্থিতি হয়। তখন নিরালম্বে অবস্থান করায় স্থুল ইন্দ্রিয়সঙ্গ রহিত হয়। কিন্তু শাস্ত্র বলেছে :
কপাল কুহরে জিহ্বা প্রবিষ্ঠা বিপরীতগা
ভ্রুবো অন্তর্গতা দৃষ্টি মুদ্রাভবতি খেচরী। -ঘেরণ্ড সংহিতা ২৭ এবং ‘কাশীখণ্ড’।
অর্থাৎ মুখের ভেতরে জিহ্বা বর্তমানে যে অবস্থায় আছে তাকে বিপরীত গতি করে অর্থাৎ ঊর্ধ্বে গান করিয়ে কপাল কুহরে রেখে ভ্রূদ্বয়ের মধ্যে কুটস্থে দৃষ্টি স্থির করলে তাকেই খেচরী মুদ্রা বলে। যোগিরাজ বলছেন এই প্রকারে খেচরীমুদ্রা করলে ইন্দ্রিয়দমন হয় অর্থাৎ ইন্দ্রিয়দের কর্ম থেমে যায়, আর স্থুল বস্তুর দিকে না গিয়ে, এটা চাই ওটা চাইরূপ গতি রহিত হয়। অর্থাৎ প্রকারান্তরে ইন্দ্রিয়রহিত হওয়ায় মহাশূন্যে স্থিতি হয়। এই অবস্থাকেই খেচরিসিদ্ধি বলে।
ইন্দ্রিয়গণ কতক্ষণ কর্মরত থাকে? যতক্ষণ শ্বাসের গতি বহিমুখী। প্রাণ চঞ্চল বলেই শ্বাসের গতি বহির্মুখী। যতক্ষণ প্রাণ চঞ্চল থাকবে ততক্ষণ মনও চঞ্চল থাকবে। যতক্ষণ মন চঞ্চল থাকবে ততক্ষণ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য, চিত্ত, অহংকার, বুদ্ধি, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা, আলস্য, দর্শন, শ্রবণ, ঘ্রাণ, চিন্তা-ভাবনা, আসক্তি, প্রেম, ভালবাসা, অহংভাব, পরশ্রীকাতরতা, দেহবোধ ইত্যাদি সবই থাকবে। কিন্তু এই প্রকারে জিহ্বাকে তালুকুহরে রাখতে পারলে শ্বাসের গতি বহুলাংশে কমে যায়। তারপর যতটুকু গতি থাকে প্রাণকর্মের দ্বারা তাও রহিত হয়। এই অবস্থায় ইন্দ্রিয়গণ কর্মহীন হওয়ায় যোগীর মহাশূন্যে স্থিতিলাভ হয়। জন্মগ্রহণের সাথে সাথে জিভের বিচ্যুতি ঘটে, প্রাণ চঞ্চল হয় এবং শ্বাস-প্রশ্বাস চালু হয়। যতক্ষণ প্রাণ চঞ্চল থাকবে ততক্ষণ শ্বাসপ্রশ্বাসও চালু থাকবে জীবও জীবিত থাকবে এবং যতক্ষণ শ্বাসপ্রশ্বাস চালু থাকবে ততক্ষণ উপরিউক্ত ইন্দ্রিয়গুলিও কর্মক্ষম থাকবে। আবার জিহ্বা তালুকুহরে রেখে যতই প্রাণকর্ম করবে ততই প্রাণ স্থিরত্বের দিকে অগ্রসর হবে। এইভাবে যতই স্থিরত্বের দিকে অগ্রসর হবে ততই ইন্দ্রিয়গুলি কর্মহীন হবে। শেষে যখন প্রাণ সম্পূর্ণরূপে স্থির হবে অর্থাৎ স্পন্দনরহিত হবে তখন ইন্দ্রিয়গণও সম্পূর্ণ, কর্মরহিত হবে। তখন ইন্দ্রিয়গণ থাকবে বটে কিন্তু তাদের কর্মরহিত হওয়ায় নিষ্কর্ম হবে। একেই বলা হয় ইন্দ্রিয়দের