এইদিন ওয়েবডেস্ক,কলকাতা,২০ জুন : মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় আসার পর ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ একটা ‘পলিটিক্যাল ইস্যু’ হয়ে গেছে । কোন দিনটা ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ হিসাবে উদযাপন করা হবে,এই বিতর্ক মূলত তিনই উসকে দিয়েছিলেন । ঐতিহাসিক ভাবে ১৯৪৭ সালের ২০ জুন ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য হিসাবে পশ্চিমবঙ্গ অন্তর্ভুক্ত হলেও ২০২৩ সালের আগস্টে বিধানসভায় আনুষ্ঠানিকভাবে পশ্চিমবঙ্গ দিবস মনোনীত করার একটি প্রস্তাব পেশ করেছিল তৃণমূল কংগ্রেস সরকার । রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির বিরোধিতা সত্ত্বেও অবশেষে ২২ আগস্ট দিনটি বেছে নেওয়া হয় । যদিও বিজেপি ও রাজভবনে ২০ জুন দিনটি ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ হিসাবে পালন করে আসছে ।
আজ ২০ শে জুন শুক্রবার, সেই বিশেষ দিন যখন পাকিস্তানের শাসন থেকে মুক্ত হয়ে ভারতে আনুষ্ঠানিক ভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ । এই অন্তর্ভুক্তির জন্য যাঁর সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল তিনি হলেন ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি । তাই, ইসলামি রাষ্ট্রের করাল গ্রাসের হাত থেকে বাঙালি হিন্দুদের রক্ষা করার জন্য এই বিশেষ দিনে তাঁকে বিনম্র চিত্তে প্রনাম জানিয়েছেন রাজ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার ও বিজেপি বিধায়িকা অগ্নিমিত্রা পাল ।
শুভেন্দু অধিকারী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, ‘আজ ২০শে জুন, পশ্চিমবঙ্গ দিবস। মুসলিম লীগের দাবি ছিল যে গোটা বাংলাকেই পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বাধ সেধেছিলেন ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তিনি তাঁর সুদক্ষ রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন যে পাকিস্তান হিন্দুদের জন্য নরকে পরিণত হবে। তাই তিনি দাবী তোলেন, ভারত ভাগ করলে, বাংলাকেও ভাগ করে বাংলার হিন্দুপ্রধান অঞ্চলগুলি নিয়ে একটা ‘পশ্চিমবঙ্গ’ সৃষ্টি করতে হবে, যা হবে হিন্দুপ্রধান ভারতের অংশ। ওনার উদ্যোগেই বঙ্গীয় আইনসভা বাংলা ভাগ করার প্রস্তাব পাশ করে ভারতবর্ষের অঙ্গরাজ্য হিসাবে নির্ধারিত করার স্বপক্ষে রায় দেয়। দিনটা ছিল ২০শে জুন ১৯৪৭। সৃষ্টি হয়েছিল বাঙালি হিন্দুর একমাত্র স্বভূমি পশ্চিমবঙ্গের। তাই পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী সকলের জন্য আজকের এই দিনটির তাৎপর্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গের স্রষ্টা ডঃ শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী ছিলেন বলেই আজ আমরা, বিশেষতঃ বাঙালি হিন্দুরা ভারতবর্ষের নাগরিক হিসেবে এখনও মাথা উঁচু করে, সসম্মানে জীবনযাপন করতে পারছি।
আজকের দিনে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের চরণে শত কোটি প্রণাম জানাই। যাঁরা ইতিহাস কে বিকৃত করে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অবদান কে অস্বীকার করেন তাদের চেতনা জাগ্রত হোক এই কামনা করি।’
রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার লিখেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গ মানে গৌরব, সংস্কৃতি আর আত্মত্যাগ।এই ভূমি কেবল একটি ভৌগোলিক সীমানা নয়, এ এক সহস্রাব্দব্যাপী ঐতিহ্যের ধারা, যেখানে একইসঙ্গে বইছে জ্ঞানচর্চার পবিত্র স্রোত এবং আত্মত্যাগ- রক্তস্নাত জাতিসত্তার সংগ্রামের ইতিহাস। আজকের এই দিনে, আমরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি সেই মহাপুরুষকে – ভারত কেশরী ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, যাঁর দূরদৃষ্টি, সাহস ও আত্মবলে বাংলার হিন্দু সমাজ নিশ্চিত করেছিল একটি স্বতন্ত্র ভূখণ্ড, একটি ‘হিন্দু হোমল্যান্ড’ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের জন্ম।
দেশভাগের বিভীষিকাময় অধ্যায়ে যখন সমগ্র পূর্ববঙ্গ হিন্দুদের জন্য মৃত্যু উপত্যকা হয়ে উঠছিল, তখন বাংলাকে সম্পূর্ণভাবে পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত রুখে দাঁড়িয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ।
তিনি ছিলেন সেই কণ্ঠ, যিনি বলেছিলেন:
“We must have a place in this country where the Bengali Hindu can live with dignity.”
