মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে “বিতর্কিত” ও বহু চর্চিত এক রাজনীতিবিদ ৷ তার তথাকথিত “অহিংস” আন্দোলন এবং আরও এক বিতর্কিত চরিত্র জহরলাল নেহেরুর প্রতি তার অসীম পক্ষপাতিত্ব এখনো মানুষ মেনে নিতে পারে না । এই দুই ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে মানুষের বিস্তর ক্ষোভ আছে৷ আজও গান্ধী ও নেহেরুর প্রকৃত মূল্যায়ন হয়নি । তাদের রাজনৈতিক দল কংগ্রেস, গান্ধী-নেহেরুর বহু বিতর্কিত ইতিহাস গোপন করে গেছে । কিন্তু কংগ্রেস দেড় দশক ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকতেই গান্ধী ও নেহেরুর কিছু কিছু সত্য সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সামনে আসছে ।
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী সম্পর্কে প্রখ্যাত লেখক নীরদ সি চৌধুরী নিজের অভিব্যক্তি ব্যাখ্যা করে গেছেন । তিনি গান্ধীকে “পৃথিবীর সব চেয়ে সফল ভন্ড” বলে অবিহিত করেছিলেন । কারণ তিনি মনে করতেন যে গান্ধীর অহিংসা এবং নৈতিকতার প্রদর্শন আসলে ছিল একটি সুপরিকল্পিত কৌশল, যা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ে সাহায্য করেছিল। চৌধুরীর মতে, গান্ধী যা বলতেন তার সাথে তার কাজের পার্থক্য ছিল। যেমন, তিনি নিজেকে সরল, সাধারণ মানুষ হিসাবে উপস্থাপন করতেন, কিন্তু আসলে তিনি ছিলেন একজন সুচতুর আইনজীবী এবং রাজনীতিবিদ যিনি বিপক্ষকে পরাজিত করার জন্য এই সরলতার মুখোশ ব্যবহার করেছিলেন।
নীরদ সি চৌধুরী মনে করতেন যে গান্ধী নিজেকে একজন আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে উপস্থাপন করতেন, কিন্তু বাস্তবে তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত দক্ষ রাজনীতিবিদ।আইনি ও রাজনৈতিক কৌশলকে গান্ধী সরলতার মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিলেন বলে মনে করতেন তিনি । যখন শহীদ উধম সিং ইংল্যান্ডে জেনারেল ডায়ারকে হত্যা করেন, তখন মহাত্মা গান্ধী তাকে “পাগল” বলে অভিহিত করেন। এই কারণেই বিখ্যাত লেখক শ্রী নিরোদ চৌধুরী লিখেছিলেন, “গান্ধী বিশ্বের সবচেয়ে সফল ভণ্ড।”
তবে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর শিক্ষাগত যোগ্যতা থেকে শুরু করে আরও অনেক কর্মকাণ্ড নিয়ে আজও বিতর্ক হয় । বলা হয় যে গান্ধী তাঁর সারা জীবনে কেবল একটি শিক্ষাগত শংসাপত্র পেতে সক্ষম হয়েছিলেন,আর তা হল ম্যাট্রিকুলেশন সার্টিফিকেট। ১৮৮৭ সালে গান্ধী কোনওভাবে তৃতীয় বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেছিলেন ! তারপরেও কিভাবে তিনি ব্যারিস্টার হলেন ? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা হয় যে তখনকার দিনে ব্যারিস্টার হতে হলে কোন পরীক্ষাই দিতে হতো না, কিছুদিন কোন বয়স্ক এবং অভিজ্ঞ ব্যারিস্টারের সহকারী হিসেবে কাজ করলেই ব্যারিস্টার হিসেবে বার এসোসিয়েশনের সদস্য হওয়া যেতো। কিন্তু এই সহকারী হওয়ার জন্যও গান্ধীর ভারতীয় সার্টিফিকেট এবং তার ফলাফল গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি, এ জন্য গান্ধীকে আবার লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বসতে হয়। প্রথম বার সেই পরীক্ষায় ফেল করার পর গান্ধী দ্বিতীয় বারে কোনমতে পরীক্ষায় পাশ করতে সক্ষম হন এবং একজন ব্যারিস্টারের সহকারী হওয়ার মত যোগ্যতা অর্জন করেন।
অন্যদিকে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ছিলেন একজন আইসিএস। সেই যুগের অনেকেরই খুব বেশি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা ছিল না, যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু তারা স্বশিক্ষিত ছিলেন। কিন্তু গান্ধীর আচরণ থেকে স্পষ্ট যে তাঁর সেই স্বশিক্ষা ছিল না।
অহিংসার নামে গান্ধীর ভন্ডামির কিছু নজির
