এইদিন ওয়েবডেস্ক,১৬ নভেম্বর : ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকাল থেকেই ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) তখন সাজো সাজো রব । একদিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে নিয়ে উচ্ছ্বাসে মেতে আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী অসংখ্য মানুষ । অন্যদিকে তখন ভারতীয় সেনার কাছে আত্মসমর্পণের জন্য চোরের মত অপেক্ষা করছে আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজীর নেতৃত্বে ৯৩,০০০ পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী । এদিকে তখন চুড়ান্ত চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরের প্রস্তুতি জোর কদমে শুরু হয়ে গেছে । চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরের জন্য ঢাকা ক্লাব থেকে রেসকোর্স ময়দানে নিয়ে আসা হয়েছে একটি বিশেষ টেবিল । দুপুরেই ময়দানে চলে আসেন ভারত ও বাংলাদেশের সেনার জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা । তিনি সেই টেবিলেন সামনে রাখা একটি চেয়ারে ভাবগম্ভীর মুখে বসে আছে । তাঁর ইশারাতে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে পাশের একটি চেয়ারে এসে বসেন পাকিস্তান সেনার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী । তারপর নিয়াজীর ইশারা পেতেই পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ৯৩,০০০ সেনা একে একে এসে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার পায়ের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করতে শুরু করে । বাংলাদেশের স্বাধীনতা কামী মানুষের আনন্দ উচ্ছ্বাসে মুখরিত হয়ে ওঠে ঢাকার আকাশ বাতাস ।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিলে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় বিকাল ৪.৩১ মিনিটে ঢাকার রমনা রেস কোর্স ময়দানে জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী স্বাক্ষর করে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন । আত্মসমর্পণের দলিলের নাম ছিল ‘ইনস্ট্রুমেন্ট অফ দ্য সারেন্ডার’ । আত্মসমর্পণের চুক্তিতে স্বাক্ষরের পরেই বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনার শাসনের আনুষ্ঠানিক পতন হয় । এটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সবচেয়ে বড় আত্মসমর্পণের ঘটনা।
কিন্তু ঢাকায় আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় সংঘটিত হলেও বাংলাদেশের বহু অঞ্চলে তখনো যুদ্ধ চালিয়ে যায় পাকিস্তান বাহিনী । ঢাকায় আত্মসমর্পণের আগে যেমন দেশের বহু জেলা ও অঞ্চল হানাদারমুক্ত হয়েছিল, ঠিক তেমনি ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরেও দেশের বহু এলাকা মুক্ত হয় ।
১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণে রাজি না হওয়ায় মেজর মঞ্জুরের নেতৃত্বে শুরু হয় আক্রমণ। যুদ্ধের একপর্যায়ে মেজর মঞ্জুর ডকইয়ার্ডের শ্রমিকের বেশে ২টি স্টেনগান নিয়ে হানাদারদের ট্যাংকের ভিতরে ঢুকে খুঁজে খুঁজে গানম্যানদের হত্যা করে স্তব্ধ করে দেন পাকিস্তানিদের ট্যাংক বহর।
সারারাত যুদ্ধের পর ১৭ ডিসেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি লঞ্চ শিপইয়ার্ডে এসে পৌঁছানো মাত্রই পাকিস্তানিদের অতর্কিত আক্রমণের শিকার হয়। তখন মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ চালালে একপর্যায়ে টিকতে না পেরে হানাদার বাহিনী শিরোমণি নসু খানের ইটভাটার কাছে যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। কিছুক্ষণের মধ্যে মুক্তিবাহিনী খুলনা সার্কিট হাউসও দখলে নিলে হানাদাররা এদিন দুপুরে সার্কিট হাউস মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে লিখিতভাবে আত্মসমর্পণ করে।
এছাড়া খুলনায় পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে ১৭ ডিসেম্বর । ওই দিনেও রাজশাহীও হানাদারমুক্ত হয় ।
এছাড়া বাংলাদেশের অনান্য এলাকাগুলির মধ্যে পাবনা হানাদারমুক্ত হয়েছিল ১৮ ডিসেম্বর, ঈশ্বরদী মুক্ত হয় ১৯ ডিসেম্বর,নওগাঁ হানাদারমুক্ত হয়েছিল ১৮ ডিসেম্বর, রাজবাড়ী হানাদারমুক্ত হয়েছিল ১৮ ডিসেম্বর , বাগেরহাট হানাদারমুক্ত হয় ১৭ ডিসেম্বর
,সৈয়দপুর হানাদারমুক্ত হয় ১৮ ডিসেম্বর,কিশোরগঞ্জ হানাদারমুক্ত হয় ১৭ ডিসেম্বর, ১৭ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয় রাঙ্গামাটি ,১৯ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয় ভৈরব,, ২১ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয় নাটোর এবং ২৩ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয় হোমনা । তবে আজকের এই দিনটিতেই ভারত ও বাংলাদেশে ‘বিজয় দিবস’ হিসাবে পালিত হয় । এই দিনে বাংলাদেশে সরকারীভাবে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে ।
অর্ধ শতাব্দীর বেশি আগে ভারতীয় সেনার বীরত্বকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানিয়ে বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী নিজের সোশ্যাল মিডিয়া পেজে লিখেছেন,’১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তান তাদের ৯৩ হাজার সামরিক বাহিনী নিয়ে ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এটাই ছিল সর্ববৃহৎ সামরিক আত্মসমর্পণ। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সাহস, বীরত্ব এবং আত্মত্যাগের বীরগাথা ভারতের সামরিক ইতিহাসের এক সোনালী অধ্যায়।
আজ ৫২তম বিজয় দিবসে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর জওয়ানদের আত্মবলিদানকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই। ৫২তম বিজয়দিবস -এর শুভেচ্ছা।’
পাশাপাশি রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার লিখেছেন,’১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সাহস, বীরত্ব এবং আত্মত্যাগের বীরগাথা ভারতের সামরিক ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। যুদ্ধে বিজয়ী সকল দেশ নায়ক এবং ভারতীয় বীর সেনানী যাঁরা নিজেদের আত্মবলিদান দিয়েছিলেন দেশের জন্য তাঁদেরকে শত কোটি প্রণাম। বিজয়দিবস -এর শুভেচ্ছা ।’।