এইদিন ওয়েবডেস্ক,কলকাতা,০৪ জানুয়ারী : গত পয়লা জানুয়ারী উৎসবের আগে বেশ কিছু মহিলা ও ‘মদুপ’ পুরুষ কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে কলকাতার হরিনাথ দে রোডের সুখিয়া স্ট্রিট মোড়ের মা শ্যামা সুন্দরী মন্দিরে চড়াও হয়ে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের বিরুদ্ধে । একটা ভিডিও বার্তায় কুণাল অভিযোগ করেছিল দেবী কালীকে নিয়ে অলৌকিক কাহিনী প্রচার করে এলাকায় চূড়ান্ত অরাজকতার সৃষ্টি করে রেখেছে মন্দির কর্তৃপক্ষ । মন্দিরটির কোন বৈধ ট্রাস্ট নেই । শ্রদ্ধালুদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা এমনকি পরনের সোনার গহনা পর্যন্ত নিয়ে নেওয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন কুণাল । তার এই সমস্ত অভিযোগের জবাব একটা ভিডিও বার্তায় দিয়েছেন মন্দিরেত একজন তরুন সেবাইত । তার অভিযোগ যে কুণাল ঘোষ ও তৃণমুল কংগ্রেস দীর্ঘ দিন ধরে মন্দিরের দখল নিতে চাইছে । ব্যক্তিগত ভাবে মন্দিরের ট্রাস্টিতে ঢুকতে চাইছে কুণাল । এমনকি কুণালের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগও তুলেছেন তিনি । ওই তরুণ সেবাইত কাঁদতে কাঁদতে কুনাল ঘোষ এবং তার দলবলকে নির্বংশ হওয়ার অভিশাপ দিয়ে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে মন্দিরের ট্রাস্টটিতে কোন রাজনৈতিক দলকে ঢোকানো হবে না ।
কলকাতার হরিনাথ দে রোডের সুখিয়া স্ট্রিট মোড়ের মা শ্যামা সুন্দরী মন্দিরে হামলার মুহূর্ত ও তরুণ সেবায়েতের বক্তব্যের ভিডিও শেয়ার করা রাজ্য বিজেপির এক্স হ্যান্ডেলে । হামলার মুহূর্তের ভিডিওতে দেখা গেছে যে মন্দিরের কোলাপ্সেবেল গেটে লাগানো রয়েছে । বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বেশ কিছু পুরুষ ও মহিলা । তারা মন্দিরের ভিতরে থাকা একজন সেবাইত ও একজন মহিলার সঙ্গে তর্কাতর্কি করছে । মন্দিরের ভিতরে থাকা মধ্যবয়সী মহিলাকে বলতে শোনা গেছে, ‘বাপের বেটা হলে কালকে সকালে এসে মেরে যাস । মদ খেয়ে আসবি না । ভালোভাবে এসে মেরে যাবি ।’
তরুণ সেবাইত বলেন,কুণাল ঘোষ, ওই সারদা কান্ডের চোরটা,তার বক্তব্য কি ? এতদিন মেয়েকে সামলাচ্ছেন এবার মেয়েকে আমাদের দিন । কিন্তু আমার আমরা আমাদের মেয়েকে বিক্রি হতে দেব না । পার্টি পলিটিক্স করে যেমন সব মন্দির দখল করে নিয়েছে তেমনি আমাদের মন্দির তাড়াতাড়ি করতে চেয়েছিল । কিন্তু আমরা আমাদের মন্দিরকে হতে দেব না,শরীরে একটা রক্তের বিন্দু যতক্ষণ আছে হতে দেব না ।’
তিনি সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে একতরফা খবর পরিবেশনেট অভিযোগ খুলেছেন । তার অভিযোগ দিয়ে তাদের মতামত নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি বাংলার প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমগুলি । এরপর ওই তরুণ সেবাইত বলেন, বলছে চাল চুরি করছে । আরে তুই তো গরু চুরি করছিস, সোনা চুরি করছিস । গরিব মানুষের টাকা খেয়ে মেরেছিস । সেইগুলোর আগে হিসাব দে ।’
