কেশিয়াড়ি থেকে প্রায় মাইল তিনেক ভিতরে কুড়ুমবেড়া দুর্গটি অবস্থিত । পশ্চিম মেদিনীপুরে যে এই রকম একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্য আছে সেটা মেদিনীপুরে থেকেও অনেকের কাছে অজানা। যেমন আমি জানতাম না। শোনার পরেই ইচ্ছে প্রকাশ করলাম ।
ব্যস কপাল দেবী প্রসন্ন হলেন । আমরাও বেরিয়ে পড়লাম গাড়ি নিয়ে । বেলদার রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলাম । কুকাই থেকে ভিতরে যেতে হয় । কখনও এই রাস্তা দিয়ে কোথাও যাই নি । এই প্রথম ।
যেতে যেতে গগনেশ্বর গ্রাম পড়ল । ওখানে আমার স্বামীর পিসির শ্বশুরবাড়ি । তারপর আরও কিছুটা গিয়ে দেখতে পেলাম পাথর দিয়ে তৈরি একটি জরাজীর্ণ দুর্গ । কোনো রকম সংস্কার হয় নি । ঢোকার মুখে বিশাল একটা সাইনবোর্ড । ভিতরে ঢুকে আগে চার দিকটা ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিলাম । কি বিশাল জায়গা জুড়ে অছে দুর্গটি । তরপর দেখতে পেলাম দূরে একজন ভিতরে গজিয়ে ওঠা ঘাসগুলো পরিস্কার করছে । তাকে গিয়ে আমি পাকড়াও করলাম । তারপর প্রশ্নের পর প্রশ্ন । এখানে আপনি কতদিন কাজ করছেন , কেমন মানুষ জন আসে দেখতে , আপনি লোক মুখে এই দুর্গ সম্বন্ধে কি কি শুনেছেন । লোকটি ভাবলো , কার পাল্লায় পড়েছি রে বাবা !
এত প্রশ্ন কেউ কোনো দিন করে নি । দূরে দেখলাম একদল ছাত্র ছাত্রী পিঠে ব্যাগ নিয়ে চারদিক ভালো করে দেখছে এবং নিজেদের মধ্যেই নানারকম আলোচনা করছে । দেখে বেশ ভালো লাগলো , একটা গ্রামে অবস্থিত জরাজীর্ণ দুর্গের প্রতি আগ্রহ দেখে । এই সব ছাত্র ছাত্রীদের কথা চিন্তা করে দুর্গটি আরও ভালোভাবে সংস্কার করা দরকার । তার সঙ্গে রাস্তা ঘাট অবশ্যই । তবেই একটা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে । দুর্গটি কে তৈরী করেছেন এই নিয়ে অনেক মতান্তর আছে ।
দুর্গটির চারপাশে যে প্রাচীর আছে সেটা অনেকটাই মাটিতে বসে গেছে । যার ফলে প্রাচীরের উচ্চতা কিছু টা কমে গেছে । তাও উচ্চতা এখন দশ ফুটের মত , আর চওড়া তিন ফুটের মত হবে । প্রাচীরের গায়ে , দুর্গের ভিতরে প্রাচীরের গায়ে পাথরের তৈরী ছোট ছোট খুপরি বা কুঠরি আছে । ভালোভাবে যদি দেখা যায় তাহলে দেখা যাবে পাথরগুলো একটার উপর আর একটা এমন ভাবে বসানো হয়েছে (কোথাও চুন-সুরকি , বা সিমেন্ট বালির ব্যবহার বাইরে থেকে বোঝা যায় না) থরে থরে সাজানো রয়েছে যেন । অংকের হিসেবে তৈরী । নীচের দিকটা চওড়া আর উপর দিকটা ক্রমশ সরু হয়ে মিশেছে । অথচ এত বছর প্রায় অবহেলায় থাকা সত্ত্বেও দুর্গটি ভেঙ্গে পড়ে নি । দু এক জায়গায় দেখলাম সিমেন্ট দেওয়া , দেখে মনে হল কোথাও কোনো ফাটল দেখা দিয়েছিল , রাজমিস্ত্রির কাঁচা হাতে তাকে আবার নতুন করে রূপ দেবার চেষ্টা করেছে । কিন্তু আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার মত ক্ষমতা মনে হয় তাদের নেই । মাঝখানে আছে বিশাল চত্বর । পূর্ব দিকে একটি মন্দির ছিল , দেখলেই বোঝা যায় । তার ভগ্নাবশেষ এখনও অছে । আর পশ্চিম দিকে মসজিদ ছিল ।
