শ্যামসুন্দর ঘোষ,মেমারি(পূর্ব বর্ধমান),১৯ নভেম্বর : এক চিলতে মাটির ঘর । ঘরটিতে এক সময় টালির ছাউনি দেওয়া ছিল । কিন্তু সময়ের সাথে সাথে টালি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে । তাই রোদ ও বৃষ্টির হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে কোনো রকমে টাকা জমিয়ে কিছুটা পলিথিন কিনে ঘরটির ছাউনি ঢাকা দেওয়া করান পূর্ব বর্ধমান জেলার মেমারি-২ ব্লকের কুচুট গ্রাম পঞ্চায়েতের রোকনপুর গ্রামের বাসিন্দা ৭৫ বছরের বৃদ্ধা মীরা প্রামানিক । বিষধর সাপের উপদ্রবের মাঝে ৮০ বছরের বয়স্ক শারিরীকভাবে প্রতিবন্ধী স্বামীকে নিয়ে প্রাণ হাতে করে ওই ঘরেই বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন ওই বৃদ্ধা । কিন্তু কেন তাদের দেওয়া হল না আবাস যোজনার অনুদান ? উত্তরে বৃদ্ধা মীরাদেবী বলেন,’ঘরের জন্য পার্টির নেতাদের বহুবার বলেছি । কিন্তু তারা বলছে যে ক’দিন পরেই তো তোমরা মরে যাবে । তারপর কে ভোগ দখল করবে তোমাদের নতুন ঘর ? তার থেকে ঘর নেওয়ার দরকার নেই ।’
মেমারি-২ ব্লকের কুচুট গ্রাম পঞ্চায়েতের রোকনপুর গ্রামের একপ্রান্তে বেশ কিছু হতদরিদ্র পরিবারের বসবাস । প্রত্যেকেরই মাটির জরাজীর্ণ ঘর । তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন বৃদ্ধা মীরা প্রামানিক । তার বৃদ্ধ স্বামী রাজেন প্রামানিক শারিরীক ভাবে প্রতিবন্ধী । দম্পতির ছেলেরা রোগে মারা গেছেন । কয়কজন নাতি রয়েছে তাদের । তবে তারা পৃথক সংসারে থাকেন । মীরাদেবী পরিচারিকার কাজ করে দু’জনের কোনো রকমে অন্ন সংস্থান করেন । জরাজীর্ন এক চিলতে মাটির ঘরে একটা কাঠের তক্তাপোষের উপর সারাদিন শুয়ে কাটান মীরাদেবীর স্বামী । এমনকি দরজা পর্যন্ত নেই ঘরটিতে ।
আজ মঙ্গলবার মীরাদেবীর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল সারা বছরের খোরাকি চালের জন্য ঘরের একপাশে রাখা হয়েছে ধান ভর্তি কয়েকটি বস্তা । চার দেওয়ালে ঝোলানো পোশাক পরিচ্ছদ । তক্তার নিচে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী এলোমেলো করে রাখা । বস্তার পাশে একটা গ্যাস সিলিন্ডারে রান্না করছেন মীরাদেবী । স্থানীয় বাসিন্দা শম্ভুনাথ চ্যাটার্জি বলেন, ‘রাজেন প্রামানিক পঙ্গু, খোঁড়া মানুষ । উনি উঠতে পারেন না । এই জরাজীর্ন ঘরে প্রাণ হাতে করে থাকতে হয় । মীরাদেবীর পরিচারিকার কাজ করে কোনো রকমে সংসার চালান । গ্রামের নেতাদের একটা ঘর করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন তারা । কিন্তু কোনো কাজ হয়নি । নেতাদের কথায় নাকি মীরাদেবী আগে ঘর পেয়েছেন । কিন্তু ঘর কই পাওয়া দেখিনি আমরা ।’
তবে শুধু মীরাদেবী নন, রোকনপুর গ্রামের ওই পাড়ার একটা পরিবারকেও আবাস যোজনার অনুদান দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ । শম্পা প্রামাণিক নামে এক বধূ স্বামী ও এক নাবালিকা মেয়েকে নিয়ে জরাজীর্ণ ঘরে বসবাস করেন । তারও জোটেনি আবাস যোজনার ঘর ৷ রানী প্রামাণিক নামে এক প্রৌঢ়া বলেন, ‘মাটির জরাজীর্ণ ঘরে আমাদের বসবাস । বৃদ্ধ বিপত্নীক শ্বশুর বসবাসের অযোগ্য একটা মাটির ঘরে থাকেন । সাপের খুব উপদ্রপ । বৃষ্টি হলে ঘরে জল পড়ে । অথচ নিরুপায় হয়ে আমাদের এভাবে অসহায় অবস্থার দিন গুজরান করতে হচ্ছে৷’ তার অভিযোগ,পঞ্চায়েতে গিয়ে আবাস যোজনার ঘর দেওয়ার জন্য বহু অনুনয় বিনয় করেছি । কিন্তু বাবুদের মন গলেনি ।’
জানা গেছে,সম্প্রতি কুচুট গ্রাম পঞ্চায়েতের তরফে আবাস যোজনার অনুদান প্রাপকদের নতুন একটা তালিকা প্রকাশ হয়েছে । কিন্তু তাতে রোকনপুর গ্রামের ওই পাড়ার একটা পরিবারেও নাম নেই । আবাস যোজনার অনুদান থেকে রোকনপুর গ্রামের ওই পাড়ার বাসিন্দারা কেন বঞ্চিত হলেন? এই প্রশ্নের উত্তরে কুচুট গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান মদন মোহন দাস বলেন, ‘প্রশাসনকে বলুন ৷ আগের প্রধানকে বলুন।’ এরপর তিনি সাফাই দেন, ‘সম্প্রতি যে তালিকা প্রকাশ হয়েছে সেটা আগের প্রধানের সময়ের তালিকা । আমাদের কিছু করার নেই ।’ কুন্তল নামে স্থানীয় এক তৃণমূল নেতার কাছে মীরা প্রামানিকের দুর্দশার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি মন্তব্য করেন,’এখন আমাদের কথা চলছে না । আপনি প্রধানকে জিজ্ঞাসা করুন ।’
এদিকে আবাস যোজনার অনুদান নিয়ে মেমারি-২ ব্লকের শাসকদলের নেতাদের এই প্রকার গাছাড়া মনোভাবে আরও হতাশ হয়ে পড়েছেন রোকনপুরের ওই সমস্ত হতদরিদ্র পরিবারগুলি ৷ পরিবারগুলির মতিগতি যা দেখা গেল তাতে ২০২৬ সালের ভোটে ব্যালট বাক্সে এই প্রকার বঞ্চনার জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন তারা । তবে ভোটের এখনো প্রায় দেড় বছর দেরি । এখন দেখার বিষয় যে শাসকদল কিভাবে ড্যামেজ কন্ট্রোল করে ।।