এরপর তিনি কেঁদে ফেলেন এবং বলেন,’আর আমরা চুরি করছি? আমরা রোজ তিন বেলায় মানুষকে বিনামূল্যে প্রসাদ খাওয়াই । আমাদের মন্দির থেকে রোজ মাকে শাড়ি দেওয়া হয় । প্রত্যেক বছর হাজার হাজার ভক্ত মাকে দুবার করে বস্ত্র দান করেন । আমরা টাকা চাই, সোনা চাই ? অতই সহজ ?’ তিনি বলেন, ‘বলছেন আপনার মাকে, আপনার মেয়েকে অনেক সামলে নিয়েছেন এবার আমাদের সামলাতে দিন । আপনি যদি আমাদের কথা শোনেন তাহলে সব চ্যানেলে খবর হবে । সব পরিষ্কার হয়ে যাবে এবং মায়ের মন্দিরে আবার ভক্ত আসবে । আমরা মেনে নিতে পারব না । একজনার চোরের হাতে আমাদের মাকে সঁপে দিতে পারবো না । মাকে ভালোবাসি ।’
সেবাইত বলেন, ওদের দাবি কি ? যদি তোরা আমাদের কথা না শুনিস তাহলে মার্ডার করে দেবো । আমাদের মাডারের হুমকি দিচ্ছে । কোথায় সেই সমস্ত মিডিয়া ? কোথায় আমাদের বক্তব্য ? আজ আমাদের পাশে কি কেউ নেই ? কোথায় মমতাদি ? কোথায় বসে আছেন আপনি এখন ? আপনার পার্টির লোক, কুনাল ঘোষ ধরে মারছে আমাদের । প্রমাণ কোথায় ওর ? আপনি যে দেশের জন্য মন্দিরের জন্য এত কিছু করছেন সবই কি লোক দেখানো ? আমাদের ঘরে অত্যাচার হচ্ছে আমাদের কোন কথা শুনবে না ?’ কেঁদে ফেলে ওই তরুণ ফের বলতে শুরু করেন, ‘আমাদের বাইট কোথায় ? তাহলে আপনিও ওদের সঙ্গে নাকি ? পার্টিকে দিয়ে দিলে সবাই ধোয়া তুলসী পাতা ? আর পার্টিকে না দিলেই সব খারাপ?’
ওই তরুনে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ‘আমাদের মন্দিরে এসে প্রায় দিনেই ১ লাখ টাকা করে চাইতো । দেওয়া হতো । এখন ট্রাস্ট এর মেম্বার করতে হবে । আমাদের ট্রাস্ট আছে কি নাই কি ওরা কি জানে না ? ওরা এতই বোকা ? ২০২১ সালের আমাদের ট্রাস্ট আছে। দরকার হলে কাগজপত্র আমরা দেখিয়ে দিতে পারব । ওই বাড়িটা মায়ের নামে কেনা বাড়ি আমাদের দলিল আছে । সব প্রমান আমাদের কাছে আছে । মায়ার ট্রাস্ট তৈরি করে তবে ওখানে মন্দির হয়েছে ।’
কুনালের বিরুদ্ধে তার অভিযোগ, উনি প্রথমেও এসেছিলেন । এত বছর ধরে মায়ের প্রসাদ খেয়ে গেছে সেদিন তো খারাপ লাগেনি । খারাপ লাগলো কখন ? পয়লা জানুয়ারীর দিন । যখন প্রচুর ভক্ত সমাগম হবে, তখন সবকিছু বন্ধ করে দেব । এটা পরিকল্পনা নয় ?’
ওই তরুন সাধারণ মানুষের উপর তীব্র অভিমানে কাঁদতে কাঁদতে হলেন,মানুষ কোথায় আপনারা ? যে মায়ের মুখের হাসি দেখে আপনারা পাগল হতেন, এই মাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে । বলছেন নুপুর পরে হেঁটে বেড়ায় ? মা কি বাইজি ? মা..আমার মেয়ে…তাকে নিয়ে বলছে আপনারা কিছু দেখছেন না ? কোথায় আপনাদের বিচার ? কোথায় আমাদের সরকার ? যে একটা মন্দির দখল করা নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে ।’
প্রসঙ্গত,কলকাতার শ্যামাসুন্দরী মন্দিরের বিষয়ে ভিডিও করে সাফাই দিয়েছিলেন কুনাল ঘোষ৷ এই বিষয়ে সেবাইত বলেন,’দুটো ভিডিও ছেড়েছে । কি বলেছে তাতে ? প্রথম ভিডিওতে উনার বক্তব্য আমরা নাকি চোর, আমরা খারাপ এবং আমরা সবকিছু৷ দ্বিতীয় ভিডিওতে বলছে কি প্রশাসন যদি এসে বলে দেয় তাহলে সব মেনে নেবে । বলছে চার ফুটের রাস্তা । ৪০ ফুট ৪০০ ফুট সব হয়ে যাচ্ছে । উনার শর্ত কি ? উনাকে ট্রাস্টটিতে নিতে হবে, তৃণমূলের লোককে নিতে হবে । আমরা মানবো না ।’ এরপর তিনি তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘কোন পার্টি মন্দিরে আসবেনা । বেঁচে থাকতে হবে না । আমাদের শরীরে একটা রক্তবিন্দু থাকতেও আমরা হতে দেব না । আমি দেখতে চাই মায়ের জোর বেশি না তোর জোর বেশি । শয়তান তুই নির্বংশ হবি….তোকে আমি অভিশাপ দিলাম… আর পাড়া থেকে যারা এসেছে তারাও নির্বংশ হবে । বলে রাখলাম আমার কথা সব সত্যি হবে…আমি যদি মাকে ভালোবেসে থাকি…জয় মা শ্যামসুন্দরী ।’
