এইদিন ওয়েবডেস্ক,কলকাতা,১৫ ডিসেম্বর : ভারতের স্বাধীনতা নাকি হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সমান লড়ায়ের পরিনতি : এই ধারনাটি দেশকে গেলানোর বহু চেষ্টা করে আসছে কংগ্রেস ও বামপন্থীদের মত ছদ্ম ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলি । অবশ্য তাদের একটাই লক্ষ্য হল তোষামোদি রাজনীতি করে দেশের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের ভোট নিজেদের দিকে টেনে এনে ক্ষমতা দখল করা । এই ষড়যন্ত্রে তারা বারবার সাফল্যও পেয়ে এসেছে । আর একটা বিষয় হল যে কংগ্রেস ও বামপন্থী ছদ্ম ধর্মনিরপেক্ষরা স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের(আরএসএস) এর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে মাঝেমধ্যেই বাজার গরম করার চেষ্টা করে । সেই সমস্ত ছদ্ম ধর্মনিরপেক্ষদের সামনে একটা অপ্রিয় প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে তাদের রোষের মুখে পড়েছেন ত্রিপুরার প্রাক্তন রাজ্যপাল ও বিশিষ্ট দক্ষিণপন্থী লেখক তথাগত রায় । তিনি রাখঢাক না করে ওই সমস্ত ভন্ডদের উদ্দেশ্যে একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেছেন,”কোন মুসলিম বাঙালি ফাঁসিতে ঝুলেছিলেন ?”
বিষয়টি সম্পর্কে তথাগত রায় এক্স-এ লিখেছেন, মুসলমানদের মধ্যে কে ফাঁসিতে ঝুলেছিলেন – প্রশ্ন করাতে অনেকে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন দেখছি । যারা দিয়েছেন, তাদের ভাষাটা বাংলা হলেও নামগুলো আরবী, অতএব বোঝাই যায় তারা ধর্মে মুসলমান, অতএব তাদের ক্ষোভ হওয়া অস্বাভাবিক নয় । সঙ্গে কিছু বাঙালি নামধারী খৎনা করা হিন্দুও আছেন দেখছি । তা থাকুন । কিন্তু সত্য হিন্দু- মুসলমান মেনে চলে না, মমতার নির্বাচনী প্রচারকেও খাতির করে না । স্বামী বিবেকানন্দের উক্তি স্মরণীয়, “সত্যের জন্য সব কিছুকে ত্যাগ করা চলে, কিন্তু কোন কিছুর জন্যেই সত্যকে বর্জন করা চলে না “।
তাই সত্য কি, দেখা যাক । প্রথমে বাঙালি হিন্দুদের কথা ।
এই বিষয়ে তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে লিখেছেন,ক্ষুদিরাম বসু থেকে তারকেশ্বর দস্তিদার পর্যন্ত সাত জন বাঙালি ফাঁসিতে ঝুলেছেন । সংখ্যাটা এর বেশি বই কম নয় । এর উপরে আছেন প্রফুল্ল চাকী, বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত সদৃশ বিপ্লবীরা, যারা ফাঁসির দড়িকে ফাঁকি দিয়ে নিজেদের জীবন নিয়েছিলেন। সবাই হিন্দু। আন্দামান সেলুলার জেলে ব্রিটিশের হাতে অসম্ভব নির্যাতিত রাজবন্দীদের যে স্মারক ফলক আছে তাতে ৫৮৫ জনের মধ্যে ৩৯৮ জন (৬৮ শতাংশ) বাঙালি হিন্দু বিপ্লবী । মনে রাখতে হবে, এই সময় বাংলা ছিল মুসলিম-প্রধান প্রদেশ, কিন্তু একজন বাঙালি বা অবাঙালি মুসলমানের নামও আমি তার মধ্যে পাইনি – এক-আধটা মিস করে গিয়ে থাকতে পারি । চট্টগ্রাম সে সময় ছিল মুসলিম-প্রধান জেলা (প্রায় ৬৫% মুসলমান) কিন্তু মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে যে অস্ত্রাগার লুন্ঠন হয়েছিল তাতে একজন মুসলমানেরও কোন ভূমিকা ছিল না ।
