প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৭ অক্টোবর : কাগজে কলমে চালের মজুত ঘাটতি না থাকলেও স্বাভাবিক নেই চালের যোগান !সেই কারণে পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর ব্লকের স্কুলগুলির পড়ুয়াদের মিডডে মিল পাওয়া কার্যত যেন দুস্কর হতে বসেছে । এমনও এক একদিন যাচ্ছে পড়ুয়াদের মুখে মিডডে মিলের খাবার তুলে দিতে এক স্কুলকে অন্য স্কুল থেকে চাল ’ধার’ পর্যত নিতে হচ্ছে।এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কারণ নিয়ে ’রহস্য’ দানা বাঁধার সাথে সাথে শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভও বাড়ছে।তারই মধ্যে আবার মিডডে মিলের বিপুল পরিমাণ সরকারি চাল ’হাপিস’ করে দেওয়ার ‘গুঞ্জনও’ ছড়িয়ে পড়েছে।আর তা নিয়েই এখন তোলপাড় চলছে জামালপুরে।এ সব জেনে মিডডে মিলের ‘চাল ’বাড়ন্তের’ নেপথ্যে থাকা ’রহস্য’ উদঘাটনে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত দাবি করেছে বিরোধীরা ।
জামালপুর ব্লকে প্রাইমারি,আপার প্রাইমারি,শিশু শিক্ষাকেন্দ্র (এস এস কে) এবং মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র (এম এস কে) মিলিয়ে স্কুলে সংখ্যা আড়াইশোর বেশী । একটি মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রে আবার তালা পড়ে গিয়েছে।এইসব স্কুলগুলি ধরে ব্লকে এখন পড়ুয়ার সংখ্যা ৩০ হাজারেরও বেশী ।প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে,’পড়ুয়াদের মিডডে মিলের জন্যে খাদ্য দফতর প্রতি তিন মাস অন্তর দুই হাজারের বেশী কুইন্টল চাল ব্লকের বিডিওর দায়িত্বভারে পাঠায়।সেই চাল ব্লকের পাঁচরা এলাকায় থাকা ডিলার রুমা চট্টোপাধ্যায়ের গোটাউনে মজুত হয়।বিডিওর সুপারিশ মেনে ডিলার স্কুলগুলির চাহিদা মত চাল পৌছেদিয়ে থাকেন।
স্কুল গুলির প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষিকাদের বক্তব্য এমন ব্যবস্থাপনায় সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল।কিন্ত পাঁচ-ছয় মাস হল স্কুলে চাল সরবরাহের সেই স্বাভাবিক ব্যবস্থাপনা লাটে উঠে গিয়েছে। তার কারণে স্কুলে মিডডে মিল চালাতে গিয়ে এখন তাঁদের মাথায় হাত পড়ে যাচ্ছে। ব্লকের বেরুগ্রাম
অঞ্চলের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেন,’আমরা চাহিদা মত মিডডে মিলের চাল চেয়েও সময় মত পাচ্ছি না ,এটাই বাস্তব সত্য। বাকি আর কি বলবো,বললেই তো ব্লক প্রশাসন ও পঞ্চায়েত সমিতির দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের রোষানলে পড়তে হবে।’ বিদ্যালয়ের নাম ও তাঁর নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই প্রধান শিক্ষক বলেন,’এমনও দিন গেছে স্কুলের পড়ুয়াদের মুখে মিডডে মিল তুলে দেওয়ার জন্যে অন্য স্কুল থেকে চাল ’ধার’ নিতে হয়েছে।পরে চাল আসার পর তিনি সেই চাল শোধ দিয়েছেন। এমন অবস্থায় পূর্বে কোন দিনও পড়তে হয় নি।যে পরিস্থিতিতে এখন পড়তে হচ্ছে ।’
