সনাতন শাস্ত্র বলে : “স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ো ; পরধর্মো ভয়াবহ” । অর্থাৎ,নিজ ধর্মে মৃত্যও ভালো,কিন্তু পরধর্ম হল ভয়াবহ । ধর্মান্তরিত জীবন অনেকের জন্যই অভিশাপ হয়ে গিয়েছিল । তার জ্বলন্ত উদাহরণ হলেন সনেটের প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্ত । ব্রিটিশ ভারতের পূর্ববঙ্গ অধুনা বাংলাদেশের যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামের সম্ভ্রান্ত হিন্দু কায়স্থ পরিবারে ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারী জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি । ধর্মান্তরিত হয়ে বিয়ে করেছিলেন যথাক্রমে রেবেকা টমসন ম্যাকট্যাভিশ (১৮৪৮- ১৮৫৬)কে । মাত্র ৮ বছর স্থায়ী হয়েছিল এই সম্পর্ক৷ এরপর এমিলিয়া হেনরিয়েটা সোফি হোয়াইট (১৮৫৮-১৮৭৩)কে বিয়ে করেন মধুসূদন দত্ত । দ্বিতীয় দাম্পত্য জীবন ১৬ বছর স্থায়ী হয় । বাবা রাজনারায়ণ দত্ত ও তাঁর প্রথমা পত্নী জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান মধুসূদন ধর্মান্তরিত হওয়ার কারনে ত্যাজ্যপুত্র হয়ে আর কোথাও থিতু হতে পারেননি । দুই সন্তান নেপোলিয়ন ও শর্মিষ্ঠার পিতা হয়েও শেষ জীবন অর্থাভাব ও একাকীত্বের মধ্যে কাটে তার ।
তবে শুধু মাইকেল মধুসূদন দত্ত নন,আধুনিক প্রজন্মের মধ্যেও এমন বহু নজির আছে । বিনোদন জগতের অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে শুরু করে মিডিয়া জগতের সাংবাদিকরা পর্যন্ত কেউ কেউ করুণ পরিনতির মুখোমুখি হয়েছেন ৷ প্রেমের টানে ও ব্যক্তিগত স্বার্থে তারা ধর্ম পরিবর্তন তো করেছিলেন, কিন্তু তাদের অকাল মৃত্যু অথবা দুর্বিষহ জীবনের মুখোমুখি হতে হয় । নিচে বাংলাদেশের কয়েকজন ধর্মান্তরিত ব্যক্তিত্বের নাম উল্লেখ করা হল :
১। গওহর জামিল (১৯২৫ -১৯৮০) :
বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী ও জাগো আর্ট সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা। তার পূর্বনাম ছিল গণেশচন্দ্র নাগ। বাংলাদেশের বিক্রমপুর বর্তমানে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান গ্রামের বিখ্যাত নাগ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালে প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী ও অভিনেত্রী রওশন জামিলের প্রেমে পড়ে ধর্মান্তরিত হয়্ব তাকে বিয়ে করেন । নাম নেন গওহর জামিল। ১৯৮০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সড়ক দূর্ঘটনায় মাত্র ৫২ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তার ।
২। প্রবীর মিত্র (১৯৪৩ – ২০২৫) :
প্রবীর কুমার মিত্র ছিলেন একজন বিখ্যাত বাংলাদেশী চলচ্চিত্র অভিনেতা। প্রবীর মিত্র জন্মগ্রহণ করেন কুমিল্লার চান্দিনাতে। ধর্মান্তরিত হয়ে প্রেমিকা সেলিনা হোসেন অজন্তাকে বিয়ে করেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন যে, বিয়ে করার সময় তিনি হিন্দুধর্ম থেকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হন এবং এই ধর্মেই আছেন। তখন তার নাম রাখা হয় হাসান ইমাম।
৩। বাপ্পা মজুমদার (১৯৭২- ):
শুভাশিস মজুমদার বাপ্পা যিনি বাপ্পা মজুমদার নামে অধিক পরিচিত। জন্মগ্রহণ করেন ঢাকাতে। একজন বাংলাদেশী সঙ্গীতশিল্পী, গীতিকার এবং সুরকার। তরুণ ভক্তদের কাছে সমসাময়িক গান এবং আদব কায়দার কারণে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সঙ্গীত মহলে তিনি বাপ্পা দা নামে পরিচিত। ২০০৮ সালের মেহবুবা মাহনূর চাঁদনীকে এবং ২০১৮ বিয়ে করেন তানিয়া হোসাইনকে বিয়ে করেন ধর্মান্তরিত হয়ে ।
৪। সুব্রত বড়ুয়া (১৯৬০- ):
সুব্রত বড়ুয়া জন্মগ্রহণ করেন ঢাকাতে। আশির দশক থেকে সুব্রত বড়ুয়া বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় একজন অভিনেতা হিসাবে পরিচিত। তিনি অভিনয় জীবনে তার সহ অভিনেতা ইফতে আরা ডালিয়া দোয়েলের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে জান, পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং ধর্মান্তরিত হয়ে নাম রাখেন শাহরুখ ফারদিন সুব্রত । তাদের সংসার জীবনে দুটি সন্তান রয়েছে। তাদের কন্যা সন্তান প্রার্থনা ফারদিন দীঘি।
