“সারে জাহাঁ সে আচ্ছা,হিন্দুস্তাঁ হমারা” কবিতায় আল্লামা মুহম্মদ ইকবাল লিখেছেন-“কুছ বাত হ্যায় কি হস্তী মিটতী নহী হমারা/সদিয়ো রহা হ্যায় দুশমন দৌড়-এ-জামান হমারা ।” যার অর্থ হল : পৃথিবী বহু শতাব্দী ধরে আমাদের শত্রু কিন্তু এমন কিছু আছে যাতে আমাদের ব্যক্তিত্ব বিবর্ণ হয় না।
তাঁর এই কথা বলার পেছনে কি কারণ আছে ?
মনে করা হয় যে ইকবাল এখানে যে ব্যক্তিত্বের কথা বলেছেন তা হল “হিন্দুত্ব”-এর ব্যক্তিত্ব; যা কখনো শেষ হয় না, উল্টো যা কিছু কাছে আসে তার মধ্যে আত্মসাৎ হয়ে যায় । একজন ধর্মপ্রচারক যখন হিন্দুত্বের এই অবিনাশী ও আত্মীকরণ শক্তি দেখতে ভারতে আসেন, তিনি দীর্ঘ গবেষণার পর বলেছিলেন,
“বন্ধু ! এই ধর্ম সম্পর্কে এটি একটি খুব অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করছি । যখন চার্বাক বেদের সমালোচনা করলেন তারা তাকে ঋষি ঘোষণা করেছিল এবং তার দর্শনকে তাদের স্বীকৃত দর্শনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছিল । বুদ্ধ যখন ভিন্ন কিছু করতে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন এই লোকেরা তাকে অবতার ঘোষণা করেছিল। তারা তাদের এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে এমনভাবে শুষে নেয় যে বৌদ্ধরা তাদের আদি স্থানে বিলুপ্ত হয়ে যায় । তারা মহাবীর স্বামীকে উপরে স্থান দিয়েছিল যে জৈনরা ভিন্ন রূপে আবির্ভুত তো হয় কিন্তু বিকাশ লাভ করতে পারেনি । মুঘল আমলে শেষ পর্যায়ে হিন্দু ধর্মে তারা বিলীন হতে শুরু করেছিল কিন্তু ইংরেজরা এসে যাওয়ায় তা সম্ভব হয়নি,তাহলে জৈন ধর্মের পৃথক অস্তিত্ব বলে কিছু থাকত না । যখন কবির, নানক এবং শিখ ধর্মের গুরুরা আবির্ভূত হন,তখন অনেকেই তাদের শিষ্য হন কিন্তু নিজেদের উৎস ত্যাগ করেননি । মহর্ষি দয়ানন্দ যখন পুরাণ ও মূর্তিপূজোর বিরোধিতা করতে বেরিয়ে আসেন, তখন তাঁকে ধর্ম থেকে বহিষ্কার না করে এই লোকেরা তাঁকে মহর্ষি ঘোষণা করে আত্মসাৎ করে নেয় । আর সবথেকে বড় কথা এই ধর্ম কোন প্রকার হিংসা, রক্তপাত বা প্রতিশোধ ছাড়াই এসব কাজ করেছে।”
এই সব লেখার পরে, মিশনারি লিখেছেন যে আসলে হিন্দু ধর্ম একটি অক্টোপাসের মতো, যে কেউ এর আশেপাশে যাবে তাকে শুষে নেবে । তিনি অন্যান্য ধর্মপ্রচারকদের তাদের সাথে আচরণ করার সময় খুব সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন; নইলে তোমরা সবাই একদিন তাদের মধ্যে মিশে যাবে বলে সতর্ক করেছিলেন ।
এখন আসা যাক আল্লামা ইকবালের ওই উক্তি প্রসঙ্গে । তিনি প্রকৃতপক্ষে কি বলতে চেয়েছিলেন ? কি সেই শক্তি যা হাজারো আক্রমণের মুখেও হিন্দুদের ধ্বংস হতে দেয়নি? বিশ্ব দিগন্তে কে তার সমস্ত মহিমায় উজ্জ্বল? প্রতিকূল ও নিষ্ঠুর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মাঝে তুলসী, কবির, নানক, চৈতন্য, দয়ানন্দ সরস্বতী, বিবেকানন্দ, সাভারকার, গোলওয়ালকরের মতো ঋষিদের জন্ম দিয়েছিলেন, যারা খোলাখুলিভাবে সত্যের কথা বলেছিলেন এবং নিজ ধর্মে প্রত্যাবর্তনের কথা বলেছিলেন,কোন সেই মহান শক্তির প্রভাবে ?
সর্বোপরি, কেন বেদকে পশুপালকের গান ঘোষণা করা হয়েছিল অথচ আমরা ধ্বংস হলাম না?
