এইদিন ওয়েবডেস্ক,কলকাতা,১৬ জুলাই : বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোকে নাকি বাংলাভাষীদের উপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে – এমনই অভিযোগ তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জি এবং তার দলের । এনিয়ে শুধু তৃণমূল কংগ্রেস নয় তাদের “বি-টিম’ বলে পরিচিত ‘বাংলা পক্ষ’ নামে একটা ভুঁইফোড় গোষ্ঠীও সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমতো তোলপাড় সৃষ্টি করছে । এমতবস্থায় মমতা ব্যানার্জির এই তথাকথিত ” বাঙালি নির্যাতনের” অভিযোগ নিয়ে সমালোচনায় সরব হলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী । তিনি মমতা ব্যানার্জির ‘বাঙালি অস্মিতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন । পাশাপাশি মমতা ব্যানার্জিকে “অনুপ্রবেশকারীদের রক্ষাকবচ” বলে অভিহিত করেছেন ।
প্রসঙ্গত,সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ব্যাপক ধরপাকড় অভিযান শুরু হয়েছে দেশজুড়ে । পাশাপাশি বিহারে চলছে ভোটার কার্ড সংশোধনের কাজ । সেখানে বহু অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গার নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ চলে যাচ্ছে । বিহারের পর পশ্চিমবঙ্গেও ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ শুরু হবে । এদিকে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস অভিযোগ করছে যে শুধুমাত্র বাংলা ভাষী হওয়ার জন্য বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে নাকি বাঙ্গালীদের উপর অত্যাচার করা হচ্ছে । আর সেই কথিত অত্যাচার প্রত্যক্ষ করতে জাতীয় রাজধানী দিল্লির জয়হিন্দ বাঙালি বস্তিতে মানুষের অভাব অভিযোগের কথা শুনতে গিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসের একটা প্রতিনিধিদল । ওই দলে ছিলেন তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সাগরিকা ঘোষ ও সাকেত গোখলে ছাড়া দোলা সেন প্রমুখ নেতানেত্রীরা । কিন্তু তৃণমূলের নেতা নেত্রীরা যাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন তাদের ধর্মপরিচয় ও নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে মমতা ব্যানার্জি ও তার দলকে তুলোধুনো করছে বিজেপি । কারণ সাগরিকা ঘোষের এক্স হ্যান্ডেলে কথিত অত্যাচারিত যে সমস্ত মহিলাদের দেখা যাচ্ছে তারা মূলত মুসলিম সম্প্রদায়ের এবং চিহ্নিত অনুপ্রবেশকারী বলে দাবি বিজেপির ।
শুভেন্দু অধিকারী দিল্লিতে কথিত অত্যাচারিত বাঙালিদের সঙ্গে তৃণমূলের নেতানেত্রীদের ছবি নিজের এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করে লিখেছেন,’বাঙালি অস্মিতা’র রাজনৈতিক ভাষ্য তৈরি করতে উদ্যত তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু কাদের স্বার্থে? বাংলা ভাষী রোহিঙ্গাদের স্বার্থে? নাকি বেআইনি অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশী মুসলিমদের স্বার্থে? সারা ভারতে যখন বেআইনি অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করে দেশ থেকে বিতাড়িত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তখন এই সব অনুপ্রবেশকারীদের রক্ষাকবচ হয়ে ওঠার চেষ্টায় তৃণমূল নেত্রী !
এই ছবি দেখে কি মনে হচ্ছে যে, যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য জড়ো করা হয়েছে, এরা বাঙালি? ভাষা বাদ দিলে, এদের পরিধান, এদের সংস্কৃতি, এদের জীবনযাপনের ধারা দেখে বোঝার উপায় আছে যে এরা পশ্চিমবঙ্গ থেকে কাজের অভাবে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় এসে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছে, নাকি আপনার অসহযোগিতার কারণে ও জমি না দেওয়ায়, ভারত সরকার সীমান্তে ৫৪০ কিলোমিটার কাঁটাতারের বেড়া না দিতে পারায়, এরা বেআইনি ভাবে অনুপ্রবেশ করার সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ভারতবর্ষে ঘাঁটি গেড়েছে ?
আর বাঙালি অস্মিতা’র যখন এতই চিন্তা মাননীয়া, তাহলে যে হাজার হাজার খাঁটি বাঙালি আজ আপনার দুর্নীতির জন্যে শিক্ষকতার চাকরি হারিয়ে রাজপথে বাংলা ভাষায় আর্তনাদ করছে, তাদের কথা আপনার কানে পৌঁছচ্ছে না কেন? অথচ ভিন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের আর্তি আপনি ঠিক শুনতে পাচ্ছেন ! আপনার সরকার ও প্রশাসন যখন যোগ্য এবং দক্ষ বাঙালি অফিসারদের থাকা সত্বেও, তাদের উপেক্ষা করে, ‘বাইরের’ লোকদের খোঁজে, যারা শুধুমাত্র আপনাদের কথায় উঠবে বসবে, তখন কোথায় যায় বাঙালি অস্মিতা?