৫। শবনম (১৯৪৬ – ):
ঝর্ণা বসাক বাংলাদেশের প্রখ্যাত নায়িকা ও অভিনেত্রী । যিনি শবনম নামে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী শবনম সমসাময়িক সময়ে অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ও রোমান্টিক নায়িকা হিসেবে তৎকালীন পাকিস্তানের (পূর্ব ও পশ্চিম) সমানভাবে জনপ্রিয় ছিলেন।স্বনামধন্য সঙ্গীত পরিচালক রবিন ঘোষ (খ্রিষ্টান)-কে শবনম বিয়ে করেন ১৯৬৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর।
৬। অরুণা বিশ্বাস (১৯৬৭ – ):
অরুণা বিশ্বাস একজন বাংলাদেশী টেলিভিশন, মঞ্চ এবং চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। সেই সাথে তিনি একজন টেলিভিশন নাটকের পরিচালক। তিনি অমলেন্দু বিশ্বাস এবং জ্যোৎস্না বিশ্বাসের কন্যা। জন্মগ্রহণ করেন মানিকগঞ্জ জেলায়। ১৯৯৬ সালে অরুণা বিশ্বাস বিয়ে করেন চম্পার ভাশুরের ছেলেকে। সেই সময় অরুণা ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তার নতুন নাম হয় নওরীন খান। বিয়ের পর তিনি কিছুদিন পর কানাডায় পাড়ি জমান এবং সেখানে এক সন্তানের জননী হন। এই সম্পর্কের প্রেক্ষিতে চম্পা হয়ে ওঠেন অরুণা বিশ্বাসের চাচী শাশুড়ি।
৭: বৃন্দাবন দাস (১৯৬৫ ):
বৃন্দাবন দাস বাংলাদেশের জনপ্রিয় নাট্যকার, অভিনেতা ও লেখক ও পরিচালক। বৃন্দাবন দাস পাবনা জেলার চাটমোহর উপজলার সাঁরোড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বৃন্দাবন দাস ১৯৯৪ সালের ১৯ জানুয়ারি ধর্মান্তরিত হয়ে অভিনেত্রী শাহানাজ খুশির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ।
৮: কুমার বিশ্বজিৎ (১৯৬৩):
কুমার বিশ্বজিৎ চট্টগ্রাম জেলায় জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি একজন বাংলাদেশী সঙ্গীত শিল্পী। তিনি বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সম্মানিত ব্যক্তিত্বদের একজন। একাধারে তিনি গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত শিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক। দাম্পত্য জীবনে কুমার বিশ্বজিৎ নাঈমা সুলতানার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন । অবশ্যই ধর্ম পরিবর্তন করে ।
৯। আল্পনা দুলারী দে:
আল্পনা দুলারী দে হলেন একজন বাংলাদেশী অভিনেত্রী, যিনি আশির দশক থেকে খল চরিত্রে অভিনয়ের জন্য পরিচিত। আল্পনা দুলারী দে হিন্দু থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর শাহনাজ পারভীন দুলারী নামে পরিচিত হন এবং মুসলিম ধর্ম পালন করেন।
১০। প্রাণ রায়:
প্রাণ রায় একজন বাংলাদেশী অভিনয়শিল্পী। প্রাণ রায় বাংলাদেশের বাগেরহাটে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা যোগেশ চন্দ্র রায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের ছাত্র ছিলেন। দাম্পত্য জীবনে তিনি তার সহপাঠী, নাট্যকার এবং পরিচালক শাহনেওয়াজ কাকলীকে ধর্মান্তরিত হয়ে বিয়ে করেছেন।
১১। অপু বিশ্বাস (১৯৮৯ – ):
বগুড়ার মেয়ে অবন্তি বিশ্বাস । মঞ্চ নাম অপু বিশ্বাস । তিনি একজন বাংলাদেশী চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। অপু বিশ্বাস ২০০৮ সালে ১৮ এপ্রিল নায়ক শাকিব খানকে গোপনে বিয়ে করেন। অপু বিশ্বাস শাকিব খানের সঙ্গে বিয়ের সময় ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হন এবং ধর্মান্তরিত নাম অপু ইসলাম খান রাখেন। অবশ্য তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে ।
১২। দেব চৌধুরী:
জনপ্রিয় ক্রীড়া সাংবাদিক ও বাংলাদেশের ক্রিকেটপাড়ার পরিচিত মুখ দেব চৌধুরী ৩১ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন শুক্রবার । নিজের ক্যারিয়ারের স্বার্থে তিনি ধর্ম পরিবর্তন করেছেন বলে জানা গেছে ।

