জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,৩০ মে : শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন যে কোনো প্রতিষ্ঠানে খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া অযাচিত রাজনৈতিক বা বহিরাগত হস্তক্ষেপ কখনোই কাম্য নয় । যুক্তিসংগত পরামর্শ সবসময়ই স্বাগত । বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করাই বাঞ্ছনীয় । কিন্তু বাস্তবিক এর উলটোটাই ঘটছে বাংলায় । ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট জমানা থেকে এযাবৎ শিক্ষাঙ্গনে বারবার রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ ঘটেছে । যার ফল শিক্ষার মান যে খুব একটা উন্নত হয়েছে তা বলা যাবে না । তাই শিক্ষাঙ্গনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার দাবি উঠছে । পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য বিতর্ককে কেন্দ্র করে ফের একবার এই দাবিই উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে ।
এতদিন পদাধিকার বলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য ছিলেন রাজ্যপাল। এই রাজ্যে দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর থেকেই রাজ্যপাল জগদীশ ধনকরের সঙ্গে রাজ্য সরকারের বিরোধ সর্বজনবিদিত । বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপাচার্য বা অন্যান্য পদাধিকারী নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজ্যপাল বনাম রাজ্যের বিরোধ বারবার খবরের শিরোনাম এসেছে । হয়তো সেই কারণেই সম্প্রতি রাজ্য মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাজ্যপালের পরিবর্তে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হবেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য। সিদ্ধান্ত সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে এই রাজ্যের ঐতিহ্য অনুযায়ী শুরু হয়ে গেছে বিরোধিতা। তৃণমূল বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ বেশ কিছু শিক্ষাবিদের বক্তব্য এর ফলে শিক্ষা ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বাড়বে এবং শিক্ষা আরও রসাতলে যাবে। কিভাবে বাড়বে তার কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা কিন্তু তারা দেননি। বরং ‘আরও’ শব্দ বন্ধনী এটাই ইঙ্গিত করে মুখ্যমন্ত্রী আচার্য হওয়ার অনেক আগে থেকেই এই রাজ্যের শিক্ষা গোল্লায় গিয়েছে ।
অনেকের বক্তব্য শিক্ষা সংক্রান্ত দায়িত্ব শিক্ষাবিদদের হাতে থাকা উচিত। খুব ভাল প্রস্তাব। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদরা যে রাজনৈতিক নিরপেক্ষ হবেন তার নিশ্চয়তা কোথায়? অথবা তারা কি তাদের নিয়োগ প্রভুদের ইচ্ছের বাইরে কোনো কাজ করতে পারবেন? বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্র সরকার নতুন শিক্ষানীতি প্রয়োগ করতে উদ্যোগী হয়েছে। যারা এই নীতির খসড়া তৈরি করেছেন তারা প্রত্যেকেই সুপরিচিত শিক্ষাবিদ। হতে পারে তারা একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সমর্থক। নতুন খসড়া নীতি নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্কের ঝড় উঠলেও দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদরা শুধুমাত্র নিয়োগ প্রভুদের আজ্ঞা পালন করেছে। এই রাজ্যের ক্ষেত্রেও বারবার একই জিনিস লক্ষ্য করা গ্যাছে। কোনো আলোচনা ছাড়াই হঠাৎ প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজি তুলে দেওয়া হলো। রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠল। পুনরায় ইংরেজি ফিরিয়ে আনার দাবিতে বাম সরকারের সড়িক দল এসইউসিআই পথে নামে। যেসব শিক্ষাবিদদের সুপারিশে প্রাথমিকে ইংরেজি তুলে দেওয়া হয় তারাও হয়তো নিজেদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে সরকারের হুকুম পালন করেছে মাত্র। ইংরেজি তুলে দেওয়ার স্বপক্ষে ক’টা কমিটি হয়েছিল সেটা প্রকাশ্যে না এলেও ফিরিয়ে আনার স্বপক্ষে একাধিক কমিটি হয়। তাদের সুপারিশের মধ্যে ছিল সরকারের ইচ্ছের প্রতিফলন। অর্থাৎ শিক্ষাবিদ হলেই যে শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনীতির অনুপ্রবেশ বন্ধ হবে সেটা আদপে ঠিক নয়। দরকার মানসিকতা বদলের।