কেন শ্রী অত্রি ভট্টাচার্য এবং শ্রী সুব্রত গুপ্ত উপেক্ষিত হলেন এবং শ্রী মনোজ পন্ত কে মুখ্য সচিব করা হল?
তিনি আবার এই দুই যোগ্য বাঙালি অফিসারের তুলনায় জুনিয়র ! কেন পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে সিনিয়র আইপিএস অফিসার শ্রী সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় কে উপেক্ষা করা হয়েছে এবং ভিন রাজ্য থেকে আসা তাঁর জুনিয়র শ্রী রাজীব কুমার কে ডিজিপি পদে বসানো হয়েছে? বাংলার জনগণ জানেন যে মাননীয়া আপনি ভোটের রাজনীতি ছাড়া কিছুই গুরুত্ব দেন না, তাই আপনার বাঙালি অস্মিতা’র রাজনীতি যে স্রেফ আপনার পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি থেকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা, তা সবাই ভালো করে জানে।’
যদিও সাগরিকা ঘোষদের বৈঠকের ভিডিও অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেসের এক্স হ্যান্ডেলে শেয়ার করে লেখা হয়েছিল,’যখন মাতৃভাষায় কথা বলা অপরাধে পরিণত হয়, তখন আমাদের লড়াই অপরিহার্য হয়ে ওঠে। দিল্লির জয় হিন্দ কলোনিতে, বাংলাভাষী পরিবারগুলিকে কেবল তাদের পরিচয়ের কারণে অপমানিত করা হচ্ছে এবং ‘অবৈধ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এটি কোনও নিয়ম বা নথির বিষয় নয়। এটি তাদের নিজস্ব দেশে বাংলা বলার জন্য একটি সম্পূর্ণ সম্প্রদায়কে লক্ষ্যবস্তু করার বিষয়। জয় হিন্দ কলোনির প্রতিটি পরিবারের সাথে আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়েছি। আমরা আমাদের আওয়াজ আরও জোরে তুলব, আরও কঠোর প্রতিবাদ করব এবং এই নিষ্ঠুরতা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আরও দীর্ঘ লড়াই করব। জয় বাংলা!’
সাগরিকা ঘোষও টুইট করেছেন,’তাদের জল ও বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রাস্তাঘাট নোংরা। বৃষ্টির রাতে তাদের অন্ধকার ঘরগুলোতে জল জমে যায় এবং জলকাদায় ভেসে আসা সাপ শিশুদের কামড়ায় । জয় হিন্দ বেঙ্গলি বস্তিতে, সকল বাসিন্দাই প্রমাণিত ভারতীয় নাগরিক কিন্তু তাদের একমাত্র “অপরাধ” হল তারা বাংলায় কথা বলে। বাঙালি বিরোধী বিজেপি ভারত জুড়ে বাংলা ভাষাভাষীদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে।’
একটা ইংরাজি সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিজেপি শাসিত দিল্লিতে বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর নির্যাতনের অভিযোগের প্রতিবাদে সোমবার বসন্ত কুঞ্জের কাছে জয় হিন্দ ক্যাম্পে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন তৃণমূলের চার সাংসদ। এই বস্তির বাসিন্দারা, যাদের বেশিরভাগই বাংলা থেকে আসা দরিদ্র অভিবাসী যারা দিনমজুর, গৃহকর্মী এবং কাপড় কুঁচি করার কাজ করেন, ৮ জুলাই আদালতের নির্দেশে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর থেকে তারা নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। তারা তাদের বাড়িঘর ভেঙে ফেলার ভয়েও দিন কাটাচ্ছেন।
আরও বলা হয়েছে,সাংসদ সুখেন্দু শেখর রায়, দোলা সেন, সাগরিকা ঘোষ এবং সাকেত গোখলের প্রতিনিধিদল জয় হিন্দ ক্যাম্পে অবিলম্বে বিদ্যুৎ পুনরুদ্ধারের দাবি জানিয়েছে। বিকেল ৩টা থেকে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ মঙ্গলবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত চলবে। সাংসদরা পালাক্রমে ঘটনাস্থলে বসেছিলেন। সন্ধ্যা নাগাদ, যখন সেন এবং ঘোষ প্রতিবাদে বসেছিলেন, তখন শত শত বাসিন্দা তাদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। রবিবার, তৃণমূল সাংসদের একটি প্রতিনিধিদল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্বেগের প্রেক্ষিতে প্রায় ৩,০০০ মানুষের বসবাসের বসতিটি পরিদর্শন করে তাদের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করার জন্য।
যদিও তৃণমূল নেতানেত্রীরা যাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিল তারা প্রত্যেকেই রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী মুসলিম বলে দাবি বিজেপির৷ বিষয়টি নিয়ে প্রথম সরব হন এরাজ্যের বিজেপির যুবনেতা তরুনজ্যোতি তিওয়ারি । তিনি ছবিসহ এক্স-এ পোস্ট করেছিলেন,’ভাবার সময় এখনই, না ভাবলে হয়তো ভবিষ্যতে আর ভাবার সুযোগ থাকবে না । বাংলাদেশের ইতিহাসের একটা অধ্যায় ছিল, যেখানে শত শত বছরের সহাবস্থান, প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক, পাড়ার বন্ধুত্ব—সবই একদিন ভেঙে গেল শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে। তখন অসংখ্য হিন্দু পরিবার বাংলাদেশ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিল। আজ তারা অনেকেই ভুলে গেছেন সেই কষ্টের ইতিহাস, সেই পরিচিত কথাটি—”আমাগো একখান দ্যাশ আছিল”।ভাষা এক ছিল, সংস্কৃতি এক ছিল, তবু আসতে হয়েছিল। যারা তাড়িয়ে দিয়েছিল তারাও বাংলায় কথা বলতো। আজ সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি ভুলে যেন অনেকেই ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশে বাস্তব ভুলে গেছেন। যখন ভারত সরকার অত্যাচারিত হিন্দুদের নাগরিকত্ব সুরক্ষিত করতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) নিয়ে আসে, তখন এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। অথচ একই সময়ে সীমান্ত পেরিয়ে আসা রোহিঙ্গা বা অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সুর বদলে যায় না। এখান থেকেই একটা প্রশ্ন জাগে—আসলে কার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন মুখ্যমন্ত্রী?