তিনি লিখেছেন,এবার মুসলমানেরা ।ক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর কাছে প্রথমেই বলি একমাত্র – একমাত্র – মুসলমান যিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপ্লবী কার্যক্রম করে ফাঁসিতে ঝুলেছিলেন, তাঁর নাম আসফাকুল্লাহ খান । যারা তা ঝোলেননি তাঁদের মধ্যে খান আব্দুল গাফ্ফার খান ও মৌলানা আবুল কালাম আজাদও নিঃসন্দেহে স্বাধীনতা সংগ্রামী ।বাকিদের ফিরিস্তি দিচ্ছি ।
তথাগত রায় লিখেছেন,টিপু সুলতান, তিতু মীর, হাজী শরীয়তউল্লাহ, দুদু মিয়া ইত্যাদিরা স্বাধীনতা সংগ্রামী তো নয়ই, বরঞ্চ নিজেদের চরম সাম্প্রদায়িক ইসলামী রাজত্ব কায়েম করার জন্য কাজ করেছিল । টিপু সুলতান শুধু হিন্দুদের উপর অত্যাচার করেনি,পশ্চিম উপকূলের খ্রিস্টানদেরও অকথ্য নির্যাতন করেছিল । তিতু মীর বাঙালি মুসলমানদের দাড়ি রাখতে, লুঙ্গি পরতে, আরবী পড়তে শিখিয়েছিল, যাতে তাদের থেকে হিন্দুদের ব্যবধান বাড়ে – তার আগে হিন্দু ও মুসলমান অনেক বেশি সৌহার্দ নিয়ে পাশাপাশি বাস করত। হাজী শরীয়তউল্লাহ ও তার পুত্র দুদু মিয়া শুধু মুসলমানদের নিয়ে ধর্মান্ধ ফরাজী আন্দোলন আরম্ভ করেছিল – স্বাধীনতা সংগ্রাম বলতে আমরা যা বুঝি তার সঙ্গে তার সুদূরতম সম্পর্কও ছিল না । এই সব প্রক্রিয়ায় তাদের সঙ্গে ব্রিটিশ রাজশক্তির সংঘর্ষ হয়েছিল, তাতেই তারা হয়ে গেল স্বাধীনতা সংগ্রামী?
তিনি লিখেছেন,আলী মুসলিয়ার, কুনহামহাম্মাদ হাজি ইত্যাদিরা মালাবার অঞ্চলের (বর্তমান উত্তর কেরালার) মোপলা বিদ্রোহের নেতা । এটি ব্রিটিশ -বিরোধী বিদ্রোহ নামেই, কাজে এটি ছিল হিন্দুদের একটি গণহত্যার প্রক্রিয়া, এবং এরই ফলে এদের ফাঁসি হয় । এরা ওই অঞ্চলে আনুমানিক দশ হাজার হিন্দু খুন করেছিল । আলী ভ্রাতৃদ্বয় (মৌলানা মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলী) খেলাফত আন্দোলনের নেতা ছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল তুর্কিতে খলিফাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা – এর সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতার দাবীর কোন সম্পর্ক ছিল না । শওকত আলী বলেছিল হিন্দু-মুসলিম ঐক্য তখনি প্রতিষ্ঠিত হবে যখন হিন্দুরা তাদের ধর্ম ছেড়ে ইসলাম কবুল করবে । এদের খ্যাতির কারণ, শয়তান মোহনদাস গান্ধী এদেরকে তৈলমর্দন করত, এমনকি গণহত্যাকারী মোপলা নেতাদের প্রশংসা করেছিল এই বলে যে তারা ধর্মভীরু ও সাহসী, তাদের ধর্মে যা বলেছে তারা তাই করেছে । কংগ্রেস সভাপতি আনি বেসান্ত (ইংরেজ মহিলা) গান্ধীর এই ভণ্ডামির প্রভূত নিন্দা করেছিলেন ।
তিনি বলেন,কেউ কেউ বেগম রোকেয়া, কাজী নজরুল ইসলামের নামও করেছেন দেখছি । এঁরা নমস্য মানুষ, কিন্তু কোন অর্থেই স্বাধীনতা সংগ্রামী নন । বেগম রোকেয়া মুসলমান মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার প্রচারের চেষ্টা করেছিলেন বলে মোল্লা-মৌলবীদের কাছে প্রচুর গালি খেয়েছিলেন । এঁদের সঙ্গে নাম করতে হয় কাজী আব্দুল ওদুদ, এস ওয়াজেদ আলী, রেজাউল করিম (মুর্শিদাবাদের)। নজরুল বাংলায়, মৌলানা হজরত মোহানী উর্দুতে দেশাত্মবোধক কবিতা লিখেছেন, কিন্তু তাতে এঁরা কেউই স্বাধীনতা সংগ্রামী হয়ে যান নি ।