প্রাচীন ইতিহাসের বহু উত্থান পতনের ঘটনা জড়িয়ে আছে গগনেশ্বর গ্রামে অবহেলায় পড়ে থাকা এই কুড়ুমবেড়া দুর্গটিতে । মাকড়া পাথরের তৈরী এই কুড়ুমবেড়া দুর্গটির দেওয়ালে প্রাচীন ইতিহাসের গন্ধ পাওয়া যায় । ১৯৫৮ সালের আইন অনুযায়ী এই দুর্গটি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া অধিগ্রহণ করে । দুর্গটি কারা নির্মাণ করেছিলেন , এই নিয়ে অনেক মতান্তর আছে । মন্দিরের গায়ে যে পাথরের ফলকটি আছে , তার সব অক্ষর গুলো প্রায় নিশ্চিহ্ন । কেবলমাত্র দু একটি স্থানে কিছু শব্দ পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয় নি , সেখানে দুটি শব্দ পাওয়া গেছে ।
একটি হল “বুধবার” এবং অন্যটি হল “মহাদেবঙ্ক মন্দির” ( তথ্য সূত্র যোগেশচন্দ্র বসুর মেদিনীপুরের ইতিহাস ) ।
মসজিদে যে শিলালিপিটি আছে , সেখান থেকে জানা যায় , ঔরঙ্গজেবের রাজত্ব কালে এটি তৈরী হয় । তৈরী করেন মহম্মদ তাহির । ( তখন হিজরী সন ছিল ১১০২ এবং ১৬৯১ খ্রীঃ অঃ ) একই দুর্গের ভিতরে হিন্দু মন্দির এবং মুসলিমদের মসজিদ এক বিরল দৃশ্য । মসজিদটি যে পাথর দিয়ে তৈরী , সেই গুলো দেখলে মনে হয় , কোনো হিন্দু মন্দিরের উপকরণ নিয়েই তৈরী হয়েছিল এই মসজিদটি ।
১৪৩৮ থেকে ১৪৭০ সালের মধ্যে উড়িষ্যার রাজা কপিলেন্দ্র বা কপিলেশ্বর এই মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন । মন্দিরের গায়ে শিলালিপিটি থেকে যে শব্দ গুলো পাওয়া গেছে তা থেকে গবেষকরা মনে করেন ঊড়িষ্যার রাজা কপিলেশ্বর এই মন্দিরটি তৈরী করেছিলেন । পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ঊড়িষ্যার রাজা ছিলেন কপিলেশ্বর ।
ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়ের মতে, কপিলেশ্বর গনপতি বংশের রাজা ছিলেন । তার সাম্রাজ্য ছিল দক্ষিণে মারাঠা পর্যন্ত আর এইদিকে ছিল হুগলির মান্দারান পর্যন্ত ।
শোনা যায় কেশিয়াড়ি ও গগনেশ্বর ছিল তসর-সিল্ক উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র । ব্যবসা থাকবে জনপদ থাকবে না , তা তো হয় না । এই কারণে সেখানে একটা বিশাল জনপদ গড়ে উঠেছিল । কপিলেশ্বর দেব এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করা পর বহু কাল ধরে হিন্দুদের কাছে পুণ্য স্থান হিসেবে পরিচিত ছিল । প্রাচীরের গায়ে , ভিতরের দিকে যে ছোট ছোট খুপরি মত ছিল সেই গুলো সাধু সন্ত , ও অতিথি অভ্যাগতদের জন্য নির্মিত হয়েছিল । দূর দূরান্ত থেকে যারা আসতেন, তারা একদিনেই ফিরে যেতে পারতেন না । তাই তাদের থাকার জন্য তৈরী করা হয়েছিল প্রাচীরের লাগোয়া ছোট ছোট থাকার জায়গা ।
