ভারতের বহু হিন্দু বীর ছিলেন যারা ইতিহাসের পাতায় আজও উপেক্ষিত । দেশের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী সৌদি আরবের মক্কায় জন্মগ্রহণকারী আবুল কালাম গোলাম মুহিউদ্দীন ওরফে মাওলানা আজাদের প্ররোচনায় বামপন্থী ইতিহাসকাররা মুঘলদের মহিমা কীর্তন করতে গিয়ে ওই সমস্ত হিন্দু বীরদের ইতিহাসের পাতেতে কার্যত কোনো ঠাঁইই দেননি । এমনই এক বাঙালি হিন্দু বীর ছিলেন বাংলার বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম শক্তিশালী এবং বিখ্যাত শাসক
মহারাজা কেদারনাথ দেবরায় (১৫৬১-১৬০৩ খ্রি.) । যিনি মুঘল আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে বিক্রমপুরে স্বাধীন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি মুঘল-রাজপুত জোটের সৈন্যদলকে চারটি বিধ্বংসী যুদ্ধে পরাজিত করে এবং উপকূলীয় অঞ্চলে পর্তুগিজ ও আরাকানি মগ জলদস্যুদের দমন করে বাঙালিদের রক্ষা করেছিলেন। তাঁর শাসনাধীন বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মধ্যে ছিল ঢাকা, বিক্রমপুর, কুমিল্লা, সিলেট, নোয়াখালী ও চাঁদপুরের বৃহৎ অংশ।
কেদার রায়ের জন্ম ১৫৬১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের বিক্রমপুরে । পিতা যাদব রায়ের মাধ্যমে দেববংশী বঙ্গজ কায়স্থ বংশের উত্তরাধিকার লাভ করেন তিনি । তাঁর পূর্বপুরুষ নিম রায় সম্ভবত সেন আমলে বিক্রমপুরের আড়া ফুলবাড়িয়ায় বসতি স্থাপন করেছিলেন এবং ভুঁইয়া উপাধি লাভ করেছিলেন । কেদার রায়ের রাজধানী ছিল বাংলাদেশের শ্রীপুর, যা বর্তমানে শরীয়তপুর জেলার কালীগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। তাঁর রাজত্ব পদ্মা নদীর দুই তীরের বিস্তীর্ণ জনপদ জুড়ে বিস্তৃত ছিল, যার মধ্যে ইদ্রাকপুর, ইদিলপুর, কেদারপুর এবং চাঁদপুর অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে পদ্মা নদীর ভাঙনে শ্রীপুরসহ তাঁর রাজ্যের অনেক স্মৃতিচিহ্ন পরবর্তী কালে বিলীন হয়ে গেছে।
তিনি বিপুলসংখ্যক রণতরীর অধিকারী কেদার রায় একটি সুশিক্ষিত নৌবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন এবং কিছু ভাগ্যান্বেষী পর্তুগিজকে তার রণতরীর অধ্যক্ষ নিয়োগ করেছিলেন। তাদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন পর্তুগিজ নাবিক ডোমিনিঙ্গ কার্ভালোক । মধ্যযুগের ভারতে হওয়া সবচেয়ে বিধ্বংসী নৌযুদ্ধে জয়ী হয়েছেন কেদার রায়। সেই যুগে শুধু পাঠান-মোগল নয়, মগ ও ফিরিঙ্গিদের অত্যাচারেও বঙ্গবাসী অতীষ্ঠ ছিল । লবণের খনিরূপে বিখ্যাত সন্দ্বীপকে ঘিরে বাঙালি-মগ-পর্তুগীজ-মোগল দের মধ্যে বহু যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল । কেদার রায়ের নৌবাহিনী সন্দ্বীপে মগ ও মুঘলদের বিরুদ্ধে বিধ্বংসী যুদ্ধে জয়ী হয়েছিল। আরাকান রাজা মেংরাজাগির ১৫০ রণতরীর আক্রমণ প্রতিহত করে তিনি ১৪০টি তরী দখল করেন এবং পরবর্তীতে ১০০০ রণতরীর আক্রমণেও মগ বাহিনীকে পরাজিত করেন। মুঘল সেনাপতি মানসিংহের বিরুদ্ধেও তিনি কালিন্দী নদীতে মন্দা রায়ের নেতৃত্বে মুঘল নৌবাহিনীকে পরাজিত করেন, যেখানে মুঘল সৈন্যদের রক্তে নদীর জল রঞ্জিত হয়েছিল।
