এইদিন ওয়েবডেস্ক,নয়াদিল্লি,০৮ এপ্রিল : তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সাগরিকা ঘোষের স্বামী সাংবাদিক রাজদীপ সারদেশাইয়ের মতে ভারতীয় মুসলমারা নাকি চরম দুরবস্থার মধ্যে আছে৷ আর সেই কথিত দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরতে তিনি নিজের নাম বদলে ‘রহিম খান’ রেখেছেন । সারদেশাইয়ের ইউটিউব চ্যানেলে ‘নতুন ভারতে একজন মুসলমান’ শীর্ষক শিরোনামে একটা প্রতিবেদনে তিনি বলেছেন,’শিরোনাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে, আজ আমি স্ট্রেট ব্যাটে মন্তব্য করছি, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে আমি একটি বিতর্কিত প্রশ্ন উত্থাপন করছি। ধরুন, যদি আমার নাম রাজদীপ সরদেশাই না হয়, তাহলে কী হতো? আমার সামনে আপাতদৃষ্টিতে যে মেরুকরণের ঘটনা ঘটছে, সে বিষয়ে আমি কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতাম। আজকের ভিডিও ব্লগের বন্ধুরা, আপনারা আমার নাম রহিম খান দেখতে পাচ্ছেন। দয়া করে মনোযোগ সহকারে শুনুন।’
এরপর ওই তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ সাংবাদিক বলেন,’প্রথমে তারা আমার মসজিদের বিরুদ্ধে এসেছিল। আমি কিছুই বলিনি। কারণ সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিলেন যে, মসজিদ ভেঙে ফেলা একটি অপরাধ। কিন্তু যে জমিতে মসজিদটি একসময় দাঁড়িয়ে ছিল, তা একটি বিশাল মন্দির নির্মাণের জন্য দেওয়া হবে। যেহেতু মন্দিরের বিষয়টি সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের বিশ্বাসের সাথে জড়িত ছিল। এটি ছিল আইনের ওপরে বিশ্বাসকে স্থান দেওয়ার একটি ক্লাসিক উদাহরণ। কিন্তু আমি কিছুই বলিনি। কারণ, এটি ছিল সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত। আমিও চাইনি যে আমার শহরে আর কোনো দাঙ্গা হোক।
আমার নাম রহিম খান। তারা তখন আমার কাছে এসে আমার বিয়ের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলে। বলে যে আমি যদি অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করি, তবে আমাকে প্রমাণ করতে হবে যে, এটি জোর করে করা হয়নি। তারা এটাকে লাভ জিহাদ বলে অভিহিত করে। কিন্তু আমি আবারও চুপ করে থাকি, কারণ আমি কাউকে অপমান করতে চাইনি।
আমার নাম রহিম খান। তারপর তারা আমার খাদ্যাভ্যাসের জন্য আমার কাছে আসে। বছরের পর বছর ধরে আমি যে মাংসের দোকানগুলো চালাচ্ছি, হঠাৎ করেই তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার বা বয়কটের ঝুঁকিতে পড়ে গেল। কিন্তু আমি কথা বলিনি, কারণ আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে, কতজন লোক আমার পছন্দের খাবারের অধিকারকে সমর্থন করবে! তারপর তারা আমার পোশাকের জন্য এসেছিল। আমার নাম রহিম খান এবং আমার মেয়ে স্কুলে হিজাব পরতে পারে না। তারা আমাকে সতর্ক করে দিয়েছিল, হিজাব লৈঙ্গিক নিপীড়নের প্রতীক। আবারও আমি ঠিক কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাব, তা নিশ্চিত করতে পারছিলাম না। তাই আমি বেশির ভাগ সময় চুপ করে থাকতাম।
