প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,৩০ জুন : পুরীর জগন্নাথদেবের রথ যাত্রার সঙ্গে আজও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে কুলীন গ্রামের নাম।চৈতন্যদেবের পদধূলি ধন্য কুলীনগ্রাম পূর্ব বর্ধমান জেলার একটি প্রাচীন জনপদ। এখানকার রথযাত্রা উৎসব ৫০০ বছরেও অধিক সময়ের প্রাচীন।চৈতন্যদেবের আদেশ মেনে পুরীর জগন্নাথের রথের জন্য এই কুলীনগ্রাম থেকেই পাঠানো হত রেশমের পট্টডোরী। রথের অনেক আগেই পট্টডোরী কুলীনগ্রাম থেকে পৌছে দেওয়া হত পুরীতে।সেই প্রথা এখন থমকে থাকলেও কুলীন গ্রামের রথ আর পুরীর রথ মাহাত্ম্য গুনে একই বলেই আজও বিশ্বাস করেন ভক্তরা ।
ভারতের বিখ্যাত পুরীর রথের সঙ্গে বহুকাল আগে থেকে ভক্তি ভাবের সম্পর্ক গড়ে ওঠে কুলীনগ্রামের রথের।কথিত আছে,কুলীন গ্রামের বসু পরিবারই কুলীনগ্রামে রথ যাত্রা উৎসবের সুচনা করেছিলেন।পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে কুলীন গ্রামে জন্মগ্রহন করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের অমূল্য গ্রন্থ ’শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্যের ’রচয়িতা মালাধর বসু।এই মালাধর বসুর পৌত্র লক্ষ্মীকান্ত বসু সত্যরাজ খান নামে ভূষিত হয়েছিলেন ।তিনি শ্রীচৈতন্য দেবের অন্যতম ভক্ত ও পার্শ্বদ ছিলেন।পুরীর জগন্নাথ দেবের রথের জন্য কুলীনগ্রাম থেকে পট্টডোরী পাঠানোর আদেশ সত্যরাজ খানকে করেছিলেন স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেব। ভক্ত সত্যরাজ খান সেই আদেশ মাথাপেতে পালন করেছিলেন।
কুলীনগ্রাম বাসীর কথায় জানা গিয়েছে,আগে প্রতি বছর রথের নির্দিষ্ট দিনের অনেকটা আগেই এখানকার বসুপরিবার থেকে পুরীতে পট্টডোরী পৌঁছে দেওয়া হত। সেই প্রথা মেনে বেশ কয়েকশো বছর যাবৎ রথের অনেক আগেই কুলীনগ্রাম থেকে পট্টডোরী পৌছে দেওয়া হত পুরীতে।মাঝে কয়েকটা বছর পট্টডোরী খামে ভরে ডাকযোগে পুরীতে পাঠানো হচ্ছিল। বছর পাঁচ-দশ হল সেই প্রথা বন্ধ হয়েছে।তবুও রথের দিন গোটা দেশের ভক্তদের ভিড়ে জমজমাট থাকে ইতিহাস প্রসিদ্ধ কুলীন গ্রামের রথযাত্রা উৎসব প্রাঙ্গন ।
বৈষ্ণবতীর্থ কুলীনগ্রামটি জামালপুর খানার আবুজহাটী ২ পঞ্চায়েত এলাকায় অবস্থিত।এই গ্রামের মধ্যস্থলে রয়েছে জগন্নাথ দেবের মন্দির।প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখানে নিমকাঠের তৈরি জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার এই বিগ্রহের পুজোপাঠ হয়ে আসছে। রথ যাত্রা উৎসবের আগে এই বিগ্রহ নতুন রঙে সাজানো হয়। যে সুসজ্জিত রথে এই তিন দেবতাকে এখন বসানো হয় সেটি সূচনা কালের রথ না হলেও রথটি বহুদিনের পুরানো। প্রায় ৩০ ফুট উচ্চ এবং প্রায় ১৬-১৭ ফুর দৈর্ঘ্যা বিশিষ্ট রথটি শাল, সেগুন ও নিম কাঠ দিয়ে তৈরি বলে সেবাইতরা জানিয়েছেন।
ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে জানা গিয়েছে,