এটা ঠিকই রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্য বা মানের যথেষ্ট ক্ষতি করে। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ঐতিহ্যবাহী প্রেসিডেন্সী কলেজ। একটা সময় প্রেসিডেন্সী কলেজ ছিল রাজ্যের সেরা ছাত্রদের বিচরণ ক্ষেত্র। বামফ্রন্টের আমলে কলেজটি তার ঐতিহ্য অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছিল ।
একটা সময় বিদ্যালয়গুলোর স্টাফ রুমে শিক্ষা সংক্রান্ত আলোচনা হতো। বাম আমলে ধীরে ধীরে সেখানে রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটে। বাম অনুগামী শিক্ষক সংগঠনের সদস্য হওয়ার জন্য শিক্ষকদের চাপ দেওয়া হয়। যারা হতনা তাদের সমস্যায় পড়তে হতো। বাম মনোভাবাপন্ন কোনো কোনো শিক্ষক ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জনপ্রতিনিধি হয়েছেন। মেয়াদ শেষে শিক্ষকতার কাজে ফিরেও গ্যাছেন। জনৈক কলেজ অধ্যক্ষ ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে গিয়ে আবার কলেজে ফিরে এসেছেন। পদাধিকার বলে জনপ্রতিনিধিরা ছিলেন কলেজের পরিচালনা সমিতির সদস্য। অর্থাৎ রাজনীতির অনুপ্রবেশের সব পটভূমিকা প্রস্তুত ছিল। তৃণমূল আমলে অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। বাম আমলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যেমন হেনস্থার শিকার হয়েছেন তেমনি তৃণমূল নেতা আরাবুল শিক্ষিকার দিকে মগ ছুড়েছে। কার্যত ডান-বাম সহ সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে রাজনীতি করে গেছে।
তবে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য পদ নিয়ে সাম্প্রতিক যে বিতর্ক শুরু হয়েছে তাতে কিছু শিক্ষাবিদ (এদের একটা অংশ বিশেষ রাজনৈতিক দলের অনুগামী) সহ বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে এদের সমস্যা আচার্য পদের পরিবর্তে মমতা ব্যানার্জ্জীকে নিয়ে । নাহলে প্রাক্তন বিজেপি নেতা তথা বর্তমান রাজ্যপালের আচার্য পদ নিয়ে প্রতিটি দল আপত্তি জানাত ।
দু’একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া কেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসাবে এই রাজ্যে যারা রাজ্যপাল হয়ে এসেছেন তারা কেউই শিক্ষা জগতের মানুষ নন, সংশ্লিষ্ট দলের সদস্য। অর্থাৎ রাজ্যপাল, ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বিদ্যালয় শিক্ষক, অধ্যাপক, অধ্যক্ষদের হাত ধরে শিক্ষায় রাজনীতির অনুপ্রবেশ অনেক আগেই ঘটেছে। মুখ্যমন্ত্রী আচার্য হলে নতুন করে কোনো ক্ষতি হবে বলে মনে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যেহেতু স্বশাসিত সেক্ষেত্রে দৈনন্দিন কাজে হস্তক্ষেপের সুযোগ কতটুকু থাকবে ?
শিক্ষাকে পুরোপুরি রাজনীতি মুক্ত করতে হলে শিক্ষামন্ত্রীর পদটাই অরাজনৈতিক করতে হবে। সেটাকে কি বাস্তবে সম্ভব? পুলিশ মন্ত্রীর পদের ক্ষেত্রে একই দাবি উঠতে পারে।
তার থেকে কিভাবে শিক্ষাকে রাজনীতির প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত রাখা যায় সেটা নিয়ে প্রকাশ্যে মতামত চাওয়া হোক। অবসরপ্রাপ্ত দলদাস অধ্যক্ষ বা অধ্যাপকদের পরিবর্তে প্রকৃত শিক্ষাবিদ তথা চিন্তাবিদদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হোক। নাহলে যে দলই ক্ষমতায় আসবে শিক্ষায় নিজেদের মতাদর্শের প্রতিফলন ঘটাবে। অন্যদিকে ‘দলদাস’ শিক্ষক সমাজ বড় বড় কথা বলবে । এদিকে রসাতলে যাবে শিক্ষার মান ।।