আজকের দিনটি তাই কেবলমাত্র স্মরনীয়ই নয়, আজকের এই দিন হল এক গর্বময় পরিচয়ের পুনরুদ্বোধন। একটি জাতিসত্তা, একটি আত্মার স্বাধীন অস্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য।
আজকের দিনটি প্রতিটি বাঙালি হিন্দুর কাছে এক গৌরবময় পুনর্জন্মের দিন।এই দিনে আমরা পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে কৃতজ্ঞতা জানাই পশ্চিমবঙ্গের স্থপতি ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-কে।সকলকে জানাই পশ্চিমবঙ্গ দিবসের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।’
অগ্নিমিত্রা পাল লিখেছেন,’১৯৪৭ সালের ২০ শে জুন,ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বঙ্গীয় আইন সভায়, মুসলীম লীগের সমগ্র বাংলাকে পাকিস্তানে অন্তর্ভূক্ত করার চক্রান্তকে নসাৎ করে হিন্দুদের একমাত্র মাতৃভূমি পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টির জোড়ালো দাবি তোলেন। ওনার এই দাবি কে মান্যতা দেয় বঙ্গীয় আইন সভা। সৃষ্টি হয় পশ্চিমবঙ্গের । এটি ভারতের একটি অঙ্গ রাজ্য হিসাবে পরিগণিত হয়।আজ ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির পাদপদ্মে প্রণাম নিবেদন করে,সকলকে জানাই পশ্চিমবঙ্গ দিবসের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।’
পশ্চিমবঙ্গের জন্মের ইতিহাস
১৯৪৭ সালের বাংলা বিভক্তির পূর্বে,১৯০৫ সালে প্রশাসনিক কার্যক্রমকে সহজতর করার লক্ষ্যে পূর্ব এবং পশ্চিম বাংলায় বিভক্ত করা হয় যা বঙ্গ ভঙ্গ হিসেবে পরিচিত। সেই সময় পশ্চিমবাংলা ছিল হিন্দু অধ্যুষিত এবং মুসলিমরা সেখানে সংখ্যালঘু, অন্যদিকে পূর্ববাংলা ছিল মুসলিম অধ্যুষিত এবং হিন্দুরা ছিল সংখ্যালঘু । মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ববাংলার মানুষ এই বঙ্গভঙ্গের প্রতি জোরালো সমর্থন জানিয়েছিল, কেননা তারা উপলব্ধি করেছিল যে এই বিভক্তির মাধ্যমে তারা তাদের নিজস্ব একটি প্রদেশ পেতে পারে। কিন্তু হিন্দুরা এই বিভক্তির বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়। এই বিতর্ক পরবর্তীকালে সাম্প্রদায়িক হিংসার জন্ম দেয় এবং ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের মাধ্যমে এর নিষ্পত্তি করা হয়। ১৯০৫ সালের বাংলা বিভক্তির সময়ে হিন্দু এবং মুসলিমদের মাঝে সৃষ্টি হওয়া এই মতানৈক্য পরবর্তীকালে আবারো বিতর্ক তৈরি করে যা আইন তৈরী, এমনকি ১৯৪৭ সালের বাংলা বিভক্তিতে প্রভাব রেখেছে এবং সেই সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর এজেন্ডা হিসেবে বারংবার সামনে এসেছে।
পরিকল্পনা অনুসারে, ১৯৪৭ সালের ২০ জুন বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্যগণ বাংলা বিভক্তিকরণ প্রস্তাবের উপরে তিনটি আলাদা ভোট প্রদান করে।