দমন অবস্থা। যোগী এইপ্রকারে ইন্দ্রিয়দের দমন করে অর্থাৎ কর্মহীন অবস্থায় রেখে নিজের অধীনে রাখেন এবং সব কর্ম করেন। তিনি কখনই ইন্দ্রিয়দের অধীনে থাকেন না। তবে যোগী প্রয়োজন বোধে পুনরায় ইন্দ্রিয়দের কর্মক্ষম ও কর্মহীন উভয় অবস্থাতেই প্রয়োগ করতে সক্ষম হন। তাই যোগী ইন্দ্রিয়ভয়ে কোনো কিছু থেকে পলায়ন করেন না, কারণ ইন্দ্রিয় তাঁর অধীনে থাকে। প্রয়োজন বোধে ইন্দ্রিয়দের ব্যবহার করেন আবার করেন না। ইন্দ্রিয়দের ওপর যোগীর এমনই দক্ষতা জন্মায়। কারণ স্থির প্রাণে কোনো তরঙ্গ, বৃত্তি বা দেহবোধ থাকে না। চঞ্চলতার অবসানে পঞ্চভৌতিক এই দেহ তখনই প্রকৃত শুদ্ধ হয়। একেই ভূতশুদ্ধি বলে। তাই মৃতের কোনো জাত থাকে না অর্থাৎ মৃতদেহে কোনো প্রকার ইন্দ্রিয় কর্ম থাকে না। মন স্বয়ং ইন্দ্রিয়। প্রেম, ভক্তি, ভালবাসা এ সবই মনোধর্ম। এ সবই নির্ভর করে দেহে প্রাণের চঞ্চল অবস্থার অস্তিত্বের ওপর। প্রাণহীন দেহে প্রেম ভালবাসা কিছুই নেই। এই প্রকারে প্রাণকর্ম করতে থাকলে সকল প্রকার ইন্দ্রিয় দমন হয়ে আসক্তিশূন্য অবস্থা আসবে, তখন বিষয়, কামিনী, কাঞ্চন এবং সংসার সবই থাকবে অথচ কিছুই বাধাস্বরূপ হবে না। শাস্ত্র আরও বলেছেন-
ভ্রূবোরন্তর্গতাং দৃষ্টিং বিধায় সুদৃঢ়াং সুধীঃ। উপবিষ্ট্যাসনে বজ্রে নানোপদ্রব বর্জিতঃ। লম্বিকোর্দ্ধস্থিতে গর্তে রসানাং বিপরীতগাম্। সংযোজয়েৎ প্রযত্বেন সুধাকূপে বিচক্ষণঃ।
মুদ্রৈষা খেচরী প্রোক্তা ভক্তানামনুরোধতঃ।
সিদ্ধীনাং জননী হোষা মম প্রাণাধিকাধিকে। নিরন্তরকৃতাভ্যাসাৎ পীযুষং প্রত্যহং পিবেৎ।
তেন বিগ্রহসিদ্ধিং শ্যাৎ মৃত্যুমাতঙ্গ কেশরী ॥(শিবসংহিতা ৫১-৫৪)
যোগী উপদ্রবহীন জায়গায় বজ্রাসনে বসে ভ্রূবোরন্তর্গতে (কূটন্থে) দৃঢ়রূপে দৃষ্টি স্থাপন করে রসনা (জিহ্বা) বিপরীতগামী করে আলজিহ্বার উপরিস্থ গর্তে পরি-চালন করে সমত্বে কুটস্থরূপী অমৃতকূপে সংযোজিত করবে। এই খেচরীমুদ্রা সিদ্ধিলাভের পক্ষে জননীস্বরূপা। ভক্তগণের অনুরোধে প্রকাশ করলাম। শিব আরও বলেছেন-হে প্রাণবল্লভে; এই খেচরীমুদ্রা মহতী সিদ্ধির কারণ। খেচরী-মুদ্রা নিরন্তর অভ্যাস করলে প্রতিদিন সুধাপান করতে সমর্থ হয় এবং শরীর সম্পূর্ণ সিদ্ধ হয় অর্থাৎ জরা মৃত্যু রহিত হয়। এই মুদ্রা মৃত্যুরূপ যে মাতঙ্গ তাহার পক্ষে কেশরীস্বরূপ।