সরস্বতী নদীকে পৌরাণিক কাহিনী বলা হতো, অথচ আমরা কি ধ্বংস হয়ে গেছি ?
ভগবান রাম ও কৃষ্ণকে কাল্পনিক বলা হয়,অথচ আমরা কি ধ্বংস হয়ে গেছি ?
কাশী, মথুরা, অযোধ্যা, সোমনাথ সহ হাজার হাজার ধর্মীয় স্থান ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল, তারা কি আমাদের ধ্বংস করতে পেরেছে ?
আমাদের থেকে উদ্ভূত সম্প্রদায়গুলিকে আলাদা করার চেষ্টা করা হয়েছিল বহুবার এবং এখনো হচ্ছে, কিন্তু তারা আমাদের ধ্বংস করতে পারেনি। এর কারণ হল হিন্দুধর্ম একটি “ধর্ম”, এটি একটি বিশ্বাস, ধর্ম বা সম্প্রদায় নয়, তাই এটি ধ্বংস করা যায় না।
সাহিত্যিক “কমলেশ্বর” পাকিস্তান সফরের পর একটি বই লিখেছেন; যেখানে তিনি পাকিস্তানের একজন মুসলিম চরিত্রের মাধ্যমে হিন্দু ধর্মের প্রতি নিজের মনের বিষ উগরে দিয়েছিলেন । তার কথায় হিন্দু ধর্মে অনেক ত্রুটি রয়েছে যার দরুন তাদের ভিতর থেকে বৌদ্ধ, জৈন, শিখ ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্ম তৈরি হতে থাকে। কিন্তু কমলেশ্বর যাকে হিন্দুধর্মের ভাঙন বলছিলেন তা আসলে হিন্দু ধর্মের বটবৃক্ষের শাখা-প্রশাখার বিস্তার, অর্থাৎ বুদ্ধ যখন বৌদ্ধ দর্শন এনেছিলেন, মহাবীর এনেছিলেন জৈন দর্শন, নানক নিয়ে এসেছিলেন গুরমত, তারা হিন্দু ধর্মকে দুর্বল করেনি; বরং আরো সমৃদ্ধ করেছিলেন ।
হিন্দু যদি একটি “ধর্ম” না হয়ে একটি মতামত বা একটি ধর্ম বা একটি সম্প্রদায় হত,এই ধর্ম থেকে যদি কিছু বা অনেক কিছু কেড়ে নেওয়া হত তাহলে এই ধর্ম এতদিন ধ্বংস হয়ে যেত । উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনি খ্রিস্টধর্ম থেকে তাদের খ্রিস্ট-বেথলেহেম এবং বাইবেল কেড়ে নেন তবে তাদের কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। ইসলাম থেকে কিতাব-নবী ও মক্কা-মদিনা মুছে দিলে তাদের কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না, জাদুকরদের থেকে আগুন ছিনিয়ে নিলে সে শক্তিহীন হয়ে পড়বে, ইহুদি- শিখ-বৌদ্ধ-জৈন-কবিরপন্থীদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য৷
শুধুমাত্র হিন্দুরা ব্যতিক্রম কারণ তারা কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় আবদ্ধ নয় । তারা সীমাবদ্ধ নয়,হিন্দু ধর্মে কোনো বৃত্ত আঁকা হয়নি,হিন্দুরা জ্ঞানের বা চিন্তার কোনো সীমারেখা নির্ধারণ করেনি,তারা কাউকে কখনও বিধর্মী বা ধর্মত্যাগী ঘোষণা করেনি; তাই কবির-রাইদাস-তুলসী-রামকৃষ্ণ পরমহংস-ভট্ট প্রভৃতি একজন নিরক্ষর সাধকও এই ধর্মকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এবং প্রতিটি যুগে হিন্দু ধর্ম ক্রমাগত বিস্তৃত হচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকবে।
হিন্দুত্বের বৃত্তের মধ্যে যে সমস্ত চিন্তা, প্রকৃতি, মানসিকতা এবং চিন্তাভাবনা থাকবে তা চিরন্তন থাকবে, বাকি সব ধ্বংস হয়ে যাবে। ভারত হিন্দুই রয়ে গেছে কারন তারা কোনো পন্থ নয়,তারা কোনো সম্প্রদায় নয়,তারা কোনো ধর্ম নয়,তারা কোনো মতাবলম্বী নয়, হিন্দু ধর্ম হল চিরস্থায়ী চিরন্তন । ইকবাল যে “কুছ বাত হ্যায়” সম্পর্কে বলেছিলেন আসলে সেটা হল… অবিনাশী হিন্দু ধর্ম ।।
★ মডিফায়েড হিন্দু ৯-এর প্রতিবেদনের অনুবাদ ।

