প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৩ জুন : পদ্ম ফুল চাষে সুনাম রয়েছে বাংলার । তবে সেই পদ্ম বাংলার চাষিরা মূলত গ্রামাঞ্চলের জলাশয়েই করে থাকেন। সেখানেই পদ্ম ফোটে। কিন্তু বিজেপি নেতারা চেয়েছিলেন এবারের লোকসভা ভোটে বাংলার গ্রাম ও শহর সর্বত্র তাঁদের পদ্ম ফোটাতে।কিন্ত তা আর হয়নি । তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ’বিজেপির পদ্ম’ গ্রামের তুলনায় ভাল ফুটে গিয়েছে শহরে। আর গ্রামে রমরমিয়ে ফুটেছে তৃণমূলের ’ঘাস ফুল’। তার দৌলতে জয়ের হাসি তৃণমূল হাসলেও শহর বিদ্ধ হয়ে আছে পদ্ম কাঁটায়। যে কাঁটা ছাড়ানোই ২৬ শের বিধানসভা ভোটের আগে তৃণমূলের কাছে বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও এই কাঁটাকে ’পদ্ম কাঁটা’ বলে মানতে চাননি তৃণমূল নেতারা। তাঁদের বক্তব্য এই কাঁটা আসলে ’পূর্ব বঙ্গীয় কাঁটা’।
বঙ্গের ৪২ টি লোকসভা আসনেের মধ্যে বর্ধমান- দুর্গাপুর আসনটি এবার ছিল নজর কাড়া। এই আসনে এবার মূল লড়াইটা হয়োছে বিজেপির হেভি ওয়েট প্রার্থী দিলীপ ঘোষের সঙ্গে তৃণমূলের কীর্তি আজাদের। এই লোকসভার অধীনের রয়েছে বর্ধমান ও দুর্গাপুর পুরসভা । এই লোকসভার ১৮ লক্ষ ৫১ হাজার ৭৮০ জন ভোটারের মধ্যে ১৪ লক্ষ ৯৪ হাজার ৭৭৮ জন ভোট দিয়ে ছিলেন । অন্য দিকে বর্ধমান পূর্ব লোকসভায় পদ্ম শিবিরের প্রার্থী অসীম সরকারের বিরুদ্ধে ভোটে লড়েন ঘাস ফুল শিবিরের ডাক্তার প্রার্থী শর্মিলা সরকার। এই লোকসভা এলাকায় রয়েছে কাটোয়া ,দাঁইহাট, কালনা ও মেমারি পৌরসভা । বর্ধমান পূর্বের ১৮ লক্ষ ১ হাজার ৩৩৩ জন ভোটারের মধ্যে ১৪ লক্ষ ৯২ হাজার ৪৫৩ জন ভোটার ভোট দিয়ে ছিলেন।এই পাঁচটি পুরসভা ছাড়াও বোলপুর লোকসভা অধীন পূর্ব বর্ধমানের আউসগ্রামে রয়েছে গুসকরা পৌরসভা ।
ভোটের ফলে পূর্ব বর্ধমানের দুটি লোকসভা আসনে ঘাস ফুল শিবিরের প্রার্থীরা লক্ষাধীক ভোটে জয়ী হয়েছেন ঠিকই ।তবে ফলাফল খতিয়ে দেখা যাচ্ছে জেলার গ্রামীণ এলাকার ভোটাররা বহুলাংশেই ঘাস ফুল শিবিরের মান রক্ষা করেছেন । কিন্তু জেলার পুরবাসীর ভোটে পদ্ম কাঁটায় বিদ্ধ হয়েছে ঘাস ফুল শিবির । যা দেখে তৃণমূল শবিরও হতাশ। কার্যত তাদের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গিয়েছে।
ভোটের ফলাফল পর্যালোচনা করে তৃণমূলের নেতারা দেখেন,বর্ধমান পুরসভার ৩৫ টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৯ টিতে পদ্ম ফুটেছে । কালনা পুরসভার ১৮টি ওয়ার্ডের ১২ টিতে এবং কাটোয়া পুরসভার ২০টি ওয়ার্ডের ১৩ টিতে পদ্ম ফুটেছে। কালনার তৃণমূল বিধায়ক ছাড়াও পুরসভার চেয়ারম্যান,ভাইস চেয়ার ম্যান এবং দলের শহর সভাপতির ওয়ার্ডে ফুটেছে পদ্ম’। একই ভাবে পদ্ম ফুটেছে কাটোয়া পুরসভার চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানের ওয়ার্ডে । কাটোয়া পুরসভার ১৭ নম্বর ওয়ার্ডটি পূর্ব বর্ধমান জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি তথা বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের গড় হিসাবেই পরিচিত। সেই ওয়ার্ডেও ঘাস ফুলকে ধরাশায়ী করে ফুটেছে পদ্ম। এছাড়াও দাঁইহাট পুরসভার ১৪ টি ওয়ার্ডের ৯ টিতে এবং মেমারি পুরসভার ১৬ টি ওয়ার্ডের ৩ টিতে পদ্ম ফুটেছে। দাঁইহাট পুরসভাতেও তৃণমূলের বলিষ্ঠ পদাধিকারীদের ওয়ার্ডে পদ্মের রমরমা ঘটেছে। বাদ যায়নি মেমারি পুরসভা।’