এইদিন আন্তর্জাতিক ডেস্ক,০৮ অক্টোবর : “কারোর পৌষ মাস তো কারোর সর্বনাশ”- এই প্রবাদ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এপার-ওপার বাংলায় । উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চল নির্বিচারে ধ্বংস করে মাফিয়ারা যে কাঠের গুঁড়ি কেটে রেখেছিল সাম্প্রতিক মেঘভাঙা বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতিতে কোটি কোটি টাকা মূল্যের সেই কাঠ নদীর জলে ভেসে বাংলাদেশে চলে গেছে । এখন পোয়া বারো বাংলাদেশের কালজানি ও দুধকুমার নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলির বাসিন্দাদের । জলে ভেসে যাওয়া ওই সমস্ত কাঠের গুঁড়ির রঙ একটু লালচে হলেই ‘রক্ত চন্দন’ বলে গুঁড়ি পিছু বিক্রি হয়ে যাচ্ছে ২০ থেকে ৩৫ হাজার টাকায় । কেউ কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে লালচে রঙের ও বাকল-শিকড়বিহীন কাঠের গুঁড়ি “চন্দন কাঠ” বলে বিক্রি করে দিচ্ছে৷ রবিবার ভোর থেকে ওই দুই নদীর তীরে কার্যত কাঠের হাট বসে গেছে৷ অনেক অবস্থাপন্ন পরিবারের মহিলা ও পুরুষরা সকাল হতেই দুই খরস্রোতা নদীর জলে নেমে কাঠ সংগ্রহ করছে বলে জানা গেছে ।
রবিবার থেকেই বাংলাদেশের কালজানি ও দুধকুমার নদীতে ভেসে আসতে দেখা যায় হাজার হাজার ভাসমান কাঠের গুঁড়ি। তার মধ্যে কিছু চন্দন কাঠের গুঁড়িও ছিল । প্রথম দিকে যারা নদী থেকে কাঠ সংগ্রহ করতে শুরু করেছিল তারা বেশ কিছু গুঁড়ি বিক্রি করে লক্ষ লক্ষ টাকা কামিয়েও ফেলে । ক্রমশ সেই কথা জানাজানি হতেই বর্তমানে দুই নদীর তীরে তিলধারণের জায়গা নেই । শুধু নদী পার্শ্ববর্তী গ্রামই নয়, আশপাশের ভদ্র ঘরের পরিবারের মহিলা ও পুরুষরা সকাল হতেই ট্রাক্টরে চলে আসছে চন্দন কাঠ সংগ্রহ করে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য ।
রবিবার দুপুরের পর থেকেই এলাকাজুড়ে শুরু হয় কাঠ কেনাবেচা । কেউ কেউ ২০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম হাঁকাচ্ছেন এক একটি গুঁড়ির জন্য। আবার কারও কারও দাবি, এই কাঠের বাজারমূল্য লাখ টাকারও বেশি। স্থানীয়রা বলছেন, কিছু গুঁড়ি এত বড় ও ভারী যে, একাধিক মানুষ মিলে তা টেনে তুলতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে দামাল গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মোতালেব জানিয়েছেন, তিনি চারজনের সহায়তায় ৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি লাল কাঠ উঠিয়েছেন, এবং সেটির দাম ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত পেতে পারেন বলে আশা করছেন।
তবে এই ঘটনাই বিপদের কারণও হয়ে দাঁড়িয়েছে। রবিবার সকালে কালজানি নদী থেকে কাঠ তুলতে গিয়ে মনছুর আলী (৪০) নামের এক ব্যক্তি নদীর জলে তলিয়ে গেছে৷ স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে এমন ঝুঁকি না নিতে জনগণকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। তবে কে শোনে কার কথা । জেলা বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মহম্মদ সাদিকুর রহমান বলেন,’আমরা সরেজমিনে গিয়ে কাঠগুলো পরীক্ষা করেছি। দীর্ঘ সময় জলে থাকার কারণে কাঠের রঙ বদলে গেছে। এগুলোর সঙ্গে শ্বেত বা রক্ত চন্দনের কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষ না বুঝেই এগুলো চন্দন ভেবে বিক্রি করছে।’
নাগেশ্বরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সিব্বির আহমেদ জানিয়েছেন,’উজান থেকে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে প্রচুর গাছের গুঁড়ি ভেসে আসছে। এগুলো ধরতে গিয়ে অনেকে জলে ঝাঁপ দিচ্ছে, যা প্রাণহানির আশঙ্কা তৈরি করছে। কাঠের সঙ্গে সাপসহ অন্যান্য প্রাণীর উপস্থিতিও দেখা গেছে। তাই সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।’ স্থানীয় প্রশাসন ও বন বিভাগ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তবে এ ঘটনায় এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনও কাঠ সংগ্রহের জন্য প্রবল উন্মাদনা রয়েছে। কেউ ভাবছেন এটি প্রকৃত রক্ত চন্দন, কেউ আবার সরকার কাঠগুলো বাজেয়াপ্ত করবে এই আশঙ্কায় তাড়াহুড়া করে বিক্রির চেষ্টা করছেন।
কুড়িগ্রামের নদীগুলোর পাড়জুড়ে এখনো স্তূপ হয়ে পড়ে আছে শত শত গাছের গুঁড়ি। নদীর ঢলে ভেসে আসা এই অচেনা কাঠগুলো ঘিরে স্থানীয়দের কৌতূহল, লোভ আর ভয়— সব মিলিয়ে এক অভিনব দৃশ্য তৈরি হয়েছে সীমান্তঘেঁষা এই জেলায় । স্থানীয় গৃহবধূ মর্জিনা বিবি,আয়েষা বিবিরা বলেন, ‘আল্লাহ রোজকার করার সুযোগ দিয়েছেন । এই সুযোগ হাতছাড়া করা যায় ? অন্তত ৪-৫ টা চন্দন কাঠ তুলতে পারি তাহলে জীবন গড়ে যাবে ।’ তারা জানান,তাদের পরিবারের সব সদস্যই সকাল হলেই নদীর তীরে চলে আসছেন এবং সঙ্গে করে দিনভরের খাবার বেঁধে নিয়ে আসছেন৷।