সম্প্রতি দিল্লির জয় হিন্দ বাঙালি বস্তিতে তৃণমূলের প্রতিনিধি দল গিয়ে বলছে, তারা নাকি অত্যাচারিত বাঙালিদের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কিছু ছবিতে দেখা যাচ্ছে, যাদের ‘বাঙালি’ বলা হচ্ছে, তাদের পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন উঠছে—তারা কি আদৌ সেই পরিচয়ের?পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে আজ কলোনি গড়ে উঠছে, হঠাৎ করে কিছু নতুন মুখ দেখা যাচ্ছে। কলকাতার গুলশান কলোনি, রাজারহাট, সোনারপুর বা শহরতলির নানা এলাকায় আজ জনবিন্যাস পাল্টে যাচ্ছে। লক্ষাধিক মানুষের বসবাস, অথচ ভোটার সংখ্যা হাজারের নিচে—এটা কি নিছক কাকতালীয়?
যারা দিনভর পরিচারিকার কাজ করছে, ছেলেরা ময়লা তোলার কাজ বা রিক্সা চালাচ্ছে—তাদের অনেককেই কয়েক বছর আগেও দেখা যেত না। আজ তাদের মধ্যে কিছু মুখ গোলাপি দাড়ি রেখে চেহারা পাল্টাচ্ছে। এদের আসল পরিচয় কি?
এই সময়ে তৃণমূল কিছু হলেই প্রশ্ন তোলে—বাংলাদেশি মুসলমান আর রোহিঙ্গারা বর্ডার পেরিয়ে আসছে কিভাবে? উত্তরটা খুব সহজ। কেন্দ্র চাইলে কাঁটাতার বসাতে পারে, কিন্তু রাজ্য সরকার সেই কাজের জন্য জমিই তো দিচ্ছে না। উপরন্তু যারা বর্ডার পেরিয়ে চলে আসছে, তাদের নথিপত্র তৈরি করে দিচ্ছে কারা? বহু ক্ষেত্রেই দেখা গেছে—তৃণমূল ঘনিষ্ঠ নেতা-কর্মীরাই এই কাজে যুক্ত। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ধরা পড়া রোহিঙ্গাদের পরিচয়পত্র যদি পশ্চিমবঙ্গ থেকে তৈরি হয়ে থাকে, তাহলে এটা কি কেবল কাকতালীয়? না কি কারা যেন পরিকল্পিতভাবে করছে?
এভাবে হঠাৎ করেই যদি জনসংখ্যার ভারসাম্য বদলে যায়, স্থানীয় হিন্দু সমাজ একদিন সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে নিজের রাজ্যেই। বাংলাদেশ থেকে যে মানুষগুলো হিন্দু পরিচয়ের কারণে বিতাড়িত হয়েছিলেন, তারা যদি আজ চোখ বন্ধ করে রাখেন, তাহলে ভবিষ্যত্ বেদনাদায়ক হতে বাধ্য। হরগোবিন্দ দাস, চন্দন দাসের মতো মানুষ শুধুমাত্র হিন্দু হওয়ায় প্রাণ হারিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদে। মহেশতলায় তুলসী মন্দির উপড়ে ফেলা হয়েছিল। এগুলো কি নিছক বিচ্ছিন্ন ঘটনা?
পশ্চিমবঙ্গের সরকার এখন আর সর্বজনীন নন। এই সরকার মাত্র ত্রিশ শতাংশের কথা ভাবে—হিন্দুদের কথা ভাবে না।তাই এখনই সময় সজাগ হওয়ার, প্রশ্ন করার, এবং ইতিহাসকে মনে রাখার।’