আনুমানিক ৫০০ বছররেও বেশী সময় আগে মালাধর বসুর পৌত্র লক্ষ্মীকান্ত বসু কুলীনগ্রামে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।তিনি বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার বহুকাল পরে কুলীনগ্রামে শুরু হয়েছিল রথযাত্রা উৎসব পালন।এমনটা হওয়ার কারন কি ছিল তা অবশ্য কুলীন গ্রামের এখনকার রথযাত্রার উৎসব আয়োজকদের কেউই জানাতে পারেননি।
কোভিড অতিমারীর কারণে বিগত দু’বছর
দেশের কোথাও রথযাত্রা উৎসব জমজমাট হয়নি। অতিমারীর প্রভাব ফিকে হওয়ায় শুক্রবার সারা দেশজুড়ে প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হবে রথ যাত্রা উৎসব।সেই উপলক্ষে শ্রীচৈতন্যদেবের পদধূলী ধন্য কুলীনগ্রামও আগের মতো নতুন সাজে সেজে উঠেছে। ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা কুলীনগ্রামে জড়ো হতে শুরুকরে দিয়েছেন।এইবছর এখানে রথযাত্রা উৎসবের দিন হাজার হাজার ভক্ত সমবেত হবেন বলেই প্রত্যাশা করছেন আয়োজকরা। রথের দিন কুলীনগ্রাম জুড়ে যে বিশাল মেলা বসবে তার প্রস্তুতিও এখন শুরু হয়ে গিয়েছে।আয়োজকরা মনে করছেন ,এ বছর রথযাত্রা উৎসবের দিন কুলীনগ্রামে লাখো ভক্তের সমাগম ঘটবে ।
পুজারী শচীনন্দন মুখোপাধ্যায় জানান, রথের দিন সকাল থেকে সাবেকি রীতি রেওয়াজ মেনে কুলীনগ্রামের জগন্নাথ মন্দিরে হবে বিশেষ পুজোপাঠ। এখানকার পুজোয় অন্যন ফল যাই থাক কাঁঠাল চাই।এছাড়াও জগন্নাথদেবের জন্য খিচুড়ি ভোগ, বলরাম দেবের জন্য অন্নভোগ ও সুভদ্রাদেবীর জন্য পায়েস ভোগ রান্না করা হয়। এইসব কিছুই
দেবতাকে নিবেদন করে পুজোপাঠ শুরু হয় । পুজারী আরো জানান,পুজোপাঠ শেষে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহ মন্দির থেকে বাইরে বার করা হয়। প্রথম রথের চার পাশে বিগ্রহগুলি সাতবার ঘোরানো হয়।এর পর রথের সবথেকে উঁচু ধাপে বসানো হয় বিগ্রহ গুলিকে। রথে বিগ্রহগুলি বসানোর পর ফের একপ্রস্থ পুজোপাঠ হয়। তার পর রথে ওঠেন প্রধান পুজারি।রথ টানার জন্য দুটি দড়ি রথে বাঁধা হয়। রথের দিন বিকালে রথ টেনেনিয়ে যাওয়া হয় কুলীন গ্রামের রথ তলায়। এই গ্রামের রঘুনাথ জিউ এর মন্দির জগন্নাথ দেবেরমাসির বাড়ি বলে পরিচিত। প্রধান পুরোহিত এবং সহযোগী পুরোহীত গণ রথ থেকে তিন দেবতার বিগ্রহ নামিয়ে রঘুনাথ জিউয়ের মন্দিরে রেখে আসেন।উল্টোরথেরদিন ঠিক একই ভাবে তিন দেবতার বিগ্রহ ফের জগন্নাথ মন্দিরে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়।
শ্রীচৈতন্যদেবের স্মৃতিকে আঁকড়ে বৈষ্ণব তীর্থ কুলীন গ্রামে হওয়া রথযাত্রা উৎসবের খ্যাতি এখন দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে ।দেশবাসীর হৃদয়েও বৈষ্ণব তীর্থ কুলীনগ্রাম এক পবিত্র তীর্থভুমি হিসাবে স্থান করে নিয়েছে।সরকারি ভাবেও বাংলার অন্যতম পর্যটন স্থান হিসাবে কুলীন গ্রাম স্বীকৃতি পেয়েছে ।।