প্রসঙ্গত,এর আগে কুণাল ঘোষ দেবী শ্যামাসুন্দরীকে নিয়ে বিদ্রুপ করে বলেছিলেন, ‘রাত্রিবেলায় মা নাকি হাঁটের নাঁচেন এবং ছাদে হাঁটেন এসব শোনা যায় । দক্ষিণেশ্বরের মা হাঁটলেন না। কালীঘাটের মা হাঁটলেন না। শ্যামা সুন্দরীতে এসে মা হাঁটছেন ? এটা নাকি ৫১ পিঠের সমান । আজকালকার হিন্দুদের জমানায় এসব রটেছে । আজকালকার ইউটিউবের জমানায় এসব ঘটেছে । মানুষ ভক্তি বিশ্বাস থেকে আসছেন ।’ তার আরও বক্তব্য হল,’মায়ের নাম করে বুজরুকীর কথা বলে যেভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে ।’
কিন্তু বুজুরকি করে যদি মন্দির চালানো হয় তাহলে কুনাল ঘোষ প্রশাসনের দারস্য না হয়ে কেন মন্দিরের চড়াও হলেন ? এই প্রশ্ন উঠছে স্থানীয় মহল থেকে । রাজ্য বিজেপির এক্স হ্যান্ডেল কলকাতার শ্যামাসুন্দরী মন্দিরে কুনাল ঘোষের নেতৃত্বে তৃণমূলের হামলা প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে, ‘হরিনাথ দে রোডের সুখিয়া স্ট্রিট মোড়ে অবস্থিত কলকাতার মা শ্যামা সুন্দরী মন্দির রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে বন্ধের দ্বারপ্রান্তে। মা কালী, মহাদেব এবং জগন্নাথ দেবের মূর্তিগুলি টিএমসি নেতা কুনাল ঘোষ, টিএমসি গুন্ডা এবং স্থানীয় কাউন্সিলরের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য ইতিমধ্যেই একটি নিরাপদ স্থানে সরানো হয়েছে।
1লা জানুয়ারী, TMC নেতা কুণাল ঘোষ মন্দিরে প্রবেশ করেন, সেবাইতদের (পুরোহিতদের) উপর আক্রমণ করেন এবং মন্দির কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ তোলেন। এই মন্দিরটি সম্প্রদায়ের সেবার একটি স্তম্ভ, বিনামূল্যে খাবার প্রদান, বস্ত্র বিতরণ এবং প্রতিদিন হাজার হাজার ভক্তদের আকর্ষণ করে। টিএমসি দীর্ঘদিন ধরে মন্দিরের তহবিলকে টার্গেট করেছে, নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং এখন এই ধরনের কৌশল অবলম্বন করছে। একটি ভিডিওতে, একজন পুরোহিত প্রকাশ করেছেন কীভাবে কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত কুনাল ঘোষ সহ টিএমসি সদস্যরা মন্দিরটিকে স্থায়ীভাবে বন্ধ করার চেষ্টা করছেন। আরেকটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে টিএমসি নেতা উত্তম হালদার এবং মাতাল সহযোগীরা একজন পুরোহিতের পরিবারকে সহিংসতার হুমকি দিচ্ছে।
এসব ঘটনা ঘটলেও ব্যবস্থা নেয়নি কলকাতা পুলিশ। এদিকে, নিজেকে মা কালীর ভক্ত বলে দাবি করা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নীরব। বাংলা মিডিয়াও এই ঘটনা কভার করছে না। বাংলাদেশের মতোই একটি ঘটনা কলকাতার হৃদয়ে ঘটছে তৃণমূল নেতাদের রাজাকারদের ক্যাপ পরা নিয়ে। হিন্দুরা কী বিশ্বাস করবে তা ঠিক করার কোনো কর্তৃত্ব কুনাল ঘোষের নেই। বাঙালি হিন্দুরা মা শ্যামসুন্দরীর আক্রমণকে হালকাভাবে নেবে না।’।