প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,৪ ডিসেম্বর : ইনসান স্যার কি স্কুলে আসেন?এই প্রশ্ন শুনেই হেসে ফেলে পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের বাণী নিকেতন রঙ্কিনী মহল্লা বিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। তাঁদের কাছ থেকে উত্তর এল,’না না উনি আর স্কুলে আসেন না।উনি নাকি অবৈধ উপায়ে স্কুল মাস্টারের চাকরি বাগিয়ে আমাদের স্কুলে মাস্টারি করছিলেন।তা ধরা পড়ে যাওয়ায় উনার মাস্টারির চাকরি চলে গিয়েছে। এখন আমরা জানতে পেরেছি ,প্রায় দু’বছর ওই ভুয়ো শিক্ষকই আমাদের ক্লাস নিয়ে ছিলেন ।’ শনিবার পড়ুয়াদের এই উত্তরই যেন স্পষ্ট করে দিল শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ড এই রাজ্যের গ্রাম গঞ্জের পড়ুয়া মহলেও কতটা প্রভাব ফেলেছে।
স্কুল শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি নিয়ে এখনও উত্তাল হয়ে রয়েছে গোটা বাংলা।নিয়ম ভেঙে অনেকের অবৈধ উপায়ে চাকরি পাওয়া নিয়ে এখনও পথে বসে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন বহু যোগ্য এসএসসি চাকরি প্রার্থী।এই আন্দোলন ২০১৯ সাল থেকে দানা বাঁধে।তখন চাকরি প্রার্থী হয়ে পূর্ব বর্ধমানের মেমারি পৌরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের পিরিতপাড়া নিবাসী যুবক শেখ ইনসান আলি সেই আন্দোলনে যোগ দেন। ধীরে ধীরে তিনি ওই আন্দোলনের অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন।তারই মধ্যে সবাইকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎই ২০২০ সালে স্কুল শিক্ষকের চাকরি পেয়ে যান তৃণমূল কংগ্রেস ঘনিষ্ট ইনসান আলি।ওই বছরের ১ ডিসেম্বর মাসে ইনসান পূর্ব বর্ধমান জেলারই জামালপুর থানার চকদিঘী পঞ্চায়েত এলাকার বাণী নিকেতন রঙ্কিনী মহল্লা বিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক হিসাবে কাজে যোগ দেন। তার পর থেকে দুশ্চিন্তা মুক্ত ভাবেই ইনসান বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছিলেন।
কিন্তু শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে ২০২২ সালের প্রথম দিক থেকে ফের আন্দোলন জোরদার হতেই ইনসানের স্কুল শিক্ষকের চাকরি জীবনে অশনি সংকেত দেখা দেয়।দুর্নীতি কাণ্ড নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টেও রুজু হয় মামলা।আদালতের নির্দেশে সিবিআই তদন্তে নেমেই দুর্নীতির একের পর এক পর্দা ফাঁস করা শুরু করে।এই পরিস্থিতিতে বিপদ অাঁচ করে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে স্কুল কর্তৃপক্ষকে কিছু না জানিয়েই ইনসান আলি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন। আর গত বৃহস্পতিবার স্কুল সার্ভিস কমিশন নবম- দশমে ভুয়ো সুপারিশপত্র পাওয়া ১৮৩ জন অবৈধ শিক্ষকের নামের তালিকা আদালতে জমা দেয়। সেই তালিকায় শেখ ইনসান আলির নামও রয়েছে। আর তার পর থেকেই ইনসান আলি কার্যতই যেন আত্মগোপন করেছেন। তাঁর ফোনও সুইচ অফ থাকছে । বাড়িতে গিয়েও ইনসান আলির দেখা মেলে নি । তাঁর পরিবারের লোকজনও গোটা বিষয়টি নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন।
এদিকে শিক্ষক ইনসান আলির এই কীর্তি ফাঁস হওয়ায় বাণী নিকেতন রঙ্কিনী মহল্লা বিদ্যালয়ের পড়ুয়া ,অভিভাবক ,শিক্ষক সবাইকেই অবাক করে দিয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের শিক্ষক সেলের কেউ ইনসান আলির বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে নারাজ । তবে বামপন্থি শিক্ষক সংগঠনের নেতৃত্বের বক্তব্য,’ এমনটা হওয়ারই ছিল। আরো আনেকের এমন পরিণতি হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র ।’
বিদ্যালয়ে টিচার ইনচার্জ সুব্রত দাস শনিবার জানান, ইনসান আলি ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর আমাদের বিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক হিসাবে কাজে যোগ দেন। তার পর থেকে আর পাঁচজন শিক্ষকের মতই উনি চাকরি করছিলেন। ’তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ইনসান আলি স্কুলে আসেন।তার পর হঠাৎ করেই তিনি স্কুলে আসা বন্ধ করে দেন’। মার্চ মাসে জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (ডিআই ) সাহেবের অর্ডার আসে। তার পর থেকেই ইনসান আলির ’নো স্যালারি বিল’ আমরা প্রস্তুত করি।মার্চ মাস থেকেই ইনসান বাবুর বেতন বন্ধ হয়ে যায় ।মার্চ থেকে এখনও পর্যন্ত ইনসান বাবুর ক্ষেত্রে ’নো স্যালারি বিল’ তৈরি করা হয় । ডিআই সাহেব কেন ইনসান আলির বেতন বন্ধ করার নির্দেশ দেন? এই প্রশ্নের উত্তরে টিচার ইন চার্জ সুব্রত দাস বলেন, “ডিআই সাহেবের কাছে হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশ নামা পৌছায় ।সেই নির্দেশ কে মান্যতা দিয়েই ডিআই সাহেব ইনসান আলির বেতন বন্ধ করার নির্দেশ আমাদের দেন”। টিচার ইনচার্জ এও বলেন,বৃহস্পতিবার ডিআই সাহেব ইনসান আলির সম্পর্কিত সমস্ত নথি চেয়ে পাঠিয়েছেন। আমার খুব শিঘ্রই সেই নথি ডিআই সাহেবের কাছে জমা দিয়ে দেব । নিয়ম বহির্ভূত ভাবে কেউ শিক্ষকের চাকরি পেয়ে স্কুলে শিক্ষকতা করবেন ,এই বিষয়টি সমর্থন যোগ্য নয় বলেও সুব্রত দাস জানিয়েছেন। ডিআই (এস ই )শ্রীধর প্রামাণিক বলেন,“কমিশনের নির্দেশ মেনেই আমরা কাজ করছি । কমিশন যেমন নির্দেশ দেবে তেমনটাই আমরা পালন করবো ।’।