নবাব মির্জা মুহাম্মাদ সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বাংলা-বিহার-ওড়িশার অন্যতম অবৈধ দখলদার । সিরাজউদ্দৌলা তার দাদু নবাব আলীবর্দী খানের কাছ থেকে ২৩ বছর বয়সে ১৭৫৬ সালের ৯ এপ্রিল বাংলার নবাবের ক্ষমতা অর্জন করেন। তার রাজত্বকাল স্থায়ী হয়েছিল ২৩ জুন ১৭৫৭ পর্যন্ত । দাম্পত্য জীবনে সিরাজউদ্দৌলার তিনজন বেগম ছিল । তারা হলেন : লুৎফুন্নেসা বেগম,জেবুন্নেসা বেগম ও উমদাদুন্নেসা বেগম । অনান্য ইসলামি হানাদারদের পাশাপাশি এই সিরাজউদ্দৌলাকেও মহিমান্বিত করেছে দেশের বামপন্থী ইতিহাসকাররা । সিরাজকে তারা “প্রেমিক” আখ্যা দিয়ে হাতে গোলাপ ফুল ধরিয়ে প্রেমের মূর্ত প্রতীক বানিয়েছে । এই কুকর্ম শুরু হয় ইংরেজের আমল থেকে । পরে স্বাধীন ভারতের ইতিহাসকাররা একজন “লম্পট” ও “অত্যাচারী” শাসককে মহান হিসাবে চিত্রিত করে গেছে ।
সিরাজউদ্দৌলা সম্পর্কে মনীষী ও অনান্য ইতিহাসকাররা ঠিক কি বলে গিয়েছিলেন, জানলেই বুঝতে পারবেন তার প্রকৃত চরিত্র কেমন ছিল । নবাব সিরাজদৌলা সম্পর্কে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন, ‘সিরাজ উদ্দৌলা, সিংহাসনে অধিরূঢ় হইয়া, মাতামহের পুরাণ কৰ্ম্মচারী ও সেনাপতিদিগকে পদচ্যুত করিলেন। কুপ্রবৃত্তির উত্তেজক কতিপয় অল্পবয়স্ক দুষ্ক্রিয়াসক্ত ব্যক্তি তাঁহার প্ৰিয়পাত্র ও বিশ্বাসভাজন হইয়া উঠিল। তাহারা, প্ৰতিদিন, তাঁহাকে কেবল অন্যায্য ও নিষ্ঠুর ব্যাপারের অনুষ্ঠানে পরামর্শ দিতে লাগিল। ঐ সকল পরামর্শের এই ফল দর্শিয়াছিল যে, তৎকালে, প্ৰায় কোনও ব্যক্তির সম্পত্তি বা কোনও স্ত্রীলোকের সতীত্ব রক্ষা পায় নাই”।
রমেশচন্দ্র মজুমদার, নবাব ঘনিষ্ট ফরাসী অধ্যক্ষ জ্যাঁ ল-এর লেখা থেকে বলেছেন, “আলীবর্দীর মৃত্যুর পূর্বেই সিরাজ অত্যন্ত দুশ্চরিত্র বলিয়া কুখ্যাত ছিলেন। তিনি যেমন কামাসক্ত তেমনই নিষ্ঠুর ছিলেন। গঙ্গার ঘাটে যে সকল হিন্দু মেয়েরা স্নান করিতে আসিত তাহাদের মধ্যে সুন্দরী কেহ থাকিলে সিরাজ তাঁহার