গান্ধী বলতেন, “একজন সত্যাগ্রহী সর্বদা আক্রমণকারীর হাতে নিহত হতে চাইবে, কিন্তু কাউকে হত্যা করতে চাইবে না”। যেখানে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম প্রাণীটিও আত্মরক্ষার জন্য লড়াই করে এবং পৃথিবীতে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে, সেখানে গান্ধীর নীতির অসারতা সহজেই অনুমেয়। আসলে গান্ধীর অহিংস নীতি এক অর্থে ছিল ভন্ডামির নামান্তর । আর তার এই ভন্ডামির কিছু প্রমানও পাওয়া যায় ।
বলা হয় যে গান্ধী পক্সের টিকা দেওয়াকে পাপ বলে মনে করতেন। এর মূল কারণ হলো গান্ধী পশ্চিমা চিকিৎসা ব্যবস্থার বিরোধী ছিলেন। কারণ তিনি ইনজেকশন এবং অস্ত্রোপচারকে হিংস্রতা বলে মনে করতেন।
১৯৪৮ সালে গান্ধীর স্ত্রী কস্তুরবাই ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। ডাক্তার তাকে পেনিসিলিন ইনজেকশন দিতে বলেন। আর সেই কারণেই ব্রিটিশ সরকার লন্ডন থেকে তাকে পেনিসিলিন ইনজেকশন এনে দেয়। কিন্তু গান্ধী সহিংসতার নামে ইনজেকশনটি তার স্ত্রীকে দিতে দেননি । ফলস্বরূপ, গান্ধীর স্ত্রী মারা যান। কিন্তু অন্যদিকে, ১৯২২ সালে, যখন গান্ধীর কারাবাসের সময় ডায়রিয়া হয়, তখন ডাক্তার তাকে নিয়মিত ইনজেকশন নিতে বলেন, তিনি ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করেন এবং সুস্থ হয়ে ওঠেন।
তারপর গান্ধীজীর অ্যাপেন্ডিসাইটিস হয়, তারপর গান্ধীরও অস্ত্রোপচার করা হয়। অর্থাৎ অহিংস নীতি অন্যের উপর প্রয়োগ করাই ছিল গান্ধীর নীতি৷
নেতাজি বলেছিলেন, “যখনই গান্ধীজি ব্রিটিশদের নির্দেশে কোনও আন্দোলন শুরু করতেন, তখনই তিনি তাঁর শয়তানবাদ দমন করতে অথবা দেশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য অনশন শুরু করতেন।” গান্ধীর অনশন এবং কারাবাস ছিল ব্রিটিশ পরিকল্পনার অংশ।ডঃ আম্বেদকরের মতে, “গান্ধীজি কঠোরতার অনুরাগী ছিলেন এবং নরমতার সংযম ছিলেন।” দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালীন, গান্ধী একবার হিন্দু, খ্রিস্টান এবং ইসলামের তুলনা করে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন, যা মুসলমানদের ক্ষুব্ধ করেছিল এবং ১৯০৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তাকে আক্রমণ করেছিল। তারপর থেকেই গান্ধী মুসলমানদের সমালোচনা করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং তারপর থেকে তিনি মুসলমানদের সবচেয়ে জঘন্য অপরাধকেও অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করেননি।
মোহনদাস গান্ধী নাকি খুবই সাধারণ জীবনযাপন করতেন ! এটাও ছিল গান্ধীর প্রচারণার একটা অঙ্গ ।
কারন ১৯২২ সালে, গান্ধী যখন স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার সময় গ্রেপ্তার হন এবং পুনেতে কারারুদ্ধ হন, তখন কারাগারের দুটি কক্ষ চিরশত্রু ব্রিটিশরা তাকে বরাদ্দ করে। একটি ঘুমানোর জন্য এবং অন্যটি চরকা কাটার জন্য। তার প্রতিদিনের খাবারের তালিকা ছিল: ২৫০ গ্রাম আটার রুটি, মাখন, দেড় কেজি ছাগলের দুধ, চারটি কমলা, দুটি লেবু, ৫০ গ্রাম কিশমিশ এবং সোডা ।
শহীদ ভগত সিংকে ফাঁসির মঞ্চে ঝুলানোর সময়, “অহিংসাই পরম ধর্ম” এই বাক্যাংশের প্রবর্তক এবং প্রচারক, তথাকথিত অহিংসার পুজারী গান্ধী বলেছিলেন, “আমরা ব্রিটেনের ধ্বংসের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা চাই না।” তিনি আরও বলেছিলেন, “ভগত সিং-এর প্রতি শ্রদ্ধার ফলে দেশ কষ্ট পেয়েছে এবং এখনও কষ্ট পাচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা উচিত যাতে ৩০শে মার্চ করাচিতে কংগ্রেস অধিবেশনে কোনও বাধা না থাকে।”
