এইদিন ওয়েবডেস্ক,০৬ ফেব্রুয়ারী : ৩০ জানুয়ারী ১৯৪৮ সাল,সবেমাত্র স্বাধীনতার এক বছর পূর্তি হয়েছে, আর তখনই ঘটে গেল সেই ঘটনা । যা ঘিরে তোলপাড় হয়ে উঠেছিল গোটা দেশ । দিল্লির বিড়লা হাউসের প্রার্থনা সভায় যোগ দিতে যাওয়ার সময় মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে পরপর তিনটি গুলি করে হত্যা করেন আর এক দেশপ্রেমী মহারাষ্ট্রের পুনের বাসিন্দা একজন উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণ নাথুরাম গডসে । পরের বছর তাঁকে আম্বালা জেলে ফাঁসিও দেওয়া হয়। কিন্তু যে নাথুরাম গডসে প্রথম যৌবনে গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, হঠাৎ কী এমন ঘটল যে তিনিই হয়ে উঠলেন গান্ধী ঘাতক ? অবশ্য ফাঁসির আগে গান্ধী হত্যার কারন ব্যাখ্যা করে গেছেন নাথুরাম গডসে । যে কারনে গান্ধীকে হত্যার পরেও আজও এই দেশপ্রেমী মানুষটিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন বহু মানুষ ।
আদালতে দেওয়া তার জবানবন্দির ভিত্তিতে গান্ধী হত্যার কারনগুলি তুলে ধরা হল :-
নাথুরাম গডসে অল্পশিক্ষিত ছিলেন না । গডসে ছিলেন তার সময়ের শিক্ষিত লোকদের মধ্যে একজন। হিন্দু ইতিহাস ও হিন্দু শাস্ত্র এবং তদানীন্তন ভারতীয় রাজনীতি সম্পর্কে ছিল তার গভীর জ্ঞান। হিন্দু মন-মানসিকতা ও চেতনার আলোকে তার কাছে মনে হয়েছিল, গান্ধী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সায় দিয়ে হিন্দুদের পুণ্যভূমিকে দ্বিখণ্ডিত করেছেন । এছাড়া অহিংসার নামে মুসলিম তোষামোদের নীতিসহ গান্ধীর একাধিক দৃষ্টিভঙ্গি নাথুরাম গডসেকে দেশ ও স্বজাতীয়দের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত করে তুলেছিল ।
★ নাথুরামের অভিমত ছিল যে গান্ধীর অহিংসা হিন্দুদের কাপুরুষ করে তুলবে। গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থীকে কানপুরে মুসলমানদের হাতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।গান্ধী গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থীর মতো অহিংসার পথ অবলম্বন করে সকল হিন্দুকে আত্মত্যাগ করার কথা বলতেন। নাথুরাম গডসে আশঙ্কা করেছিলেন যে গান্ধীজির অহিংসা নীতি হিন্দুদের দুর্বল করে দেবে এবং তারা কখনই তাদের অধিকার পেতে পারবে না।
★ ১৯১৯ সালে অমৃতসরে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর, সমগ্র দেশে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। ভারতীয় জনগণ এই গণহত্যার খলনায়ক জেনারেল ডায়ারের বিচারের অভিপ্রায়ে গান্ধীর কাছে গিয়েছিল, কিন্তু গান্ধী স্পষ্টতই ভারতীয়দের এই অনুরোধকে সমর্থন করতে অস্বীকার করেছিলেন।
★ গান্ধী খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন করে ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে । গান্ধী নিজেকে মুসলমানদের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করতেন। কেরালার মোপলা মুসলমানদের দ্বারা ১,৫০০ হিন্দু হত্যা এবং ২,০০০ -এরও বেশি হিন্দুকে মুসলমানে পরিণত করার ঘটনার প্রতিবাদও করেননি গান্ধী ।
★কংগ্রেসের ত্রিপুরা অধিবেশনে, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন কিন্তু গান্ধী তার প্রিয় সীতারামাইয়াকে সমর্থন করছিলেন। গান্ধী সুভাষ চন্দ্র বসুকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন । এই ঘটনাও ক্ষুব্ধ করেছিল নাথুরাম গডসেকে ।
★ মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী ভগৎ সিং, সুখদেব এবং রাজগুরুকে ১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ ফাঁসি দেওয়া হয়। গোটা দেশ গান্ধীর কাছে ওই মহান বিল্পবীদের ফাঁসি স্থগিত করার জন্য প্রার্থনা করছিল, কিন্তু গান্ধী ভগৎ সিংয়ের সহিংসতাকে অন্যায় বলে অভিহিত করে দেশবাসীর এই যুক্তিসঙ্গত দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন । গান্ধীর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী ভগৎ সিং আদপে একজন সন্ত্রাসী ।
★ গান্ধী কাশ্মীরের হিন্দু রাজা হরি সিংকে বলেছিলেন যে কাশ্মীর একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা, তাই সেখানে শাসক একজন মুসলিম হওয়া উচিত। তাই, গান্ধী রাজা হরি সিংকে শাসন ছেড়ে কাশীতে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন, যখন হায়দ্রাবাদের নিজামের শাসন ছিল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় । গান্ধীর নীতি ধর্মের সাথে পরিবর্তন হতে থাকায় নাথুরাম গডসেকে ক্ষুব্ধ করেছিল । যদিও গান্ধীর মৃত্যুর পর, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল হায়দ্রাবাদকে ভারতের সাথে একীভূত করার কাজ করেন । গান্ধী জীবিত থাকলে এটা করা সম্ভব হতো না বলে মনে করা হয় ।
