প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,০২ নভেম্বর : এসআইআর (SIR) নিয়ে তপ্ত হয়ে রয়েছে বঙ্গের রাজনৈতিক রণাঙ্গন।তারই মধ্যে তামিলনাড়ুতে কাজে যাওয়া ৫১ বছর বয়সী বাংলার পরিযায়ী শ্রমিক বিমল সাঁতরার অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য এসআইআর-কেই কাঠগড়ায় তুলছে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস । শনিবার সন্ধ্যায় তামিলনাড়ু থেকে পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর থানার নবগ্রাম উড়িষ্যা পাড়ার বাড়িতে বিমল সাঁতরার মৃতদেহ ফিরতেই এসআইআর নিয়ে শোরগোল ফেলে দেন তৃণমূলের নেতারা। তাদের সুরে সুর মিলিয়ে বিমল সাঁতরার ছেলে বাপি সাঁতরা দাবি করেন,’এসআইআর আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে পড়ে তাঁর বাবা তামিলনাড়ুর হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ছিলেন।সেখানেই তাঁর বাবার মৃত্যু হয়েছে।’ যদিও এই দাবিকে মিথ্য ও ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছেন সিপিএম ও বিজেপি নেতৃত্ব।
জমালপুর ব্লকের আঝাপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার অখ্যাত গ্রাম নবগ্রাম উড়িষ্যা পাড়া । এই গ্রামের বেশিরভাগ মানুই কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। দরিদ্র বিমল সাঁতরাও জীবিকা ছিল কৃষিকাজ। এলাকাবাসীর কথা অনুযায়ী, বেশী মজুরী মোলে বলে ধান রোয়ার কাজ করতে জামালপুর থেকে অনেকেই তামিলনাড়ু যান । সেই মত বিমল সাঁতরাও তামিলনাড়ু গিয়েছিলেন।
তামিলনাড়ু পুলিশের চালান খতিয়ে দেখেে জানা গিয়েছে,অসুস্থ অবস্থায় গত ২৬ অক্টোবর বিমল সাঁতরা তামিলনাড়ুর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার সেখানেই বিমলের মৃত্যু হয়। সেই খবর পেয়ে মৃতর ছেলে বাপি সাঁতরা তামিলনাড়ু পৌছান।বাবার মৃত্যু নিয়ে বাপি তামিলনাড়ুর তাঞ্জাভুর (Thanjavur) জেলার ওরাতানাডু (Orathanadu) থানায় অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের করেন।সেখানকার স্থানীয় হাসপাতালে শুক্রবার বিমল সাঁতরার মৃতদেহর ময়নাতদন্ত হয়। পূর্ব বর্ধমান জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় শনিবার সন্ধেয় বিমল সাঁতরার মরদেহ নবগ্রামের বাড়িতে ফেরে। সে সময় জামালপুরের বিধায়ক অলোক মাঝি সহ আরো একাধিক তৃণমূল নেতা সেখানে হাজির ছিলেন।
বিমল সাঁতরা মৃত্যুর কারণ কি তা তাঁর ছেলে বাপি সাঁতরার কাছে জানতে চাওয়া হলে প্রথমে সে একটু ইতস্তত বোধ করে।পরে তিনি দাবি, করেন,’তাঁর বাবা ধান রোয়ার কাজ করতে তামিলনাড়ুতে গিয়েছিলেন। তারই মধ্যে বাংলায় এসআইআর লাগু হয়ে যায়। পরিযায়ী শ্রমিক হওয়ার জন্যে নথি নিয়ে তাঁর চিন্তায় ছিলেন। ভোটার তালিকায় তিনি সহ পরিবারের সবার নাম থাকবে ,নাকি কাটা যাবে ,তা নিয়ে তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়ে ছিলেন।’ আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে পড়েই বিমল সাঁতরা মারা গিয়েছেন বলে তাঁর ছেলে বাপি সাঁতরা দাবি করেছেন ।