অনুচর পাঠাইয়া ছোট ডিঙ্গিতে করিয়া তাহাদের ধরিয়া আনিতেন। লোক-বোঝাই ফেরী নৌকা ডুবাইয়া দিয়া জলমগ্ন পুরুষ, স্ত্রী ও শিশুদের অবস্থা দেখিয়া সিরাজ আনন্দ অনুভব করিতেন। কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে বধ করিবার প্রয়োজন হইলে আলীবর্দী একাকী সিরাজের হাতে ইহার ভার দিয়া নিজে দূরে থাকিতেন, যাহাতে কোন আর্তনাদ তাঁহার কানে না যায়। সিরাজের ভয়ে সকলের অন্তরাত্মা কাঁপিত ও তাঁহার জঘন্য চরিত্রের জন্য সকলেই তাঁহাকে ঘৃণা করত।”
এছাড়া সিরাজের সমকালীন ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন‚ পলাশীর যুদ্ধ কাব্যে নবীনচন্দ্র বা স্যামুয়েল চার্লস তার Bengal in 1756-1757 তে সুস্পষ্ট বর্ণনা আছে কিভাবে সিরাজের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম। পলাশীর যুদ্ধ কাব্যের প্রথম সর্গে নবীনচন্দ্র স্পষ্ট লিখেছেন –“যবনের অত্যাচার করি দরশন,
বিমল হৃদয় পাছে হয় কলুষিত,
ভয়েতে নক্ষত্র-মালা লুকায়ে বদন,
নীরবে ভাবিছে মেঘে হয়ে আচ্ছাদিত”
এছাড়াও সেই আমলে লেখা ‘ইব্রাত-ই-আরবাব-ই- বসর’ গ্রন্থে সিরাজকে ‘লঘুচিত্ত, একগুঁয়ে, বদ-মেজাজি, অধীর ও মুখ খারাপ এবং কাউকে রেহাই দিয়ে কথা বলত না’ বলা হয়েছে।‘সিয়ার উল মুতাখখিরিন’-এ বলা হয়েছে : “সিরাজ কর্কশ ও অভদ্র কথাবার্তা এবং সরকারি কর্মচারিদের ঠাট্টা ও উপহাস করায় সকলের মনে ক্ষোভ ছিল।”
বলা হয় যে সিরাজের প্রথম সন্তান জন্মিয়েছিল তার বিয়ের (শাদীর) আগেই! সিরাজের চ্যালা মোহনলালের বোন মাধবীর সাথে সিরাজের অবৈধ সম্পর্ক হয়। এবং এর ফলে উৎপন্ন ছেলের দায়িত্ব নেওয়ার জন্যে অবিবাহিতা মাধবী সিরাজকে জোর করলে সিরাজ একটা ঘোড়ার পিঠে বাচ্চাটাকে বেঁধে ছেড়ে দেয়। তখন মোহনলাল গিয়ে সেই বাচ্চাকে উদ্ধার করে। আর আলীবর্দী খবর পেয়ে সিরাজের সাথে মাধবীর বিয়ে দেয়। অবশ্যই মাধবীকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার পর।
সিরাজউদ্দৌলা কি বাঙ্গালী ছিলেন ?
