জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,বীরভূম,১৩ মার্চ : সেদিন ছিল ২০২২ সালের ১২ ই আগষ্ট, রাখী পূর্ণিমার দিন। রাজ্য জুড়ে বোনেরা ভাইদের হাতে রাখী বাঁধতে ব্যস্ত। রীতিমত উৎসবের মেজাজ। ওদিকে তখন অন্য উৎসব, অন্য রকম সাজ সাজ রব। কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে সিবিআইয়ের আধিকারিকরা বোলপুরের নিজস্ব বাড়িতে অনুব্রত মণ্ডল ওরফে কেষ্টকে অন্য বাঁধনে বেঁধে ফেলে। তাকে গ্রেপ্তার করে আসানসোলে নিয়ে যায়। তারপর থেকে তিনি জেলবন্দী ।
তদন্তের নামে তাকে নিয়ে চলে টানাটানি। মাঝে মাঝে শোনা যায় বাঘা বাঘা গোয়েন্দা আধিকারিকদের জেরার মুখেও কেষ্ট নাকি মুখ খুলছেন না। মুখ খোলাতে হলে তাকে নিয়ে যেতে হবে দিল্লিতে, তিহার জেলে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠবে যেসব আধিকারিকরা জেরা করে তাকে মুখ খোলাতে পারেনি তারা কি অযোগ্য ছিল? অথবা তাদের পছন্দ মত কোনো উত্তর কেষ্ট দেয়নি বলেই কি তাকে দিল্লি নিয়ে যাওয়ার আগ্রহ যদি অচেনা পরিবেশে তাকে দিয়ে কিছু ‘বলিয়ে’ নেওয়া যায় ? এই প্রশ্ন তুলছে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস ।
তৃণমূলের দাবি,আগে একবার ‘তীরে এসে তরী’ ডুবলেও অবশেষে আদালতের নির্দেশে কেন্দ্রীয় এজেন্সির আশা পূরণ হল ।
গত ৭ ই মার্চ তাকে নিয়ে যাওয়া হল দিল্লিতে এবং তার ঠাঁই হল তিহার জেলে। কাকতলীয় ভাবে এটাও ছিল পূর্ণিমার দিন – দোল পূর্ণিমা। কি হতে পারে সেটা নিয়ে কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে এটা নিশ্চিতরূপে বলে দেওয়া যায় যদি প্রত্যাশামত ফল পাওয়া না যায়, মানে তৃণমূল বিরোধীরা যে ফলের আশা করছে, তাহলে একদল ‘সেটিং’য়ের গল্প শোনাতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে।
বীরভূম তথা রাজ্য রাজনীতিতে কেষ্ট হল এক বর্ণময় চরিত্র। তার রাজনীতির স্টাইল বা বিভিন্ন মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু এটা অস্বীকার করা যাবেনা তার দাপটে শুধু বিরোধীরা নয় নিজ দলের নেতা-কর্মীরা পর্যন্ত আতঙ্কে থাকত। দলীয় কর্মীদের মনে একটাই ভয় – এই বুঝি পদ চলে গেলো। আবার তার জন্যই জনমানসে যাদের ভাবমূর্তি খুবই খারাপ তারাও দলের সামনের সারির নেতা হয়ে গেছে, মানুষের সঙ্গে উদ্ধত আচরণ করছে। অন্যদিকে অপচ্ছন্দের কর্মীরা আজ অপাঙক্তেয়। আবার এটাও শোনা যায় যেকোনো ধরনের বিপদের সময় তিনি নাকি দলের কর্মীদের পাশে থাকতেন। তাদের সাহায্য করতেন।
তাকে নিয়ে বিরোধীদের আতঙ্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে গত প্রায় সাত মাস ধরে জেলায় অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও এখনো বীরভূমে তারা কোনো সংগঠন গড়তে পারেনি। সংবাদ মাধ্যমে বিবৃতি দিয়েই দায় সেরেছে। একটাই ভয় সংগঠন করতে গিয়ে যদি কোনো বিপদ হয়! হবেই বা না কেন সিপিএমের চোখে চোখ রেখে তিনি লালদুর্গ বীরভূমে সংগঠন গড়ে তুলেছেন।
গত বিধানসভা ভোটের পর থেকেই কেষ্টর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠতে শুরু করে। যদিও আগে অভিযোগ উঠলেও সেগুলো দানা বাঁধেনি। প্রথমে নাম উঠল ভোট পরবর্তী হিংসা নিয়ে। গত বিধানসভা ভোটের ফল বের হওয়ার পর রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে বীরভূমেও বিজেপি কর্মীদের উপর আক্রমণের অভিযোগ এসেছিল। যদিও শেষপর্যন্ত তিনি গরু পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। চূড়ান্ত ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
কেষ্টকে প্রথম অসহায় লাগে বগটুই কাণ্ডের পর। তৃণমূলের রাজত্বকালে ওটাই ছিল প্রথম গণহত্যা যেটা নেমে এসেছিল নিজ দলের কর্মীদের উপর। সে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও সংবাদ মাধ্যমে মুখ খুলছিল অন্যরা। তারপর থেকেই তার আগের দাপট আর দেখা যায়নি।
কেষ্টর অনুপস্থিতিতে বীরভূমে বিরোধীরা কোনো বাড়তি মাইলেজ পাবে কি? একটাই উত্তর – না। মাইলেজ নিতে গেলে মাঠে নামতে হবে। কেষ্টর বিভিন্ন কীর্তি মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। কিন্তু সেই কাজ করতে হলে যোগ্য নেতা দরকার। বিরোধী দলগুলোতে কোথায় সেই নেতা? সবার তো একটাই ভয় যদি কেষ্ট ফিরে আসে তাহলে কি হবে? তাছাড়া তাদের ধারণা কেষ্ট বিহনে বীরভূমবাসী অটোমেটিক তাদের বেছে নেবে। কিন্তু সেটা হবেনা। যতই কেষ্টর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠুক পেছিয়ে পড়া বীরভূমে যে উন্নতি হয়েছে সেটা কিন্তু অনেকেই স্বীকার করে। তাছাড়া তার তৈরি করা সংগঠন এখনো অটুট আছে। সেটা মজবুত রাখতে ইতিমধ্যেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে আর এক দাপুটে নেতা নানুরের কাজল সেখ।
এটাও ঠিক তার জন্যই বহু নিরপরাধ যুবককে গাঁজা বা অন্য মামলায় জেলবন্দী হতে হয়েছে, অপচ্ছন্দের দলীয় কর্মীদের পেছনের সারিতে চলে যেতে হয়েছে যেটা কখনোই কাম্য ছিলনা। এখন দেখার কেষ্টর অনুপস্থিতিতে রাজ্য রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন ঘটে কিনা। তবে কেষ্ট যদি জামিন পেয়ে রাজ্যে ফিরে আসে তাহলে বিরোধীরা তার দাপটে পুরোপুরি চুপসে যাবে। মোটামুটি সেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তখন তারা ‘সেটিং’য়ের গল্প শোনাবে। অন্যদিকে, যদি তার শরীর ভেঙে না পড়ে, তাকে সামলানো তৃণমূলের পক্ষে কষ্টকর হয়ে উঠবে। পরিস্থিতি কোন দিকে যায় সেটাই দেখার ।।