ব্রিটিশরা যখন আরেক মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী যতীন দাসকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, তখন গান্ধী আগ্রায় ছিলেন । যখন গান্ধীকে তাঁর পার্থিব দেহে মালা পরাতে বলা হয়েছিল, তখন তিনি স্পষ্টতই অস্বীকার করেছিলেন। মহান শহীদ যতীন দাসের দেশের জন্য এই আত্মত্যাগ গান্ধীর সামান্যতম সহানুভূতি অর্জন করতে সক্ষম হয়নি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কংগ্রেস এবং গান্ধী ব্রিটিশদের সমর্থন করেছিলেন। সাধারণত যুদ্ধক্ষেত্রে কোনও সৈনিক ভালোবাসার বশবর্তী হয়ে অন্য পক্ষের সৈনিককে মিষ্টি উপহার দিতে আসে না, সেখানে হিংসার প্রতিফলন দেখা যায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল,কথিত অহিংসার পুজারী গান্ধী ঠিক এক কাজটাই করেছিলেন ।
১৯৩৯ সালে যখন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু এবং গান্ধীর মনোনীত প্রার্থী ডঃ পট্টভী সীতারামাইয়া কংগ্রেস সভাপতি পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, তখন গান্ধী বলেছিলেন, যদি ডঃ পট্টভী সীতারামাইয়া নির্বাচনে হেরে যান, তাহলে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেবেন। বলা বাহুল্য, নেতাজি বিপুল ভোটে নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলেন (যদিও পরে তিনি মহাত্মা গান্ধীর চাপে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন)। যদিও আমরা দেখতে পাই যে গান্ধী তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। একইভাবে, মহাত্মা গান্ধীর আরেকটি উক্তি ছিল, “যদি পাকিস্তান তৈরি হয়, তবে তা আমার মৃতদেহের উপর থাকবে।” যদিও পাকিস্তান তৈরি হয়েছিল তাঁর পূর্ণ সমর্থনেই তৈরি হয়েছিল।
গান্ধী তাঁর জীবনে তিনটি (সত্যাগ্রহ) আন্দোলন শুরু করেছিলেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, তিনি তিনটি আন্দোলনই মাঝখানে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও,কংগ্রেস ভারতে প্রচার করেছিল যে গান্ধী চরকা ব্যবহার করে ভারতকে স্বাধীন করেছিলেন । এটা দেশবাসীর সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয় । সেই কারনে ইতিহাসবিদ আর সি মজুমদার ভারতের স্বাধীনতা সম্পর্কে লিখেছেন, “গান্ধীর গলায় ভারতের স্বাধীনতার বিজয় মালা হবে সত্যকে উপহাস করা এবং সত্য দিয়ে উপহাস করা। এটা বলা সম্পূর্ণ অর্থহীন হবে যে তিনি সত্যাগ্রহ এবং চরকা দিয়ে স্বাধীনতা এনেছিলেন।” আরও স্পষ্ট ভাষায় ঋষি অরবিন্দ বলেছিলেন- “গান্ধীবাদের আদর্শ থেকে মুক্তি পেলে ভারত ততটাই স্বাধীন হবে ।”
ভারতের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরকারী ক্লিমেন্ট রিচার্ড অ্যাটলি ১৯৫৬ সালে একবার ভারত সফর করেছিলেন এবং কলকাতায় তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর বিচারপতি পিবি চক্রবর্তীর অতিথিশালায় অবস্থান করেছিলেন।
পিবি চক্রবর্তী বলেছিলেন, “আমি ক্লিমেন্ট অ্যাটলিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আপনি কেন নেতাজির সামরিক কার্যকলাপ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন ?” তখন তিনি বলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনীর মধ্যে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ তৈরি হচ্ছে। তারা আর অনুগত নেই।
বিচারপতি পিবি চক্রবর্তী বলেন, “আমি আরও জানতে চেয়েছিলাম, ভারত ত্যাগের পিছনে গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের ভূমিকা কী ছিল?”
অ্যাটলি তখন মুখের কোণে ব্যঙ্গাত্মকভাবে হেসে বললেন, “মি-নি-মাল-এর অর্থ (সামান্য)।” নেতাজির ভয়ে যারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছিল, তারা স্বীকার করছে যে তারা নেতাজি সুভাষের ভয়ে পালিয়েছিল, আর আমরা সাড়ে সায় দশক ধরে গান্ধীর নামে ঢাক পেটাচ্ছি ।।
তথ্যসূত্র:
১) “আম্বেদকর বনাম গান্ধী”,
২) গান্ধীজির অপকর্ম”,
৩) “আমি সুভাষ বলছি”,
৪) ”সুভাষ ঘরে ফেরে নাই”,
৫) গান্ধীর আত্মজীবনী “My Experiment with truth”, ৬) “হস্তান্তর”– শ্রীশঙ্কর ঘোষ,
৭) নীরদ চৌধুরী ও ঐতিহাসিক আর সি মজুমদারের লেখা গ্রন্থ ।