★ পাকিস্তানের ভয়াবহ রক্তপাতের হাত থেকে জীবন বাঁচিয়ে ভারতে আসা বাস্তুচ্যুত হিন্দুরা যখন দিল্লির খালি মসজিদে অস্থায়ী আশ্রয় নেয়। মুসলমানরা মসজিদে বসবাসকারী হিন্দুদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল, যার সামনে গান্ধী মাথা নত করেছিলেন এবং গান্ধী সেই বাস্তুচ্যুত হিন্দুদের, যাদের মধ্যে বহু বয়স্ক, মহিলা এবং শিশু ছিল, হিমশীতল ঠান্ডায় মসজিদের বাইরে রাত কাটাতে বাধ্য করেছিলেন।
★ গান্ধী দিল্লির মন্দিরে তাঁর প্রার্থনা সভায় নামাজ পড়েন, যার বিরোধিতা করেছিলেন মন্দিরের পুরোহিত সহ সমস্ত হিন্দু, কিন্তু গান্ধী এই বিরোধিতাকে উপেক্ষা করেছিলেন। কিন্তু গান্ধী একবারও কোনো মসজিদে গিয়ে গীতা পাঠ করার বিষয়ে উৎসাহ দেখাননি ।
★ বল্লভভাই প্যাটেল লাহোর কংগ্রেসে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হন কিন্তু গান্ধীর জেদের কারণে এই পদটি জওহরলাল নেহরুকে দেওয়া হয়। তার দাবি পূরণের জন্য, গান্ধীজি উপবাস, কারো সাথে কথা না বলার মতো কৌশল অবলম্বন করে তার কাজ করাতে পারদর্শী ছিলেন। এ জন্য তার কাছে নৈতিকতা বা অনৈতিকতার বিন্দুমাত্র বিবেচনাও ছিল না ।
★ ১৯৪৭ সালের ১৪ জুন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির সভায় ভারত ভাগের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু গান্ধী সেখানে পৌঁছে প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। যদিও গান্ধী এক সময়ে নিজেই বলেছিলেন যে তাঁর মৃতদেহ নিয়ে দেশ ভাগ হবে। শুধু দেশ ভাগ হয়নি লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষ খুন হয়েছে কিন্তু গান্ধী কিছুই করেননি ।
★ ধর্মনিরপেক্ষতার নামে মুসলিম তুষ্টির নীতির প্রবর্তক ছিলেন গান্ধী, এমনই অভিযোগ ওঠে । মুসলমানরা হিন্দীকে জাতীয় ভাষা করার বিরোধিতা করলে, গান্ধী আনন্দের সাথে তা গ্রহণ করেন এবং হিন্দির পরিবর্তে হিন্দুস্তানি (হিন্দি + উর্দু এর সংমিশ্রণ) প্রচার শুরু করেন। বাদশা রাম, বেগম সীতা প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার শুরু হয়।
★ কিছু মুসলমান বন্দে মাতরম গাওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে, গান্ধী নড়েচড়ে বসেন এবং এই পবিত্র গানটিকে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হতে দেননি।
★ অনেক অনুষ্ঠানে গান্ধী শিবাজী, মহারানা প্রতাপ এবং গুরু গোবিন্দ সিংকে বিপথগামী দেশপ্রেমিক বলে অভিহিত করেছেন। অন্যদিকে গান্ধী মহম্মদ আলী জিন্নাহকে কায়েদে আজম বলে ডাকতেন।
★ যখন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে, সরকারি খরচে সোমনাথ মন্দির পুনর্নির্মাণের প্রস্তাব পাস হয়, তখন গান্ধী, যিনি এমনকি মন্ত্রিসভার সদস্যও ছিলেন না, সোমনাথ মন্দিরে সরকারি ব্যয়ের প্রস্তাবটি বাতিল করে দেন ১৯৪৮ সালের ১৩ জানুয়ারী আমরণ অনশনের মাধ্যমে। এমনকি সরকারী খরচে দিল্লির মসজিদ পুনর্গঠনের জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেন ।
★ স্বাধীনতার পর ভারতকে একটি চুক্তির আওতায় পাকিস্তানকে ৭৫ কোটি টাকা দিতে হয়েছিল । ভারত ২০ কোটি টাকা দেয় । কিন্তু এর মধ্যেই ১৯৪৭ সালের ২২ অক্টোবর পাকিস্তান কাশ্মীরে আক্রমণ করে। হামলায় ক্ষুব্ধ হয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ৫৫ কোটি টাকা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। গান্ধী এর বিরোধিতা করেন এবং আমরণ অনশন শুরু করেন, যার ফলস্বরূপ ভারত পাকিস্তানকে ৫৫ কোটি টাকা দিতে বাধ্য হয় ।★ অভিযোগ ওঠে যে গান্ধী ছিলেন ভারতের নয়, পাকিস্তানের জাতির পিতা, যিনি পাকিস্তানের দাবি বৈধ বা অবৈধ হোক না কেন প্রতিটি পদক্ষেপে পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ।
উপরোক্ত ঘটনাগুলোকে দেশবিরোধী হিসেবে বিবেচনা করে নাথুরাম গডসে গান্ধীর হত্যাকাণ্ডকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করেন। নাথুরাম আদালতে স্বীকার করেছিলেন যে গান্ধী একজন মহান দেশপ্রেমিক ছিলেন এবং নিঃস্বার্থভাবে দেশের সেবা করেছিলেন। আমি তাকে অনেক সম্মান করি কিন্তু আমি কোনো দেশপ্রেমিককে দেশ ভাগ করে এক সম্প্রদায়ের পক্ষ নিতে দিতে পারি না। গান্ধীকে হত্যা করা ছাড়া আমার কাছে আর কোনো সমাধান ছিল না ।।