পরিষদের সকল সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ অধিবেশনে,বিভক্তিকরণের পক্ষে ১২৬ ভোট এবং বিদ্যমান সংবিধান পরিষদের যোগ দেওয়ার পক্ষে ৯০ ভোট (অর্থাৎ, ভারত) প্রণীত হয়। তারপর একটি পৃথক অধিবেশনে বাংলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় সদস্যগণ, বাংলার বিভক্তি এবং সম্পূর্ণ একটি নতুন গণপরিষদ (অর্থাৎ, পাকিস্তান ) এ যোগদান করার সপক্ষে ভোট প্রদান করেন; যেখানে নতুন রাষ্ট্রে যোগদানের সপক্ষে ১০৬ এবং বিপক্ষে ৩৫ টি ভোট পড়ে । একই পদ্ধতি বাংলার মুসলিম অধ্যুষিত নয়, এমন স্থানগুলোতেও অনুসরণ করা হয়েছিল। সেখানে ৫৮ ভোট বিভক্তিকরণের পক্ষে এবং ২১ ভোট বিপক্ষে প্রণীত হয়।
মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা অনুযায়ী, যদি একটিও একক সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট বিভক্তিকরণের পক্ষে প্রণীত হয় তাহলে প্রদেশ বিভক্ত হবে । এই পরিকল্পনাকে তুলে ধরে, ২০ জুন পরিষদে ভোটাভুটির ফলফলের প্রেক্ষিতে পশ্চিম বাংলা প্রদেশ ভারত এবং পূর্ব বাংলা প্রদেশ পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এছাড়াও, মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা অনুসারে,৭ জুলাই অনুষ্ঠিত একটি গণভোটে, সিলেটের নির্বাচকমণ্ডলী পূর্ব বাংলা প্রদেশে যোগদানের সপক্ষে ভোট প্রদান করে। পরবর্তীতে স্যার সিরিল রেডক্লিফ এর নেতৃত্বে সীমানা কমিশন দুই নব নির্মিত প্রদেশের মধ্যে আঞ্চলিক সীমানা নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং ভারতীয় স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭ অনুসারে ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারতকে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়।
উদ্বাস্তুদের ঢেউ
বাঙালি হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গ এবং বাঙালি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলার মধ্যে বঙ্গভঙ্গের পরে, উভয় পক্ষ থেকে বাঙালি হিন্দু / বাঙালি মুসলিম শরণার্থীদের আগমন ঘটে। একটি অনুমান থেকে জানা যায় যে দেশভাগের আগে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা ছিল ২১.২ মিলিয়ন, যার মধ্যে মাত্র ৫.৩ মিলিয়ন বা প্রায় ২৫ শতাংশ মুসলিম সংখ্যালঘু ছিল, তাদের বেশিরভাগই বাঙালি মুসলমান ছিল, যেখানে পূর্ব বাংলায় ৩৯.১ মিলিয়ন লোক ছিল, যার মধ্যে ১১.৪ মিলিয়ন বা প্রায় ৩০ শতাংশ ছিল হিন্দু সংখ্যালঘু অর্থাৎ প্রধানত বাঙালি হিন্দু। প্রায় ২.১৬ মিলিয়ন বাঙালি হিন্দু পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গ অঞ্চল ছেড়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ অঞ্চলে চলে আসে, এবং পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ অঞ্চলকে সমর্থনকারী জনতার কারণে সাম্প্রদায়িক হিংসা ও দাঙ্গার কারণে দেশভাগের পরপরই মাত্র চার লাখ বাঙালি মুসলমান পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গ অঞ্চলে চলে গেছে। কিন্তু কয়েক কোটি হিন্দু বাঙালি আশ্রয় নেয় ভারতে ।। (তথ্যসূত্র : সৌজন্যে উইকিপিডিয়া)