তারপরেই মুসলমান শাসন শুরু হল । তখন এই দুর্গটি মুসলিমদের অধিকারে চলে যায় । তখন মন্দিরের পুজারীরা মনে করলেন যে , দেব মূর্তি কে যদি সরিয়ে নিয়ে না যাওয়া হয় , তাহলে মুসলমানরা দেব মূর্তিকে অবমাননা করতে পারে । আচার নিয়ম মেনে পূজো হবে না , এই ভয়ে পূজারীরা তাদের দেবতাকে দুর্গের মধ্যে একটি কুপের মধ্যে লুকিয়ে রাখেন। তারপর তারা মন্দির ছেড়ে চলে যান । আবার অনেকেই বলেন , তারা কুপের মধ্যে লুকিয়ে রাখেন নি , অন্য জায়গায় সরিয়ে দিয়েছিলেন বা সঙ্গে করে নিয়ে চলে গেছলেন । শিবলিঙ্গটির নাম ছিল কপিলেশ্বর । তার কারণ হল , রাজা কপিলেশ্বর এই শিবলিঙ্গটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । আবার অনেকেই বলেন এই শিবলিঙ্গটির নাম গগনেশ্বর । যার কারণে ঐ গ্রামটির নাম গগনেশ্বর । আবার এমনও হতে পারে , গগনেশ্বর গ্রামের জন্য শিবলিঙ্গটির নাম গগনেশ্বর । এর কিন্তু কোনো লিখিত প্রমান নেই । সবটাই জনশ্রুতি ।
মুসলমানরা দুর্গটি অধিকার করার পর সেখানে তারা একটি মসজিদ নির্মাণ করে । তাহলে বোঝাই যাচ্ছে,আগে তৈরী হয়েছিল মন্দির তারপর তৈরী হয়েছিল মসজিদ । আবার অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে মারাঠা গন উড়িষ্যায় তাদের আধিপত্য বিস্তার করার সঙ্গে সঙ্গে এই প্রদেশের কিছু জায়গা তাদের দখলে চলে যায় । তারপর তারা মুসলমানদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয় এবং ঐ স্থানটিকে একটি দুর্গে পরিণত করে । চারপাশে যে খুপরি গুলি ছিল , সেখানে সৈন্য সামন্ত দের থাকার জন্য নির্দিষ্ট করা হয় । মারাঠারা যতদিন ছিল ততদিন পর্যন্ত তারা তাদের দুর্গ রূপে ব্যবহার করেছিল । তাদের আধিপত্য যখন লোপ পেতে শুরু করে তখন থেকে দুর্গটি ধ্বংস হতে শুরু করে । এখন অবস্থা আরও খারাপ । দুর্গটির সামনে একটি পুকুর আছে । তার নাম যজ্ঞেশ্বর কুণ্ড ।
কুর্মবেড়া বা কুড়ুমবেড়া । কুর্ম শব্দের অর্থ কচ্ছপ ।
কাছিমের খোলা যেমন শক্ত তেমনি দুর্ভেদ্য শক্ত প্রাচীর দিয়ে ঘেরা জায়গাটির নাম কুর্মবেড়া – কুরুমবেড়া – কুড়ুমবেড়া । তার থেকেই মনে হয় “কুড়ুমবেড়া” নামটি এসেছে । যাই হোক , নামে কিবা আসে যায় । মেদিনীপুরের একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্য এটাই বড় কথা ।।