একই শর্তে চকদিঘি পঞ্চায়েত এলাকার একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেন,’মিডডে মিলের চাল পাওয়ার গোটা ব্যাপারটাতেই হঠাৎকরে ’ছন্দপতন’ ঘটে গিয়েছে ।এখন বিডিওকে চালের চাহিদার কথা জানালে বিডিও বলছেন ডিলারকে জানাতে।তার পরেও আগের মত ’রুটিন মাফিক’ চাল স্কুলে আসছে না ।’ একই রকম অভিযোগের কথা জানিয়েছেন,আরো বেশ কয়েকটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষিকা । তাদের মধ্যে জ্যোৎশ্রীরাম পঞ্চায়েত এলাকার একটি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মিডডে মিলের চাল যথাযথ ভাবে না পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে সরাসরি জেলায় চিঠি পাঠিয়েছেন ।
এই বিষয়ে বিডিও (জামালপুর) শুভঙ্কর মজুমদার কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন,“হ্যাঁ একথা ঠিক ,সময়মত যথাযথ পরিমাণ মিডডে মিলের
চাল না পাওয়ার কথা বেশ কয়েকটি স্কুল চিঠি লিখে আমায় জানিয়েছে।এমনটা হওয়ার জন্য বিডিও সব দোষ চাপিয়েছেন ডিলার রুমা চট্টোপাধ্যায়ের ঘাড়ে।বিডিও এও বলেন ,এফ সি আই গোডাউন থেকে চাল তো তুলেছে ডিলার। সেই চাল যতাযথ ভাবে স্কুলে স্কুলে পৌছে দেবার দায়িত্ত ডিলারেরই।সেটা না হওয়ার সব দায় ডিলারেরই।এর পরেই বিডিওর কাছে জানতে চাওয়া হয়,ডিলারের এমন কাজ কারবারের বিষয়ে জেলায় কি রিপোর্ট করেছেন? উত্তরে বিডিও বলেন,’চাল স্কুল স্কুলে না পৌছানো নিয়ে ডালারের কাছে জবাব চাওয়া হয়েছিল । ডিলার জানান গাড়ির সমস্যার জন্য তিনি চাল পৌছে দিতে পারেন নি। পুজোর পর সব স্কুলে চাল পৌছে দেবেন বলেছেন। তাই লিখিত ভাবে জেলায় কিছু জানাই নি, মৌখিক ভাবে সব জানিয়েছি’।চাল সব স্কুলে যথাযথ ভাবে সরবরাহ না হয়ে থাকলে চালতো ডিলালের গোডাউনে জমা হয়ে থাকার কথা । সেই ’স্টক’ রিপোর্ট কি জেলায় জানানো হয়েছিল?এর উত্তরে বিডিও বলেন,’স্টক রিপোর্ট তো ঠিকই আছে,ডিলারতো চাল ঘাটতির কোন রিপোর্ট দেয়নি।’ তাহলে চাল ’হাপিস’ করে দেওয়ার যে ’গুঞ্জন’ ছড়িয়েছে সেটাই কি সঠিক? এই প্রশ্নের উত্তরেও বিডিও নিশানায় থাকে সেই ডিলারই।যদিও ডিলার রুমা চট্টোপাধ্যায়ের সাফাই,’গাড়ির সমস্যা কিছুদিনের জন্য ছিল।কিন্তু তাঁর গোডাউনে বেশ কয়েকশো বস্তা চাল ড্যামেজ হয়ে যাওয়ায়
নাকি তিনি সমস্যায় পড়ে গিয়েছেন ।’ আর সব শুনে জেলাশাসক পূর্ণেন্দু মাজী জানিয়েছেন,’গোটা বিষয়টি তিনি এনকোয়ারি করে দেখবেন ।’
বিরোধীরা তো বটেই এমনকি কেন্দ্রও এই রাজ্যের বিরুদ্ধে মিডডে মিলে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছে।তা নিয়ে অস্বস্তিতে পড়েগিয়ে নড়ে চড়ে বসে রাজ্যের মিডডে মিল বিভাগ।দফতরের প্রজেক্ট ডাইরেক্টর প্রতিটি জেলার ’স্কুল’ ও ’ব্লক’ লেবেলে চালের ’স্টক’ নিয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করে দেন।তারই মধ্যে মিডডে মিলের চাল নিয়ে জামালপুরের শিক্ষকদের ক্ষোভ প্রকাশ এবং চাল ’হাপিস’ করে দেওয়ার ’গুঞ্জন’ বিরোধীদের আনা অভিযোগেই যেন শিলমোহর দিয়ে দিয়েছে। জেলা বিজেপির সহ-সভাপতি জিতেন ডকাল বলেন , মিডডে মিলের চাল নিয়ে যে ’গুঞ্জন“ ছড়িয়েছে তা নিয়ে আমরা উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের দাবি জানাচ্ছি ।’।