আধুনিক ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং বিতর্কিত রাজনীতিবিদদের একজন হিসাবে বিবেচনা করা হয় লাতিন আমেরিকার দেশ ভেনেজুয়েলার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হুগো শ্যাভেজকে । তিনি ১৯৯৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারী থেকে ২০০২ সালের ১১ এপ্রিল এবং ২০০২ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে ২০১৩ সালের ৫ মার্চ ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রপতি ছিলেন । ২০১৩ সালের ৫ মার্চ ৫৮ বছর বয়সে মৃত্যু হয় হুগো শ্যাভেজের । তার শাসনকালে জনগনকে সব কিছু “ফ্রি” দিতে গিয়ে দেশকে ধ্বংস ও দেউলিয়া করে দিয়ে যান ।
১৯৫০ সালে, ভেনিজুয়েলা জনগণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড এবং নিউজিল্যান্ডের পরে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম মাথাপিছু আয় উপভোগ করেছিল – যা আজকের অর্থে জনপ্রতি ৮০,০০০ ডলার । ১৯৮০ সালে, ভেনেজুয়েলা বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতি ছিল। ২০০১ সালের শেষের দিকে, এটি ল্যাটিন আমেরিকার সবচেয়ে ধনী দেশ ছিল। মাত্র দশ বছর আগে, ভেনিজুয়েলায় বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা পেট্রোল পাওয়া যেত । প্রতি লিটার পেট্রোলের দাম ছিল মাত্র ৬৪ পয়সা । ভেনিজুয়েলায় ৫-৬ বছর আগে পর্যন্ত কোনো ধরনের কর ছিল না। সেখানে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ শিক্ষা ছিল বিনামূল্যে, সব ধরনের চিকিৎসা সহায়তা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে, বিদ্যুৎ বিনামূল্যে, জল বিনামূল্যে, স্থানীয় পরিবহন বিনামূল্যে ছিল।
সেখানে প্রত্যেককে চাকরি দেওয়া হয়েছে, আর চাকরি না থাকলে পর্যাপ্ত বেকার ভাতা এবং প্রত্যেক নাগরিককে একটি নির্দিষ্ট মাসিক ভাতার সরকারি “ললিপপ” দেওয়া হয়েছে। জনসাধারণ এই ললিপপ চুষতে থাকে, আর অন্যদিকে তখন দেশের অর্থনীতি একটু একটু করে ধরাশায়ী হতে থাকে । সরকার শুধু তেল বিক্রি করেই এসব খরচ মেটাত । মাত্র ৫-৬ বছর আগে, ভেনিজুয়েলায় বসবাস করা নাগরিকদের জন্য জীবন ছিল আমোদ ফুর্তি করার । সবকিছু ফ্রিতে পেয়ে তারা রাষ্ট্রপতি হুগো শ্যাভেজকে দেবতুল্য মনে করতে শুরু করেছিল । কিন্তু তিনি যে দেশের কি সর্বনাশ করে দিচ্ছেন তা কল্পনাও করেননি ভেনিজুয়েলার নাগরিকরা ।
আর আজ বর্তমান অবস্থা এতটাই খারাপ যে, যে দেশের মেয়েরা বিশ্বকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মিস ওয়ার্ল্ড উপহার দিয়েছে, যারা গতকাল পর্যন্ত নিজ দেশে পুলিশ অফিসার, অধ্যাপক, শিক্ষক, নার্স বা সংবাদপত্রের সাংবাদিক হিসেবে সম্মানজনক চাকরি করে এসেছেন, এখন তারা প্রতিবেশী দেশে মাত্র ১০ আমেরিকান ডলারের বিনিময়ে তাদের শরীর বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে । যাতে তারা মাসে ৫০০-৬০০ আমেরিকান ডলার পাঠাতে পারে যাতে দেশে রেখে যাওয়া তাদের বাবা-মা, ভাই-বোন বা স্বামী-সন্তানের দু’মুঠো অন্ন জোগানো যায় । অথচ দশ বছর আগে যে দেশবাসী স্বর্গীয় আনন্দে ছিল, হঠাৎ করে তাদের সামনে নেমে আসে মূর্তিমান নরক ।
কিভাবে এত তাড়াতাড়ি ভিখারি হয়ে গেল ভেনেজুয়েলা ? এর উত্তর খুব স্পষ্ট ।