আমার নাম রহিম খান। তারা আমার বক্তৃতা শুনতে এসেছিল। আমার বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক বক্তব্য (হেট স্পিচ) দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল। সহিংসতা উসকে দেওয়ার অভিযোগে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে বছরের পর বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছিল। জামিন নাকচ করা হয়েছিল। কিন্তু আবারও আমি চুপ করে রইলাম। কারণ, কেউ আমার কথা শুনবে না। যদিও আমি দাবি করতাম, যে আইন দিয়ে আমাকে ঘায়েল করা হয়েছে, তা আসলে খুব বেছে বেছেই করা হয়েছে।
আমার নাম রাহিম খান। আজ আমি আপনাদের বলতে চাই যে, আমাকে একবার সন্ত্রাসী বলা হয়েছিল। কারণ কেউ একজন হোয়াটসঅ্যাপে একটি ম্যাসেজে পড়েছিল যে, সব মুসলমান সন্ত্রাসী। আমি হতবাক হয়ে গেলাম। কিন্তু কোনো আদালত আমার কথা শুনল না। কারণ, বিচারের আগেই আমাকে দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছিল।
আমার নাম রহিম খান। তারা আমার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলতে এসেছিল। একে বলেছিল ভোট জিহাদ। আমি এই শব্দটি পছন্দ করিনি। কিন্তু সত্যি বলতে, আমি কোনো কথাও বলতে পারিনি। কারণ আমি যদি কথা বলি, তাহলে আমার বিরুদ্ধে ভোট ব্যাংক রাজনীতির অভিযোগ আনা হবে বলে ভয় ছিল।
আমার নাম রহিম খান। আমি দেখেছি, তারা ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যটিকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করছে। কিন্তু আমি আর একটি কথাও বলিনি। কারণ, আমি রাস্তায় প্রতিবাদ করার এবং জাতীয়তাবিরোধী বলে শনাক্ত হওয়ার ঝুঁকি নিতে চাইনি।
আমার নাম রহিম খান। আমার পদবি ও দাঁড়ির কারণে তারা আমাকে একটি দামি কলোনিতে বাসা ভাড়া দিতে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু আমি চুপ করে বসে থাকি। কারণ যদি আমি কথা বলি, তাহলে হয়তো আর কখনো কোনো বাসা ভাড়া পাব না। তারপর একদিন তারা আমার বাড়িতেও বুলডোজার নিয়ে আসে। বুলডোজার দিয়ে ঘর ভেঙে ফেলার হুমকি দেয়। বলে যে, এটি বুলডোজারের ন্যায়বিচার। আমি জানতাম, এটা অবিচার। কিন্তু আমি একটি শব্দও বলিনি। কারণ আমার নাম, যেমনটি তোমাকে বলেছিলাম–রহিম খান।
আমার নাম রহিম খান। তারা এসে আমাকে গরু পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত করে। অথচ আমি কেবল মাংসের ব্যবসার পুরোনো পারিবারিক পেশাটাই চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আবারও আমি একটি কথা বলিনি। কারণ, আমি জনতার হাতে গণপিটুনিতে মারা যেতে চাইনি।
আমার নাম রহিম খান। তারা আমার নামাজ পড়ার অধিকার নিয়ে কথা বলতে এসেছিল। আমাকে বলা হয়েছিল, আমি ছাদে, আমার নিজের ছাদেও নামাজ পড়তে পারি না। আমার হিন্দু ভাইবোনেরা, যাদের আমি খুব ভালোবাসি, তারা রাস্তায় ১০ দিনের গণেশ উৎসব করতে পারে; কিন্তু আমি আমার ছাদে বা মসজিদের কাছের রাস্তায় আধ ঘণ্টা প্রার্থনা করার কথা বলতে সাহস পাইনি। আমি চুপ করে রইলাম। কারণ, প্রতিবাদ করার শক্তি আমার ছিল না।
