ভারতের প্রাচীন শহর বারাণসী তার আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য পরিচিত । এখানেই রয়েছে হিন্দুদের পবিত্রতম প্রাচীন তীর্থস্থান কাশী বিশ্বনাথ মন্দির । শহরটিতে পবিত্র নদী গঙ্গার অসংখ্য ঘাট রয়েছে । যেখানে তীর্থযাত্রী এবং পর্যটকরা আচার, প্রার্থনা এবং অনুষ্ঠান পালন করতে ভিড় করে। এই ঘাটগুলির মধ্যে, একটি বারাণসীর সবচেয়ে পবিত্র এবং প্রাচীনতম শ্মশান হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে তা হল মণিকর্ণিকা ঘাট।
এই ঘাটেই মোক্ষ লাভের আশায় বা পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তির আশায় মৃতদের চিতায় পোড়ানোর জন্য আনা হয়। মণিকর্ণিকা ঘাট হল ৫১ টি শক্তিপীঠের মধ্যে একটি, বা এমন স্থান যেখানে শিবের স্ত্রী দেবী সতীর কর্ণ কুন্তল বা কানের দুল পতিত হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয় । এটাও বিশ্বাস করা হয় যে ভগবান শিব কাশীর মণিকর্ণিকা ঘাটে দেবী সতীর মৃতদেহ দাহ করেছিলেন। তারপর থেকে এটি একটি মহান শ্মশান, যেখানে চিতার আগুন কখনও নেভে না। একটি চিতা নিভে যাওয়ার আগে আরেকটি চিতায় আগুন দেওয়া হয়। এটাই হল মৃত্যুর শিখা যা কখনো নিভে যায় না, অনন্তকাল ধরে প্রজ্জ্বলিত হয়ে থাকে,জীবনের প্রতিটি আলো শেষ পর্যন্ত সেই শিখায় মিশে যায়।
শিব হলেন ধ্বংসের দেবতা, তাই মণিকর্ণিকার আলো শিবের আলোর মতো, যার মধ্যে শেষ পর্যন্ত সবাইকে লীন হতে হয়। মণিকর্ণিকার একই শ্মশানে শিব হোলি খেলেন। শ্মশানে হোলি খেলার মধ্যেও গভীর তত্ত্ব লুকিয়ে আছে । কারন মানুষ মৃত্যুকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। তার প্রতিটি ভয়ের চূড়ান্ত কারণ তার নিজের বা তার প্রিয়জনের মৃত্যু। শ্মশানে হোলি খেলা মানে সেই ভয় থেকে মুক্তি পাওয়া।
শিব শুধু কোন দেহের নাম নয়, শিব হল সেই চরম ত্যাগের নাম যখন মানুষ মৃত্যু যন্ত্রণা, ভয় বা হতাশা থেকে মুক্ত হয়। শিব হওয়ার অর্থ হল ত্যাগের সেই উচ্চতায় পৌঁছানো যখন কারও মৃত্যু ব্যথার কারণ হয় না, বরং এটি জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ হিসাবে বিবেচিত হয় এবং উৎসবের মতো আনন্দের সাথে উদযাপন করা হয়। শিব যখন তার দেহের চারপাশে আবৃত করে বিভূত নিয়ে নৃত্য করেন, তখন তিনি সমস্ত শারীরিক গুণ ও দোষ থেকে মুক্ত হন। এই হল শিবত্ব।
শিব যখন দেবী সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে তান্ডব নৃত্য করছিলেন, তখন তিনি তাঁর মোহের শীর্ষে ছিলেন। তিনি শিব ছিলেন, তবুও তিনি মৃতদেহের সাথে সংযুক্ত ছিলেন। সংযুক্তি খুব শক্তিশালী এবং কাউকে ছেড়ে যায় না। সাধারণ মানুষ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বা তাদের প্রিয়জনের মৃত্যুর সময় মৃতদেহ সংযুক্তিতে ভোগেন। শিব ছিলেন শিব, যখন তিনি থামলেন, তখন তিনি তার প্রিয়তমা স্ত্রীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ছাই দিয়ে হোলি খেলেন এবং তারপর যুগের পর যুগ ধরে ধ্যানে লীন হয়ে যান। কেবলমাত্র আসক্তির শিখরেই বৈরাগ্যের উদ্ভব হয়। কিন্তু মানুষ এই আসক্তি থেকে পালাতে পারে না, যদি সে একটি সংযুক্তি থেকে মুক্ত হয় তবে সে অন্যের ফাঁদে আটকা পড়ে। সম্ভবত এই সংযুক্তি একজন ব্যক্তিকে শিবত্ব অর্জন করতে দেয় না।
কথিত আছে, কাশী শিবের ত্রিশূলের উপর স্থির। শিবের নিজের শহর কাশী, কৈলাসের পরে তিনি কাশীকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। সম্ভবত এই কারণেই কাশী অন্যরকম ত্যাগ নিয়ে বসবাস করে।
মণিকর্ণিকা ঘাট, হরিশচাঁদ ঘাটে যুগ যুগ ধরে দেশ-বিদেশ থেকে গঙ্গার এই পবিত্র তীরে মানুষ মোক্ষের আশা নিয়ে আসছেন, আসলে শিবের অবারিত আলোয় মিশে যাচ্ছেন । ফাল্গুন মাসে কাশীর প্রতিটি কোনায় গুঞ্জিত হয়,’খেলে মশানে মে হোলি দিগম্বর খেলে মশানে মে হোলি’ । সত্য হল শিবের সাথে পৃথিবীর এই মহান শ্মশানে প্রতিটি জীব হোলি খেলছে। যতক্ষণ না সে নিজে সেই মণিকর্ণিকার আলোয় লীন হয়ে যাচ্ছে । আসলে এই পৃথিবীটা হল একটা শ্মশান মাত্র ।।