কুলগুরু শ্রীমন্ত খাঁর (ভট্টাচার্য) বিশ্বাসঘাতকতা ও কেদার রায়-ঈসা খার যুদ্ধ
কেদার রায়ের সঙ্গে ঈসা খাঁর সঙ্গে প্রথম দিকে বন্ধুত্ব ছিল এবং তারা একসঙ্গে আরাকান রাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু ঈসা খাঁর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শত্রুতায় রূপান্তরিত হয় যখন ঈসা খাঁ জোরপূর্বক কেদার রায়ের বিধবা কন্যা স্বর্ণময়ীকে বিয়ে করেন।স্বর্ণময়ীর রূপ দেখে মোহিত হয়েছিলেন ঈসা খাঁ। সে বিয়ে করতে চায় বিধবা স্বর্ণময়ীকে। এতে বাবা চাঁদ রায় ও ভাই কেদার রায় দুজনেই প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হন । কেদার রায় আর ঈসা খাঁর বন্ধুত্ব সেখানেই শেষ। ঈসা খাঁ একদিন যাত্রা পথে আক্রমণ করে স্বর্ণময়ীকে তুলে নিয়ে যায়। তার নাম রাখে সোনাবিবি। কেদার রায়ের কুলগুরু শ্রীমন্ত খাঁ(ভট্টাচার্য) স্বর্ণমণিকে ছলপূর্বক ইসার হাতে তুলে দেয় । শ্রীমন্তের প্রতিহিংসাপরায়ণতার কারণ ছিল তার পরিবর্তে এক দেবল ব্রাহ্মণকে কেদার-চাঁদ ভ্রাতৃদ্বয়ের গুরু রূপে গ্রহণ করা । স্বর্ণময়ী বা সোনাবিবির নাম থেকে ঈসা খাঁর রাজধানীর নাম লোকমুখে সোনারগাঁ হয়েছে।এরপর এনায়ৎ খানকে দূতরূপে পাঠিয়েছিল চাঁদ রায়ের কাছে পত্র দিয়ে। এর ফলে ক্রুদ্ধ কেদার রায় ঈসা খানের কলাগাছিয়া দুর্গ আক্রমণ করে বিধ্বস্ত করেন । সেখান থেকে ঈসা পলায়ণ করে মেদিনীপুরে ত্রিবেণী দুর্গে চলে যায় ।
কেদার রায় তীব্র যুদ্ধে ঈসা খাকে হারিয়ে একের পর এক অঞ্চল বিধ্বস্ত ও করায়ত্ত করতে থাকেন। ঈশা খার রাজধানী আক্রমণ করেছিলেন।আরাকান রাজের সাথে যুদ্ধে ঈশা খাকে সাহায্য করেননি । মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি ঈশা খাকে ক্রমাগত আক্রমণ করেছিলেন কেদার রায় । কেদার রায়ের জীবন ট্র্যাজেডিতে পরিপূর্ণ। মুঘল সেনাপতি মান সিংহের সঙ্গে চতুর্থ যুদ্ধে মার্চ ১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে ফতেহজঙ্গপুরে তিনি নিহত হন।
কথিত আছে, যুদ্ধের নবম দিনে তিনি কামানের গোলার আঘাতে মূর্ছিত হন এবং পরে বন্দী অবস্থায় মারা যান। আরেকটি বর্ণনায় বলা হয়, তিনি ধ্যানস্থ অবস্থায় ছিন্নমস্তার পূজা করার সময় গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পর মুঘলরা তাঁর রাজ্য লুণ্ঠন করে এবং শ্রীপুর পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়।
মানসিং ও কেদার রায়ের পত্রযুদ্ধ