ভেনেজুয়েলায় বামপন্থী সরকারগুলি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় ছিল । দুর্নীতি ছিল চরম পর্যায়ে । বিপুল ব্যয় এবং ভর্তুকির বোঝা টানতে হত সরকারকে । তেল উৎপাদন ছাড়া অন্য কোনও উৎপাদনের কোনও প্রচেষ্টা করা হয়নি। দুর্নীতি ও ভর্তুকির কারণে ভেনেজুয়েলার কোষাগার প্রায় শূন্য হয়ে পড়েছিল। আর সেই কারণেই হঠাৎ করে ২০১৪ সালে ভেনেজুয়েলার সবকিছু দিনে দ্বিগুণ এবং রাত চারগুণ হয়ে যায়। আজ এত মূল্যস্ফীতি যে এক মাসের বেতন দিয়ে এক প্যাকেট পাস্তা কেনা ছাড়া আর কিছু করা যায় না। জাতিসংঘের মতে, ২০১৯ সালে মূল্যস্ফীতি ১ লাখ শতাংশ বেড়েছে ভেনেজুয়েলায় । অর্থাৎ ১ টাকা মূল্যের জিনিসের দাম আজ এক বছর পর ১ লাখ টাকা টাকা হয়েছে ।
ভেনেজুয়েলার মুদ্রা হল বলিভার এবং এর বৃহত্তম নোট হল এক লাখ বলিভার। কিন্তু বাজারে এর দাম কিছুই নেই। এখন ভেনেজুয়েলায় ১০ লাখ বলিভার দিয়েও কিছুই কেনা যাবে না। আর্থিক সংকটের কারণে সরকার ক্রমাগত নোট ছাপাচ্ছে যার কারণে ক্রমাগত কমছে স্থানীয় মুদ্রা বলিভারের দাম। অবস্থা এমন যে এক মার্কিন ডলার এখন ৩৫ লাখ বলিভারের সমান হয়ে গেছে । যতদিন ভেনিজুয়েলা তেল বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করছিল এবং শ্যাভেজ জনগণের উপর অর্থের বর্ষণ করছিলেন, ততদিন সবকিছু ঠিক ছিল। যদিও অর্থনীতিবিদরা তখনও শ্যাভেজের সমাজতান্ত্রিক (ফ্রিবিজ) নীতিকে হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করছিলেন, সবকিছু ফ্রি দেওয়ার কুফল নিয়ে সতর্ক করেছিলেন । কিন্তু শ্যাভেজ তাদের সেকথায় কোনো কানই দেয়নি ।
আজ, ভেনেজুয়েলার মুদ্রা বলিভারের অবস্থা এমন যে এক কেজি মাংসের জন্য মানুষকে দেড় কোটি মিলিয়ন বলিভার পর্যন্ত পরিশোধ করছে। তারা এক কাপ কফির জন্য ২৫ লাখ বলিভার পর্যন্ত অর্থ প্রদান করছে। চুল বিক্রি করে টাকা জোগাড় করছেন নারীরা । জিনিসের দাম প্রতি ৩৫ দিনে দ্বিগুণ হচ্ছে। আজ এখানে সেদেশের ৫ জনের মধ্যে ৪ জন দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে । লোকেরা তাদের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স নিশ্চিত করার পরেই হোটেল, রেস্তোরাঁয় খাবার জন্য যেতে পারে । যাদের খাবারের টাকা নেই, তারা লুটপাট করছে।
ভেনেজুয়েলায় ২০১৪ সাল থেকে পেট্রোলের দাম ৮,০০০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। মানুষ রেশন পেতে ৬০-৭০ ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। সৈন্যরা গুদামের বাইরে অবস্থান করছে খাদ্য সংগ্রহের জন্য । চুল কাটার বিনিময়ে ডিম-কলা নিচ্ছে নাপিত । বর্তমানে খাদ্য ও ওষুধের আকাল দেখা দিয়েছে ভেনেজুয়েলায় । ভেনিজুয়েলাবাসীরা বিদ্যুৎ, জল ও যানবাহনের সমস্যায় ভুগছে, আগে তারা এই সব বিনামূল্যে পেয়েছিলেন । বেকারত্ব বৃদ্ধির কারণে অপরাধ দ্রুত বাড়ছে৷ জুতো সেলাই করতে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে । আজ ভেনিজুয়েলায় ন্যূনতম মজুরি প্রতি মাসে ১ মার্কিন ডলার-এর কাছাকাছি ।
ভারতীয় রাজনীতিতেও জনগনকে ফ্রিতে দেওয়া এবং বিভিন্ন প্রকল্পের নামে অল্পবিস্তর ভর্তুকি পাইয়ে দেওয়ার ট্রেন্ড লক্ষ্য করা যায় । বিশেষ করে অরবিন্দ কেজরিওয়াল শাসিত দিল্লি রাজ্য । বিদ্যুৎ,পানীয় জল সহ বিভিন্ন ফ্রিতে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট টানার খেলায় মেতেছেন । রাজ্যের নিজস্ব ভান্ডার কার্যত তলানিতে । এর সুদুরপ্রসারি ফল যে কি হতে পারে তার প্রমান আজকের ভেনেজুয়েলা । সেই কারনে অনেকে হুগো শ্যাভেজকে ভেনিজুয়েলার কেজরিওয়াল বলে সম্বোধন করেন ।।