তথাগত রায়ের মতে, প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধে (তথাকথিত সিপাহী বিদ্রোহ) দিল্লির অথর্ব মোঘল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরকে সিংহাসনে বসাবার জন্য লড়াই হয়েছিল । ইংরেজরা যে অর্থে বিদেশী, মোঘলরাও তাই । তবে বেচারা অথর্ব সম্রাটের কোন দায়িত্ব ছিল না, শুধু বিদ্রোহের মুখ হওয়া ছাড়া – এই করতে গিয়ে তার দুই নাতি খুন হল, নিজে বর্মায় নির্বাসিত হলেন ।খুচরো-খাচরাদের কথা বাদ দিলাম । সিপিআই(এম)-এর ‘কাকাবাবু’ মুজফ্ফর আহমেদ একটা অদ্ভুত সাফাই দিয়েছেন, কেন বাঙালি মুসলমানেরা অগ্নিযুগে বিপ্লবী সংগ্রামে সামিল হয় নি । তিনি বলেছেন, এই সব বিপ্লবীরা গীতা ছুঁয়ে শপথ নিত, কোন একেশ্বরবাদী মুসলিম ছেলে কি করে এই কাজ করতে পারে? বুঝলাম । কিন্তু তারা তো কোরান ছুঁয়ে একটা সমান্তরাল আন্দোলন করতে পারত ! করে নি কেন ?
পরে তিনি আরও একটা পোস্টে লিখেছেন, আরএসএস – এর কেউ ব্রিটিশ-বিরোধী লড়াইতে ফাঁসিতে কেন ঝোলে নি সেটা নিয়ে অনেকের খুব কৌতূহল আছে দেখছি । বহুবার বলেছি, আবারও বলছি – কজনের খুলি ভেদ করে ঢুকবে সেটা আমার বিবেচ্য নয়। ফাঁসিতে ঝোলা, বা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেওয়াটা সম্ভব শুধু রাজনৈতিক সংগঠনের দ্বারা । এইটা সর্বাগ্রে বুঝতে হবে । এইজন্যই বিশ্বভারতী, আর্যসমাজ, ব্রাহ্মসমাজ, রামকৃষ্ণ মিশন, মোহনবাগান ক্লাব, থিওজফিক্যাল সোসাইটি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, ভারত সেবাশ্রম সংঘ, হাওড়া কুষ্ঠ কুটির – এরা কেউই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়নি । কারণ এরা কেউই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিল না। তেমনি আরএসএস -ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিল না, এখনও নয় । তাই আরএসএস-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেবার কোন প্রশ্ন ওঠে না ।
সব শেষে তথাগত রায় ব্যাখ্যা করেছেন,আরএসএস একটি সমাজ-সংস্কারমূলক আন্দোলন, যার একমাত্র উদ্দেশ্য হিন্দু সমাজকে হিন্দু হিসাবে (বাঙালি-বিহারী অথবা উচ্চবর্ণ-নীচবর্ণ হিসাবে নয়) জাগ্রত ও সংগঠিত করা।এই কাজে আরএসএস ১০০% সফল, এবং তার ফলে এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ ঐচ্ছিক প্রতিষ্ঠান।
উল্লেখ্য, মুসলিম লীগ কিন্তু পুরোদস্তুর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিল ও আছে । কিন্তু তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ শূন্য, ফাঁসি যাওয়া তো দূরস্থান । তাই নিয়ে তারা লজ্জিতও নয়, কারণ তারা বিনা কষ্টে স্বাধীনতার লড়াইয়ের ফায়দা লুটেছে, তারপর তারা পাকিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর অসহ্য নির্যাতন করে তাদের ঘরছাড়া করেছে ।।