ও-হ হ্যাঁ, আমি তোমাকে বলতে ভুলে গেছি, আমার নাম রহিম খান। করোনার সময় করোনা জিহাদের কথা বলে তারা আমাকে টার্গেট করেছিল। তখন দেশের রাজধানীতে একটি ছোট সভা হয়েছিল। তারা এটিকে করোনা জিহাদ বলেছিল। সেই আমার গায়ে ‘করোনা ভাইরাসের বাহক’ বলে ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমার মতো আমার বন্ধুদেরও। ওরা সবজি বিক্রি করছিল, তাদের বয়কট করা হলো। কারণ, তারাও আমার মতো ভারতীয় মুসলমান ছিল।
কিন্তু আবারও আমি চুপ করে রইলাম। কারণ আমি এই ভেবে খুব ভয় পেয়েছিলাম যে, আমার নাম রহিম খান। তারপর তারা প্রতি রাতে, রাতের পর রাতে টেলিভিশনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে (প্রাইম আওয়ার) আমাকে টার্গেট করে। আমি সংবাদ উপস্থাপকদের দ্বারা পরিচালিত উচ্চস্বরে চলা বিভেদ সৃষ্টিকারী হিন্দু-মুসলিম বিতর্ক শুনতে পেলাম। কিন্তু আমি আর একটি কথাও বলিনি। কারণ আমাকে বলা হয়েছিল যে, বিতর্কে যত বেশি গোলমাল হবে তাদের টিআরপি তত বেশি হবে। একটি নির্দিষ্ট টিভি বিতর্কে তারা বলেছিল, সপ্তদশ শতাব্দীতে আওরঙ্গজেবের নিষ্ঠুরতা ও অপকর্মের জন্য আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। আমি কোনো উত্তর দিইনি। কারণ আমি বারবার বলছি যে, আমার নাম রহিম খান।
এই সপ্তাহে তারা আমার পারিবারিক সম্পত্তির জন্যও এসেছে। তারা বলে যে আমার পরিবার, আসলে আমার দাদূর আমলে দাতব্য প্রতিষ্ঠান, যা আদপে এখন একটি কবরস্থানে পরিণত হয়েছে, দান করা সেই সম্পত্তি কঠোর সরকারি তদন্তের আওতায় আসতে পারে। তারা এমনকি আমাকে ভূমিদস্যু বলা শুরু করেছে। তার চেয়ে আরও খারাপ শব্দ ব্যবহার করছে। কিন্তু আবারও আমি চুপ থাকব। কারণ আমি শেষ পর্যন্ত যা করতে চাই, তা হলো–একটি শক্তিশালী সরকার, তার আমলাতন্ত্র ও মন্ত্রীদের সাথে লড়াই করতে। আপনি জানেন, আমি এই ভিডিও ব্লগের মাধ্যমে যাদের কথা বলছি, তারা আসলে কারা। কিন্তু আমার এ লড়াইয়ে আমি একা। কারণ সত্যি কথা হলো, অন্য কেউ আমার জন্য তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে না। আমি এটাও স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, আমি আর কারও শিকার হতে চাই না।
কিন্তু আমি তাদের পক্ষে কথা বলতে চাই, যারা প্রতিদিন তাদের ধর্মীয় পরিচয় সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন হচ্ছে, যাদের প্রতি এমন বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে, যা সংবিধানের পরিপন্থী। আমি একজন গর্বিত ভারতীয় মুসলমান, একজন ভারতীয়–যাকে দুর্ভাগ্যবশত প্রতিদিন দেশপ্রেমের প্রমাণ দিতে বলা হচ্ছে। আমি এখন পর্যন্ত চুপ থাকাটাই বেছে নিয়েছি। কারণ আমার মনে হয়, আমার আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু আজ আমি জিজ্ঞাসা করছি, তোমাদের কী হবে, বন্ধুরা? কারণ দয়া করে ভুলে যেও না, আজ আমি লক্ষ্যবস্তু হচ্ছি, কাল তোমরাও হতে পার। আমার বন্ধুরা, চুপ থাকা কেবল ধর্মান্ধতার মাধ্যমে ঘৃণার রাজনীতিকে স্বাভাবিক করে তুলবে। তারপরে তাকে সম্প্রদায়ভিত্তিক স্থায়ী মেরুকরণের দিকে পরিচালিত করবে। যা আদপে ভারত নামের এই বিস্ময়কর বহুধর্ম বিশ্বাসের দেশে তোমরা আসলেই চাও। ও ছিল রহিম খান, আমি রাজদীপ সারদেশাই–তাই মনে হয়, আমি হয়তো নিশানার মধ্যে নেই।’।