কেন উপনিষদের দ্বিতীয় খণ্ড মূলত ব্রহ্মের স্বরূপ, জ্ঞান ও অজ্ঞানের পার্থক্য এবং আত্ম-উপলব্ধির মাধ্যমে অমরত্ব লাভের পথ নিয়ে আলোচনা করে, যেখানে বলা হয়েছে যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎকে ব্রহ্ম ভাবা ভুল, বরং যিনি ইন্দ্রিয়গুলোকে চালিত করছেন সেই ব্রহ্মই সত্য, এবং যিনি এই সত্য জেনে বিষয়-বাসনা ত্যাগ করেন, তিনিই মুক্তি ও অমরত্ব লাভ করেন।
ব্রহ্মের অপ্রত্যক্ষ স্বরূপ: এটি ইন্দ্রিয় দিয়ে জানা যায় না—কান যা শুনতে পায়, চোখ যা দেখতে পায়, মন যা চিন্তা করে—সেগুলো ব্রহ্ম নয়; ব্রহ্ম হলেন সেই শক্তি যা এই ইন্দ্রিয়গুলোকে চালিত করে।
জ্ঞানের সংজ্ঞা: যিনি ভাবেন যে তিনি ব্রহ্মকে জেনেছেন, তিনি আসলে জানেন না; কিন্তু যিনি জানেন যে তিনি ব্রহ্মকে সম্পূর্ণ জানেন না, তিনিই প্রকৃত জ্ঞানী, কারণ তিনি ব্রহ্মের অসীমতাকে স্বীকার করেন।
আত্ম-উপলব্ধি ও মুক্তি: আত্ম-সচেতন ব্যক্তিরা এই সত্য উপলব্ধি করেন যে ব্রহ্ম সকল জীবের মধ্যে বিরাজমান। এই জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে তারা জাগতিক আসক্তি ত্যাগ করে অমরত্ব লাভ করেন।
অমরত্বের উপায়: কর্ম বা সন্তান দিয়ে নয়, বরং বিষয়-বাসনা ত্যাগ করে এবং inward turning (অন্তর্মুখী) হয়ে ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম হয়েই মানুষ অমরত্ব লাভ করতে পারে।
কেন উপনিষদ – দ্বিতীয় খণ্ড
১) য়দি মন্যসে সুবেদেতি দভ্রমেবাপি
নূনং ত্বং বেত্থ ব্রহ্মণো রূপম্।
য়দস্য ত্বং য়দস্য দেবেষ্বথ নু
মীমাংস্যমেব তে মন্যে বিদিতম্ ॥
অর্থ:- যদি কেউ মনে করেন যে, আমি ব্রহ্মকে ভালমতো জেনে ফেলেছি, তবে একথা নিশ্চিত যে, তিনি ব্রহ্মের স্বরূপ সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানেন না। তিনি জীবাত্মা, দেবতাদের ও দৃশ্যমান জগতে ব্রহ্মের প্রকাশকেই কেবল জেনেছেন। সুতরাং ব্রহ্ম সম্বন্ধে আরও গভীর অনুসন্ধান প্রয়োজন। (শিষ্য): আমার মনে হয়, আমি (ব্রহ্মকে) জানি।
২) নাহং মন্যে সুবেদেতি নো ন বেদেতি বেদ চ।
য়ো নস্তদ্বেদ তদ্বেদ নো ন বেদেতি বেদ চ ॥
অর্থ:- (ব্রহ্মকে) সম্যক্ জেনেছি এমন কথা আমি মনে করি না। জানি না তাও নয়, আবার জানি—তাও বলতে পারি না। শিষ্যদের মধ্যে উপরি-উক্ত বাক্যের অর্থ যিনি জানেন, তিনিই (ব্রহ্মকে) সঠিক জানেন।
৩) য়স্যামতং তস্য মতং মতং য়স্য ন বেদ সঃ।
অবিজ্ঞাতং বিজানতাং বিজ্ঞাতমবিজানতাম্ ॥
অর্থ:- যিনি বলেন যে, তিনি (ব্রহ্মকে) জানেন না, তিনিই ব্রহ্মকে জানেন; যিনি বলেন যে, তিনি ব্রহ্মকে জানেন, তিনি ব্রহ্মকে জানেন না। যাঁরা বলেন যে, তাঁরা জানেন না, এ তত্ত্ব তাঁদেরই জানা; যাঁরা বলেন যে, তাঁরা জানেন, এ তত্ত্ব তাঁদের অজানা।
৪) প্রতিবোধবিদিতং মতমমৃতত্বং হি বিন্দতে।
আত্মনা বিন্দতে বীর্যম বিদ্যয়া বিন্দতেহমৃতম্ ॥
অর্থ:- যখন কেউ ব্রহ্মকে চেতনার সর্বস্তরে, অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে উপলব্ধি করেন তখন তিনি প্রকৃত জ্ঞান লাভ করেন এবং জন্মমৃত্যুর পারে চলে যান। আত্মজ্ঞানের দ্বারা মানুষ শক্তি অর্জন করে; প্রকৃত জ্ঞান লাভ করলে মানুষ অমর হয়ে যায়।
5) ইহ চেদবেদীদথ সত্যমস্তি।
ন চেদিহাবেদীন্মহতী বিনষ্টিঃ।
ভূতেষু ভূতেষু বিচিত্য ধীরাঃ।
প্রেত্যাস্মাল্লোকাদমৃতা ভবন্তি ॥
অর্থ:-কেউ যদি এ জীবনেই আত্মাকে ব্রহ্মরূপে জানতে পারেন, তবে তিনি সর্বোচ্চ জ্ঞানের অধিকারী হন। এই জ্ঞান ছাড়া অশেষ দুঃখভোগ অনিবার্য। কিন্তু প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি, যিনি এই সত্য জানেন যে, ব্রহ্ম সকল বস্তু ও সকল জীবের মধ্যে অনুস্যূত হয়ে আছেন, তিনি নিজেকে এই জগৎ থেকে প্রত্যাহার করে নেন এবং মুক্ত হয়ে যান।