সিরাজউদ্দৌলা ছিল তুর্কি জাতির লোক। সিরাজের দাদু ছিলো আলীবর্দী খান।
আমরা জানি যে আলীবর্দী খানের কোন ছেলে ছিল না। তার ছিল তিন মেয়ে। তিন মেয়েকেই সে নিজের দাদা “হাজি আহমদ”-এর তিন ছেলের সাথে বিয়ে দেয়।
সিরাজের দাদু আলিবর্দী বা ঠাকুর্দা হাজি আহমেদের বাবা ছিলো মির্জা মুহম্মদ। মির্জা মহম্মদ ছিলো তুর্কি বংশোদ্ভূত! অর্থাৎ সিরাজ ছিলো আদতে তুর্কি‚ বাঙ্গালী নয় ।
আবার এই মির্জা মহম্মদের বউ মানে সিরাজের ঠাকুরমা ছিলো ইরানের খোরাসানের এক তুর্কি উপজাতির মেয়ে। তার ঠাকুরদা আবার ছিলো আওরঙ্গজেবের সৎ ভাই। যে আওরঙ্গজেবের বংশ একদিন ভারত দখল করেছিলো এখনকার উজবেকিস্তান থেকে এসে। মানে কোনো দিক থেকেই সিরাজের কোনো বাঙ্গালী কানেকশন পাওয়া যায়না।
এমনকি সিরাজের দাদু আলিবর্দী তো বাঙ্গালায় এসেছিলোই ১৭২০ সালে!যে পরিবারকে বাঙ্গালী বানিয়ে গ্রেটার বাংলার মিশনে নেমেছে নির্দিষ্ট কিছু পক্ষ।
আলিনগরের যুদ্ধ সিরাজ বাঙ্গালীদের উদ্ধারের জন্য লড়েছিলেন…. একটা ভ্রান্ত প্রচার
যেহেতু ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই তাই স্বাভাবিকভাবেই অনেকে এখানে বাঙ্গালী সেন্টিমেন্ট বসিয়ে ফেলে। কিন্তু আসল ঘটনা হলো যে ব্রিটিশদের পতনের পর সিরাজের সৈন্য কলকাতার বাঙ্গালীদের এলাকায় ঢুকে পড়ে ও প্রবল লুটপাট ও হত্যাকাণ্ড ঘটায়। ব্রিটিশদের বাঙ্গালী চাকরদেরকে উপর ব্যাপক অত্যাচারও করে। কলকাতার যাবতীয় অট্টালিকাও সিরাজের সৈন্যরা গুড়িয়ে দিয়েছিলো সিরাজের নির্দেশ মতো! রেহাই পায়নি হতভাগ্য চাকরদের বাসগৃহগুলোও।
(Source – মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্ররায়ের জীবনচরিত। পৃষ্ঠা – ৭৩-৭৪)
সর্বোপরি, পলাশীর যুদ্ধে বাঙ্গালা পরাধীন হয়নি। ইতিমধ্যেই বাংলা তখন পরাধীনই ছিল । সেদিন বাংলার প্রভু বদল হয়েছিল মাত্র। মধ্য এশীয় প্রভুদের হাত থেকে ব্রিটিশ প্রভুদের হাতে‚ এক আব্রাহামিক প্রভুদের হাত থেকে অন্য আব্রাহামিক প্রভুদের হাতে বাঙ্গালীর হস্তান্তর হয়েছিল মাত্র । তাই বাঙলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা, এই ধারনা ভুল । সঠিক তথ্য – শেষ নবাব তো দূরের কথা‚ সিরাজ কোনো নবাবই ছিলো না। ছিলো অবৈধ দখলদার! কারন,ভারতের শাসনক্ষমতা তখন ছিলো দিল্লীর হাতে। দিল্লীর মুঘল সম্রাটের আঞ্চলিক প্রতিনিধি ছিলেন বাংলার নবাব। অর্থাৎ নবাব স্বাধীন নয়। এখন স্বাধীন মুখ্যমন্ত্রী বললে শুনতে যেমন লাগবে ঠিক তেমনই ছিলো বিষয়টা। আবার নবাব হওয়ায় জন্যে দিল্লির যে অনুমতি লাগত তাও সিরাজের ছিলো না। আলীবর্দীর ছিলো। কিন্তু সিরাজের ছিলো না। অর্থাৎ সিরাজ একজন অবৈধ দখলদার ছিলো মাত্র। বৈধ অনুমতি তার ছিলো না। সে না ছিলো স্বাধীন আর না ছিলো বৈধ নবাবির কোন ছাড়পত্র ।আমরা সেই ১৫ মাসের আঞ্চলিক পরাধীন নবাবকে দেশের প্রথম বিপ্লবী বানিয়েছি। যে অত্যাচারী যুবকের মৃতদেহ দেখে কারোর করুণা হয়নি। সমাধি দেওয়ার লোকটুকুও পাওয়া কঠিন হয়েছিলো [মোজাফফরনামা]।।