মেমারি শহর তৃণমূলের সভাপতি স্বপন ঘোষাল ও সহ- সভাপতি আশীষ ঘোষ দস্তিদাররা যে ২২৬ নম্বর বুথে ভোট দেন সেই বুথে পদ্মের জয়জয়কার ঘটেছে।এমনকি পুরসভার চেয়ারম্যান স্বপন বিষয়ী তাঁর খাস তালুক ১২ নম্বর ওয়ার্ডে ঘাস ফুলের জয়জয়কার ধরে রাখতে পারেন নি।২১ শের বিধানসভা ভোটের পর এবারের লোকসভা ভোটেও চেয়ারম্যানের ওয়ার্ডে পদ্ম কাঁটা জিয়েই রয়েছে । এইসব পুরসভা ছাড়াও তৃণমূলের গড় হিসাবে পরিচিত গুসকরা পুরসভার ১৬ টি ওয়ার্ডেরও ৭ টিতে পদ্ম ফুটেছে।দুর্গাপুর পুরসভার ফলা ফল আরও চমকে দেওয়ার মত ।এই পুরসভার ৪৩ টি ওয়ার্ডের ৩৩ টিতেই পদ্ম ফুটে গিয়েছে।এ নিয়ে রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহলের ধারনা,শহরবাসী হয়তো লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের চাইতেও বেশী অনুদানের অন্নপূর্ণা ভাণ্ডারের প্রত্যাশী ।
জেলা তৃণমূলের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য এ ব্যাপারে বিজেপি নেতাদের কোন কেরামতি দেখছেন না।এমন কি বিজেপির সংগঠন গ্রামীণ এলাকার চাইতে শহর এলাকায় অনেক বেশী শক্তিশালী হয়েছে,এমনটাও তিনি মনে করছেন না। রবীন্দ্রনাথ বাবু দাবি করেন,“পূর্ব বঙ্গ থেকে আসা মানুষজন গ্রামের চাইতে শহর এলাকায় বেশি সংখ্যায় বসবাস করেন। লোকসভা ভোটে তাদের কাছে ধর্মীয় বিষয়টিই বড় ’ইসু’ হয়ে যায়। এবারের লোকসভা ভোটেও সেটাই হয়েছে।লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের চাইতেও ধর্মীয় ’ইসু’ পূর্ব বঙ্গ থেকে আসা মানুষজনের কাছে বেশী গুরুত্ব পেয়ে গিয়েছে।তাই শুধু পূর্ব বর্ধমান জেলা নয়, রাজ্যের বহু পুরসভা এলাকায় ভোটের ফল এমনটা হয়েছে বলে রবীন্দ্রনাথ বাবু জানিয়েছেন।
তৃণমূলের জেলা সভাপতির এই দাবিকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন জেলা বিজেপির জেলা সভাপতি অভিজিৎ তা।।তিনি বলেন,পুরসভা এলাকায় তৃণমূলের সিন্ডিকেটরাজ, তোলাবাজি বহর অনেক বেশি। কেউ নতুন বাড়ি তৈরি করুক বা বাড়ি মেরামত,তৃণমূলের তোলাবাজ সিন্ডিকেট বাজদের দাবি পূরণ না করে কছুই করা যায় না । এছাড়াও চোখ রাঙানি,হুমকি শাসানিতো রয়েইছে। পুরসভা এলাকার বাসিন্দারা এসবেরই জবাব ইভিএমে দিয়েছেন বলে অভিজিৎ বাবু দাবি করেন । একই সঙ্গে তিনি বলেন,গ্রামের মানুষ নিরীহ, গরিব, তাঁরা অত রাজনীতিক সচেতনও নয়। তাই ওইসব নিরীহ মানুষকে ভয় দেখিয়ে ,ভুল বুঝিয়ে,লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ও ১০০ দিনে কাজ বন্ধকরে দেওয়ার হুমকি দিয়ে তৃণমূল তাদের ভোট কব্জা করে।শহর এলাকার শিক্ষিত ও রাজনৈতিক সচেতন মানুষকে তৃণমূল এভাবে কব্জা করতে পারে নি।তাই বর্ধমানের মত রাজ্যের বহু পুরসভা এলাকায় পদ্ম কাঁটায় বিদ্ধ হয়েছে তৃণমূল ।।