বিধায়ক অলক মাঝির কথাতেও একই দাবির কথা শোনা গিয়েছে। তিনি বলেন,’আড়াই বছর হতে চললো ১০০ দিনের কাজ বন্ধ।উপার্জনের তাগিদে তাই ধান রোয়াতে পটুরা ভিন রাজ্যে কাজে যাচ্ছেন। এসআইআর লাগু হওয়ার পর থেকেই বিমল সাঁতরা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। ভয়ে আতঙ্কে ছিলেন। নথিপত্র সব আছে কিনা তা নিয়ে বাড়িতেও বারে বারে ফোন করছিলেন। অতিরিক্ত চিন্তায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।শেষে প্রাণ খোয়ান । বিমল সাঁতরার মৃত্যুর খবর তৃণমূল কংগ্রেসের সেকেন্ড ইন কমাণ্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পৌছায়। তাঁর নির্দেশে রাতে রাজ্যের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ এবং পূর্ব বর্ধমান জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি তথা কাটোয়ার বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় মৃতর বাড়িতে পাৌছান । তাঁরা মৃতের পরিবারকে সমবেদনা জানান । পাশে থাকার আশ্বাস দেন। বিমল সাঁতরার মৃত্যুর জন্য নির্বচন কমিশনকে দায়ী করেন মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ ।
যদিও তৃণমূল বিধায়ক,মন্ত্রী ও মৃতের পরিবারের এই দাবি মানতে চাননি নবগ্রাম এলাকা নিবাসী জামালপুরের প্রাক্তন বাম বিধায়ক সমর হাজরা। তিনি বলেন,’এসআইআর নিয়ে বিমল সাঁতরা বা তার পরিবারের আতঙ্কিত হওয়ার মতো তো কিছুই নেই। বিমল সাঁতরা ও তাঁর পরিবারতো বংশ পরম্পরায় নবগ্রাম উড়িষ্যা পাড়ার বাসিন্দা। ২০০২ সালের ভোটার তালিকাতে বিমল সাঁতরার নাম নিশ্চই থাকবে। তাহলে কিসের আতঙ্ক ?’ এই প্রশ্ন তুলেছেন সমর হাজরা ।
একই ভাবে বিজেপি নেতৃত্বও এসআইআর আতঙ্কে বিমল সাঁতরার মৃত্যু হওয়ার দাবি উড়িয়ে দিয়েছে। জেলা বিজেপি নেতা মৃত্যুঞ্জয় চন্দ্র বলেন, ‘এসআইআর নিয়ে আতঙ্কিত একমাত্র তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা নেত্রীরা।তাই তারা যে কোন মৃত্যুকেই এখন এসআইআর আতঙ্কে মৃত্যু বলে দাবি করছে। মতর পরিবারকে দিয়েও তারা মিথ্যা কথা বলানো করাচ্ছে। তাই মৃতর ছেলে বাপি সাঁতরা তামিলনাড়ুর ওরাতানাডু (Orathanadu) থানায় যে অভিযোগ দায়ের করেছে তার সঙ্গে তাঁর এখনকার বক্তব্যের কোন মিল থাকছে না ।’ মৃত্যুঞ্জয় বাবু বলেন, ‘তামিলনাড়ুর ওরাতানাডু থানায় তামিল ভাষায় দায়ের হওয়া FIR এর ইংরাজি অনুবাদ তিনি করেছেন।তাতে দেখা যাচ্ছে বাপি সাঁতরা ওরাতানাড়ু থানায় অভিযোগ করেছেন,“গত ২৬ অক্টোবর সন্ধ্যা প্রায় ৬ টার সময় তাঁর বাবা বিমল সাঁতরা এবং অপর আর একজন তামিলনাড়ুর কর্মস্থল এলাকার জমিতে পড়ে থাকা বোতলের পানীয় মদ ভেবে খেয়ে নেন। বিষাক্ত সেই পানীয় খেয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে তামিলনাড়ুর ওরাতানাডু সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা।ডাক্তারের পরামর্শে উন্নত চিকিৎসার জন্য পরে তাকে থাঞ্জাভুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।৩০ অক্টোবর সকাল ১০ টা নাগাদ সেখানেই বিমল সাঁতরা মারা যান । অপরজন এখনো সেখানকার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।’ মৃতর পুত্রবধূ পূর্ণিমা সাঁতরা শনিবার রাতে বলেন,“তাঁর শ্বশুর মশাই বুঝতে পারেন নি, তিনি যেটা পান করছেন সেটা আসলে ছিল বিষ ।” এনিয়ে বাপি সাঁতরা বলেন ,তামিলনাড়ু পুলিশ তাঁকে যে কাগজে সই করতে বলে সেখানে তিনি সই করেছেন । তামিল ভাষায় অভিযোগপত্রে কি লেখা ছিল তার কিছুই তিনি নাকি জানেন না।।