বিক্রমপুরের যুদ্ধের আগে মানসিং ও কেদার রায়ের মধ্যে পত্রযুদ্ধ হয়েছিল । মানসিং দূতের হাতে তার কাছে তরবারি ও শৃঙ্খল পাঠান এবং মিশ্র ভাষায় এক পত্র লেখেন । যার অর্থ : কেদার রায় হয় পালিয়ে যান বা মুঘলদের অধীনত্ব স্বীকার করুন নয়ত বিক্রমপুর আক্রমণ করতে সিংহের মত মানসিংহ আসছে ।
প্রত্যুত্তরে কেদার লিখে পাঠান –
“ভিনতি নিত্যং করিরাজ কুম্ভং
বিভর্তি বেগং পবনাতিরেকং
করোতি বাসং গিরিরাজ শৃঙ্গে
তথাপি সিংহঃ পশুরেব নান্যঃ ।” অর্থাৎ বায়ুর চেয়ে সিংহের বেশি গতি, নিয়ত হস্তীমুন্ড বিদারণ করে,সে পর্বতের চূড়াতে ও অবস্থান করে, তবুও সিংহ একটি পশুই| তিনি আরও বলেন-“ভেবে দেখো এ শৃঙ্খল কার পায়ে সাজে তরবারি লইলাম লাগাইব কাজে ।” তার চারিত্রিক তেজ ও বীরবিক্রম এই প্রত্যুত্তরের অক্ষরে অক্ষরে প্রকাশ পায় ।
কেদার রায়ের স্মৃতি বিক্রমপুরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে। তিনি দিগম্বরী দেবীর দীঘি, কেশব মায়ের দীঘি এবং শ্রীপুরে রাজবাড়ির মঠসহ অসংখ্য মন্দির ও দীঘি নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ভুবনেশ্বরী মূর্তি এখনও নদীয়ার লাখুরিয়ায় সংরক্ষিত আছে। তবে পদ্মার ভাঙনে তাঁর রাজধানী ও অনেক কীর্তি হারিয়ে গেছে, যার জন্য পদ্মা এই অঞ্চলে ‘কীর্তিনাশা’ নামে পরিচিত।
কেদার রায়ের বীরত্ব ও দেশপ্রেম বাংলার ইতিহাসে অমর হয়ে আছে । তিনি বারো ভুঁইয়াদের একত্রিত করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাঁদের মধ্যে রেষারেষির কারণে তিনি শেষ পর্যন্ত সফল হননি। তবুও তাঁর প্রজাবাৎসল্য, শাসনকৌশল এবং মুঘলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তাঁকে বাংলার এক অক্ষয় বীর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু এসব বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস আমাদের পড়ানো হয় না । মাওলানা আজাদের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অঙ্গ হিসাবে ইতিহাসের পাতায় উপেক্ষিত রাখা হয়েছে এই সমস্ত হিন্দু বীরদের । ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্টের পর প্রায় ৬ দশক দেশের ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেস মাওলানা আজাদের ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে দিয়েছে । যেকারণে আমাদের শুধু মুঘল ইতিহাসের কাহিনীই জানানো হয় ।
তাই সাহিত্যিক সুনীল গাঙ্গুলী একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘বাংলার বারোভুঁইয়ারা ইতিহাসে বঞ্চিত। বড় বড় ইতিহাস গ্রন্থগুলিতে শুধু মুঘল-পাঠানদের দ্বন্দ্বই স্থান পেয়েছে, বাংলার এইসব বীর যোদ্ধাদের কাহিনী উপেক্ষিত।’ আসলে সুনীল গাঙ্গুলীও জন্মেছিলেন এই অঞ্চলে। যে গ্রামে তিনি জন্মেছিলেন, সেটি রায়পুর থেকে মাত্র পনের-বিশ মাইল দূরে। তাই তাঁর অন্তরেও বেজেছে এই ভুলে যাওয়ার অন্যায়বোধ।।
তথ্যসূত্র : কৃতজ্ঞতা স্বীকার উইকিপিডিয়া ও “ইস্ট ইজ রাইজিং”-এ লেখা সুফল সরকারের প্রতিবেদন ।